বৃত্তের ভেতরে বৃত্ত-ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা কি শুধু সওজেই? by দেবব্রত চক্রবর্তী বিষ্ণু
মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত আমাদের মহান স্বাধীনতা জাতির শ্রেষ্ঠ অর্জন। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। কিন্তু এই অর্জন এবং অধ্যায় নিয়ে স্বাধীনতা-উত্তর হীনমন্যকারীরা নানা রকম কেলেঙ্কারি করেছে, কেউ কেউ সুবিধা লুটে নিয়েছে এসব শ্রেষ্ঠত্বের গায়ে কালিমা লেপন করে।
বিশ্বের ইতিহাসে এমন কেলেঙ্কারি কিংবা কালিমা লেপনের বর্ণনা হয়তো বিরল; কিন্তু 'সব সম্ভবের দেশ' এই বাংলাদেশে এসব অপকীর্তি হয়েছে যথেষ্ট এবং এখনো হচ্ছে হরহামেশাই। ২৪ জানুয়ারি, ২০১২ দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিনের শেষ পৃষ্ঠায় এমনই একটি অপকীর্তির সংবাদ ছাপা হয়েছে ডাবল কলাম শিরোনামে। 'ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদে সওজে বর্ধিত মেয়াদে সাত কর্মকর্তা' শিরোনামে প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে যে তথ্যচিত্র তুলে ধরা হয়েছে, তা একদিকে যেমন বিস্ময়কর, অন্যদিকে প্রশ্নবোধকও। বিস্ময়কর এ জন্য, অপকীর্তি-অপকৌশলের জাল ক্রমেই এখানে ছড়াচ্ছে নানাভাবে; আর প্রশ্নবোধক এ জন্য, এত বড় ঘটনা প্রকাশের পরও প্রতিকার চিত্র আমাদের অজানা। প্রতিকার হয়েছে বলে এখনো জানা যায়নি এবং এমন ঘটনা প্রতিকারবিহীন থাকে বলেই উত্তরোত্তর নেতিবাচক দৃষ্টান্তের তালিকাও ক্রম দীর্ঘ হচ্ছে।
দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিনে প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরে (সওজে) জাল সনদ নিয়ে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধারা চাকরি করছেন, কারো কারোর চাকরির মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও এই সনদ প্রদর্শন করে তা পুনর্বার বাড়িয়েও নিয়েছেন। সওজের ৯ জন ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার নামও এসেছে ওই প্রতিবেদনে। এর মধ্যে দুজন ইতিমধ্যে অবসরে চলে গেছেন। বাকিরা এখনো আছেন বহালতবিয়তে। এমন ভুয়ারা যে শুধু সওজেই নয়, অন্য বিভাগ বা অধিদপ্তরেও আছেন, তা অনেকটা সংশয়াতীতভাবেই বলা যায়। কারণ ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা এবং সনদবিষয়ক প্রসঙ্গটি দীর্ঘদিন ধরে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা সঠিকভাবে প্রণয়নের ওপর গুরুত্বারোপ করে কিছু পদক্ষেপও নিয়েছিল। এ কথাও আছে, এমন প্রতিটা পদক্ষেপেই কিছু কিছু সুযোগসন্ধানী ভুল শুদ্ধ করার ফাঁকে আবার নতুন করে ভুয়ারাও সনদ বাগিয়ে নিয়েছেন! সওজের ব্যাপারে একটি গোয়েন্দা সংস্থার তরফে ইতিমধ্যে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়কে তথ্য দেওয়া হয়েছে, তাও উল্লেখ রয়েছে ওই প্রতিবেদনে। কিন্তু এর কোনো প্রতিকার হলো কি না, হলে কী ধরনের প্রতিকারইবা হয়েছে, তা স্পষ্ট করে ব্যাখ্যা করা অবশ্যই ওই মন্ত্রণালয়ের দায়। দায় অবশ্য যোগাযোগ মন্ত্রণালয়েরও কম নয়। এ মন্ত্রণালয়ের এমন কেলেঙ্কারির হোতাদের নাম আসার পর তারা কী পদক্ষেপ নিয়েছে, তা জানার অধিকার মানুষের রয়েছে। সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আফসারুজ্জামান, প্রকৌশলী হাফিজ আহমেদ ভুঁইয়া, প্রকৌশলী মো. আলম চাঁদ মিয়া, প্রকৌশলী আবদুল অদুদ, প্রকৌশলী আলী আহমেদ চৌধুরী, প্রকৌশলী তোজাম্মেল হোসেন, প্রকৌশলী আবদুল হালিম মিয়া, প্রধান প্রকৌশলী আবদুল কদ্দুছ এবং প্রকৌশলী শেখ শাহাবুদ্দিন ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সনদ নিয়ে চাকরি করছেন। এর মধ্যে আবদুল কদ্দুছ কয়েক মাস আগে অবসরে গেছেন ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদে অতিরিক্ত দুই বছর চাকরি করে আর শাহাবুদ্দিন তীব্র সমালোচনার মুখে শেষ পর্যন্ত পদত্যাগ করেন। জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা এনএসআইয়ের তদন্ত কর্মকর্তারা দীর্ঘ অনুসন্ধান শেষে নিশ্চিত হন, তাঁরা কেউই মুক্তিযোদ্ধা নন। একই সঙ্গে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রকৌশলী মাইনুল ইসলামের নামও এসেছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এ রকম মাইনুল ইসলাম, আলী আহমদ চৌধুরী, আবদুল কদ্দুছ কিংবা মো. আলম চাঁদ মিয়াদের সংখ্যা কত?
