দুই দু’গুণে পাঁচ-বিজ্ঞাপন সমাচার by আতাউর রহমান
বিজ্ঞাপন সংস্থাগুলো—যেগুলোর কাজই হচ্ছে ভোক্তাদের মনে নির্দিষ্ট পণ্যের চাহিদা সৃষ্টি করা—নিজেরাই চুটিয়ে ব্যবসা করে যাচ্ছে। বলা হয়ে থাকে যে বিজ্ঞাপন প্রদান ব্যতিরেকে ব্যবসা করা অন্ধকারে কোনো মেয়েকে চোখ ঠারার সমান; আপনি জানলেন কী করছেন, কিন্তু মেয়েটি জানল না।
আরও বলা হয়ে থাকে যে যিনি পয়সা বাঁচানোর জন্য বিজ্ঞাপন দেওয়া থেকে বিরত থাকেন, তাঁর উপমা হচ্ছে সেই ব্যক্তি, যিনি সময় বাঁচানোর জন্য ঘড়ি বন্ধ করে দেন। এ প্রসঙ্গে বিশ্বখ্যাত রিগলি চুইংগামের মালিক কোটিপতি মি. ফিলিপ রিগলি একদা প্লেনে ভ্রমণকালে সহযাত্রীর সংশ্লিষ্ট প্রশ্নের উত্তরে যে কথাটি বলেছিলেন, সেটি স্মর্তব্য; ‘ভূপৃষ্ঠ থেকে ৩০ হাজার ফুট ঊর্ধ্বে ওঠার পরও পাইলট যে কারণে প্লেনের ইঞ্জিন চালু রেখেছেন, ঠিক সে কারণেই আমি আমার পণ্যের প্রসার সত্ত্বেও প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছি।’
অবশ্য সুবিখ্যাত ইংরেজ সাহিত্যিক অলডাস হাক্সলি যথার্থই বলেছেন, ‘বিজ্ঞাপন হচ্ছে আধুনিক সাহিত্যিক উপাদানসমূহের মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় ও দুঃসাধ্য।’ আরেকজন কে যেন বলেছেন, ‘বিজ্ঞাপন হচ্ছে অর্ধ সত্যকে পূর্ণ মিথ্যায় রূপান্তর করার কলাকৌশল।’ তা পত্রিকার পাতায় একসঙ্গে বিজ্ঞাপন বেরোল, ‘উচ্চশিক্ষিত, বিত্তশালী পাত্রের জন্য অমুক উপন্যাসের সুন্দরী নায়িকার মতো পাত্রী চাই।’ অতঃপর ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে উপন্যাসটির সব কপি বিক্রি হয়ে নিঃশেষ এবং বিলেতের এক ফুলের দোকানি নাকি লিখে রেখেছিল: ‘ধূমপান ও আপনার স্ত্রীর জন্মতারিখ ভুলে যাওয়া—দুটোই আপনার স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।’
আর হ্যাঁ, বিলবোর্ড ছাড়াও সংবাদপত্র, টিভি আর রেডিওই হচ্ছে বিজ্ঞাপনের প্রধান বাহন। সেই ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষলগ্নে মার্ক টোয়েন যখন মিসৌরির একটি ছোট্ট পত্রিকার সম্পাদক, তখন এক গ্রাহকের কাছ থেকে পত্রিকার ভাঁজে এক মরা মাকড়সা পাওয়ার অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি লিখে পাঠিয়েছিলেন, ‘মাকড়সাটি আমাদের পত্রিকায় পর্যবেক্ষণ করছিল, কোন বণিক আমাদের এই পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেননি, যাতে করে সে ওই বণিকের গুদামঘরে গিয়ে জাল বুনে নিরুপদ্রবে অবশিষ্ট জীবন কাটাতে পারে।’ আর বর্তমানে? বর্তমানে তো আমাদের দেশে জাতীয় দৈনিকসমূহের প্রথম পাতার প্রায় অর্ধেকটা জুড়ে প্রায়ই থাকে বাণিজ্যিক পণ্যের বিজ্ঞাপন। আমার বিশ্বাস, আগের দিনের প্রবীণ সম্পাদকেরা এটা দেখতে পেলে নির্ঘাৎ হার্ট অ্যাটাকে মারা যেতেন।
তো সংবাদপত্রের প্রসঙ্গে মনে পড়ে গেল: অনেক আগে গল্প শুনেছিলাম, এক ভদ্রলোকের পোষা কুকুরটি হারিয়ে যাওয়ায় তিনি বিরাট পুরস্কার ঘোষণা করে পরদিন পত্রিকায় প্রকাশের জন্য বিজ্ঞাপনের কপি দিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু পরদিন তাঁর বাসায় পত্রিকাটি পৌঁছাতে দেরি হওয়ায় তিনি স্বয়ং পত্রিকা অফিসে এসে খোঁজ নিয়ে জানতে পেলেন, পুরস্কারের লোভে পত্রিকা অফিসের সবাই কুকুরটির সন্ধানে বেরিয়ে পড়ায় সেদিন আর পত্রিকাটি বেরোয়নি। সেই গল্পটির সঙ্গে অধুনা যোগ হয়েছে: বিদেশে এক ভদ্রলোক পত্রিকা অফিসে এসে বললেন, ‘আমি আমার স্ত্রীর হারিয়ে যাওয়া পোষা বিড়ালটির জন্য ৫০০ ডলার পুরস্কার ঘোষণা করে একটা হারানো বিজ্ঞপ্তি দিতে চাই।’ পত্রিকার প্রতিনিধি তখন তাঁকে প্রশ্ন করে বসলেন, ‘একটা বিড়ালের জন্য ৫০০ ডলার অফার করা কি বেশি হয়ে যাচ্ছে না?’