যাঁরা দেশ-জাতির কাছে নমস্য অর্থাৎ যেসব শ্রদ্ধেয় মুক্তিযোদ্ধা সেদিন দেশ-জাতির শৃঙ্খল মুক্তির লক্ষ্যে জীবনবাজি রেখে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে অনেকেই এখন মানবেতর জীবন যাপন করছেন, এই সত্য অস্বীকারের কোনো উপায় নেই। আর যাঁরা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণই করলেন না, তাঁরা ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সনদ নিয়ে কত অপকাণ্ডই না ঘটিয়ে যাচ্ছেন! রাষ্ট্রযন্ত্র এ ব্যাপারে যেন একেবারেই তাপহীন। বিদ্যমান পরিস্থিতি আমলে নিয়ে খুব সহজেই অনুমান করা যায়, ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সনদধারী অর্থাৎ এই সমাজ কিংবা দেশদ্রোহীদের তালিকা অনেক দীর্ঘ। কারণ তাদের যারা এ রকম জাল সনদ দিয়ে নিজেরাও আখের গোছাচ্ছে তারাও তো সম-অপরাধেই অভিযুক্ত। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, রাষ্ট্রযন্ত্র এত বড় অন্যায় সহ্য করে চলেছে কিভাবে? দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, যাঁরা একদিন এই জাতি-রাষ্ট্রের জন্মের বিরোধিতা করতে গিয়ে সভ্যতা-মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডের সক্রিয় অংশীদার হয়ে পৈশাচিকতা, বর্বরতার চরম ঘৃণ্য নজির স্থাপন করেছিল, তারা স্বাধীনতা অর্জনের মাত্র চার দশকের মধ্যে রাষ্ট্রক্ষমতারও অংশীদার হয়েছিল। এই ব্যর্থতার দায় দেশের প্রগতিবাদী রাজনীতিকরা যেমন এড়াতে পারেন না, তেমনি দায় এড়াতে পারেন না দেশের সচেতন মানুষও। যারা ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার জাল সনদ নিয়ে এত বড় দুষ্কর্ম করেছে এবং তাদের যারা সহযোগিতা করেছে, তারা সবাই আইনের দৃষ্টিতে গুরুতর অপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত। এই অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে যথাযথ কার্যকর পদক্ষেপ নিয়ে কঠোর প্রতিকারমূলক দৃষ্টান্ত দাঁড় করানো অবশ্যই রাষ্ট্রশক্তির দায়। এই দায় এড়ানোর কোনো পথ নেই।
২০১১ সালে সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক পদে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় আবেদন করা এক হাজার ৩৩৮ জনের মধ্যে ১৫২ জনের সনদ ভুয়া বলে প্রমাণিত হয়েছিল। ২০ জুলাই ২০১১, দৈনিক যুগান্তরে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, গেজেটে প্রকাশিত ৬২ হাজার ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সন্ধান মিলেছে। দুঃখজনক হলেও সত্য, প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা নিয়ে স্বাধীনতার ৪১ বছর পরও বিভ্রান্তি দূর হয়নি। স্বাধীনতার পর এ যাবৎ মুক্তিযোদ্ধাদের চারটি তালিকা প্রকাশিত হয়েছে। এরশাদ সরকারের আমলে প্রণীত মুক্তিযোদ্ধাদের জাতীয় তালিকা, মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের প্রণীত তালিকা, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ নির্বাচনের জন্য ব্রিগেডিয়ার আজম আমিনুল হকের নেতৃত্বে প্রণীত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা এবং গত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে প্রণীত মুক্তিযোদ্ধা সংসদের 'মুক্তি বার্তা'র তালিকা। বিগত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে এসব তালিকা বিবেচনা করে মুক্তিযোদ্ধাদের নাম গেজেট আকারে প্রকাশ করা হয়। জাতির শ্রেষ্ঠ, আলোকিত এবং আত্মত্যাগের অধ্যায় নিয়ে এই যে হ-য-ব-র-ল অবস্থা_এরই সুযোগ নিচ্ছে সুবিধাবাদী ঘৃণ্য চক্র। যেহেতু তাদের পরিচয় তুলে ধরে গণমাধ্যমে রাষ্ট্রের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সংস্থার তদন্ত প্রতিবেদনে প্রকৃত চিত্র প্রকাশ পেয়েছে, সেহেতু এর কঠোর ও দৃষ্টান্তমূলক প্রতিকার নিশ্চয়ই দুরূহ কোনো কাজ নয়। সরকার কি কাজটিকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রাধান্য দিয়ে প্রতিকারে পদক্ষেপ নেবে কিংবা নিষ্ঠ হবে? যদি সরকার তা করতে ব্যর্থ হয়, তবে একদিন তাদেরও এ জন্য ব্যাখ্যা দিতে হবে এবং ইতিহাসে এই ঘটনা ব্যর্থতার দায় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। শুভবুদ্ধিসম্পন্ন কারোরই এমনটি কাম্য হতে পারে না।
লেখক : সাংবাদিক
deba_bishnu@yahoo.com
দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিনে প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরে (সওজে) জাল সনদ নিয়ে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধারা চাকরি করছেন, কারো কারোর চাকরির মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও এই সনদ প্রদর্শন করে তা পুনর্বার বাড়িয়েও নিয়েছেন। সওজের ৯ জন ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার নামও এসেছে ওই প্রতিবেদনে। এর মধ্যে দুজন ইতিমধ্যে অবসরে চলে গেছেন। বাকিরা এখনো আছেন বহালতবিয়তে। এমন ভুয়ারা যে শুধু সওজেই নয়, অন্য বিভাগ বা অধিদপ্তরেও আছেন, তা অনেকটা সংশয়াতীতভাবেই বলা যায়। কারণ ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা এবং সনদবিষয়ক প্রসঙ্গটি দীর্ঘদিন ধরে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা সঠিকভাবে প্রণয়নের ওপর গুরুত্বারোপ করে কিছু পদক্ষেপও নিয়েছিল। এ কথাও আছে, এমন প্রতিটা পদক্ষেপেই কিছু কিছু সুযোগসন্ধানী ভুল শুদ্ধ করার ফাঁকে আবার নতুন করে ভুয়ারাও সনদ বাগিয়ে নিয়েছেন! সওজের ব্যাপারে একটি গোয়েন্দা সংস্থার তরফে ইতিমধ্যে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়কে তথ্য দেওয়া হয়েছে, তাও উল্লেখ রয়েছে ওই প্রতিবেদনে। কিন্তু এর কোনো প্রতিকার হলো কি না, হলে কী ধরনের প্রতিকারইবা হয়েছে, তা স্পষ্ট করে ব্যাখ্যা করা অবশ্যই ওই মন্ত্রণালয়ের দায়। দায় অবশ্য যোগাযোগ মন্ত্রণালয়েরও কম নয়। এ মন্ত্রণালয়ের এমন কেলেঙ্কারির হোতাদের নাম আসার পর তারা কী পদক্ষেপ নিয়েছে, তা জানার অধিকার মানুষের রয়েছে। সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আফসারুজ্জামান, প্রকৌশলী হাফিজ আহমেদ ভুঁইয়া, প্রকৌশলী মো. আলম চাঁদ মিয়া, প্রকৌশলী আবদুল অদুদ, প্রকৌশলী আলী আহমেদ চৌধুরী, প্রকৌশলী তোজাম্মেল হোসেন, প্রকৌশলী আবদুল হালিম মিয়া, প্রধান প্রকৌশলী আবদুল কদ্দুছ এবং প্রকৌশলী শেখ শাহাবুদ্দিন ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সনদ নিয়ে চাকরি করছেন। এর মধ্যে আবদুল কদ্দুছ কয়েক মাস আগে অবসরে গেছেন ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদে অতিরিক্ত দুই বছর চাকরি করে আর শাহাবুদ্দিন তীব্র সমালোচনার মুখে শেষ পর্যন্ত পদত্যাগ করেন। জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা এনএসআইয়ের তদন্ত কর্মকর্তারা দীর্ঘ অনুসন্ধান শেষে নিশ্চিত হন, তাঁরা কেউই মুক্তিযোদ্ধা নন। একই সঙ্গে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রকৌশলী মাইনুল ইসলামের নামও এসেছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এ রকম মাইনুল ইসলাম, আলী আহমদ চৌধুরী, আবদুল কদ্দুছ কিংবা মো. আলম চাঁদ মিয়াদের সংখ্যা কত?
যাঁরা দেশ-জাতির কাছে নমস্য অর্থাৎ যেসব শ্রদ্ধেয় মুক্তিযোদ্ধা সেদিন দেশ-জাতির শৃঙ্খল মুক্তির লক্ষ্যে জীবনবাজি রেখে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে অনেকেই এখন মানবেতর জীবন যাপন করছেন, এই সত্য অস্বীকারের কোনো উপায় নেই। আর যাঁরা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণই করলেন না, তাঁরা ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সনদ নিয়ে কত অপকাণ্ডই না ঘটিয়ে যাচ্ছেন! রাষ্ট্রযন্ত্র এ ব্যাপারে যেন একেবারেই তাপহীন। বিদ্যমান পরিস্থিতি আমলে নিয়ে খুব সহজেই অনুমান করা যায়, ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সনদধারী অর্থাৎ এই সমাজ কিংবা দেশদ্রোহীদের তালিকা অনেক দীর্ঘ। কারণ তাদের যারা এ রকম জাল সনদ দিয়ে নিজেরাও আখের গোছাচ্ছে তারাও তো সম-অপরাধেই অভিযুক্ত। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, রাষ্ট্রযন্ত্র এত বড় অন্যায় সহ্য করে চলেছে কিভাবে? দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, যাঁরা একদিন এই জাতি-রাষ্ট্রের জন্মের বিরোধিতা করতে গিয়ে সভ্যতা-মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডের সক্রিয় অংশীদার হয়ে পৈশাচিকতা, বর্বরতার চরম ঘৃণ্য নজির স্থাপন করেছিল, তারা স্বাধীনতা অর্জনের মাত্র চার দশকের মধ্যে রাষ্ট্রক্ষমতারও অংশীদার হয়েছিল। এই ব্যর্থতার দায় দেশের প্রগতিবাদী রাজনীতিকরা যেমন এড়াতে পারেন না, তেমনি দায় এড়াতে পারেন না দেশের সচেতন মানুষও। যারা ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার জাল সনদ নিয়ে এত বড় দুষ্কর্ম করেছে এবং তাদের যারা সহযোগিতা করেছে, তারা সবাই আইনের দৃষ্টিতে গুরুতর অপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত। এই অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে যথাযথ কার্যকর পদক্ষেপ নিয়ে কঠোর প্রতিকারমূলক দৃষ্টান্ত দাঁড় করানো অবশ্যই রাষ্ট্রশক্তির দায়। এই দায় এড়ানোর কোনো পথ নেই।
২০১১ সালে সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক পদে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় আবেদন করা এক হাজার ৩৩৮ জনের মধ্যে ১৫২ জনের সনদ ভুয়া বলে প্রমাণিত হয়েছিল। ২০ জুলাই ২০১১, দৈনিক যুগান্তরে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, গেজেটে প্রকাশিত ৬২ হাজার ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সন্ধান মিলেছে। দুঃখজনক হলেও সত্য, প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা নিয়ে স্বাধীনতার ৪১ বছর পরও বিভ্রান্তি দূর হয়নি। স্বাধীনতার পর এ যাবৎ মুক্তিযোদ্ধাদের চারটি তালিকা প্রকাশিত হয়েছে। এরশাদ সরকারের আমলে প্রণীত মুক্তিযোদ্ধাদের জাতীয় তালিকা, মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের প্রণীত তালিকা, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ নির্বাচনের জন্য ব্রিগেডিয়ার আজম আমিনুল হকের নেতৃত্বে প্রণীত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা এবং গত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে প্রণীত মুক্তিযোদ্ধা সংসদের 'মুক্তি বার্তা'র তালিকা। বিগত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে এসব তালিকা বিবেচনা করে মুক্তিযোদ্ধাদের নাম গেজেট আকারে প্রকাশ করা হয়। জাতির শ্রেষ্ঠ, আলোকিত এবং আত্মত্যাগের অধ্যায় নিয়ে এই যে হ-য-ব-র-ল অবস্থা_এরই সুযোগ নিচ্ছে সুবিধাবাদী ঘৃণ্য চক্র। যেহেতু তাদের পরিচয় তুলে ধরে গণমাধ্যমে রাষ্ট্রের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সংস্থার তদন্ত প্রতিবেদনে প্রকৃত চিত্র প্রকাশ পেয়েছে, সেহেতু এর কঠোর ও দৃষ্টান্তমূলক প্রতিকার নিশ্চয়ই দুরূহ কোনো কাজ নয়। সরকার কি কাজটিকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রাধান্য দিয়ে প্রতিকারে পদক্ষেপ নেবে কিংবা নিষ্ঠ হবে? যদি সরকার তা করতে ব্যর্থ হয়, তবে একদিন তাদেরও এ জন্য ব্যাখ্যা দিতে হবে এবং ইতিহাসে এই ঘটনা ব্যর্থতার দায় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। শুভবুদ্ধিসম্পন্ন কারোরই এমনটি কাম্য হতে পারে না।
লেখক : সাংবাদিক
deba_bishnu@yahoo.com
No comments