‘এইটার জন্য নয়’, ভদ্রলোক চটপট জবাব দিলেন, ‘এইটাকে আমি নিজে পানিতে ডুবিয়ে মেরেছি।’
আর টিভিতে বাণিজ্যিক বিজ্ঞাপন? এটার কথা আর কী বলব! আগে প্রোগ্রামের মাঝে মাঝে থাকত বিজ্ঞাপন, আজকাল বিজ্ঞাপনের মাঝে মাঝে দেখানো হয় প্রোগ্রাম। এবং টিভির সুন্দরী সংবাদ পাঠিকা যখন বলেন, ‘এবারে বিজ্ঞাপন বিরতি’, তখন মনে ভাবনা জাগে, ‘বিরতি’ না বলে ‘বিরক্তি’ বললেই বোধ হয় অধিকতর সংগত হতো। তা টিভির প্রায় একমাত্র আয়ের উৎসই যেহেতু বিজ্ঞাপন, সেহেতু প্রাইভেট টিভি চ্যানেলের সংখ্যা বৃদ্ধি পেলেই আমাদের ভয় হয়, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম না আরেক দফা বৃদ্ধি পায়। কেননা বিজ্ঞাপনের খরচ অন্তর্ভুক্ত করেই তো উৎপাদন ব্যয় ধরা হয়ে থাকে। অবশ্য টিভির বাণিজ্যিক বিজ্ঞাপনগুলো একদিক দিয়ে কিন্তু শিক্ষামূলক—ওগুলো আমাদের শেখায় বিজ্ঞাপনদাতা আমাদের কতটা বোকা মনে করেন আর আমাদের ধৈর্যশক্তিই বা কতটুকু!
তবে টিভিতে প্রদর্শিত বিজ্ঞাপনসমূহের কুশীলবেরা যেসব পণ্যের গুণগান করেন, সেসব পণ্য ওঁরা নিজেরা কেনেন ও ব্যবহার করেন কি না, সেটাই আসল কথা। আমাদের দেশের এক মডেলকে এ ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে তিনি নাকি বলেছিলেন, ‘দেশীয় সাবানের অ্যাড করে আমি যে মোটা পয়সা পাই, তা দিয়ে বিদেশি সাবান কিনি।’ আর আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সংগীতজ্ঞ জিওভানি মার্টিনেলি একবার জিজ্ঞাসিত হয়ে বলেছিলেন, ‘আমি ধূমপানের কথা চিন্তাও করতে পারি না।’ অতঃপর তাঁকে যখন বলা হলো ‘কিন্তু আপনি একবার একটি সিগারেটের বিজ্ঞাপনে তো বলেছেন যে ওটা আপনার কণ্ঠস্বরের ক্ষতি করে না।’ তখন তিনি সহাস্যে বললেন, ‘তা ঠিকই তো বলেছি। আমি ধূমপান করি না বিধায় ওই সিগারেট দ্বারা আমার কণ্ঠস্বরের ক্ষতির প্রশ্নই ওঠে না।’ অবশ্য বর্তমানে মিডিয়ায় সিগারেটের বিজ্ঞাপন প্রচার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
শেষ করছি বিলবোর্ডে বিজ্ঞাপনসংক্রান্ত মজার গল্পটি দিয়ে: আমাদের পুরান ঢাকার বাসিন্দা চান্দুমিয়া ওর বন্ধু জুম্মনকে নিয়ে বেড়াতে গেছে কলকাতায়। সেখানে গিয়ে সে এক জায়গায় বিলবোর্ডে লেখা আছে দেখতে পেল, ‘গোপালের গেঞ্জি ও জাঙ্গিয়া পরুন’। দেখেই সে বন্ধুকে উদ্দেশ করে বলে উঠল, ‘দেখছসনি, হালায় কী লেখছে? গোপালের গেঞ্জি ও জাঙ্গিয়া যদি আরেক ব্যাটায় পইরা ফালায়, তাইলে গোপালে আইসা পরবটা কী?’
আতাউর রহমান: রম্য লেখক; ডাক বিভাগের সাবেক মহাপরিচালক।
অবশ্য সুবিখ্যাত ইংরেজ সাহিত্যিক অলডাস হাক্সলি যথার্থই বলেছেন, ‘বিজ্ঞাপন হচ্ছে আধুনিক সাহিত্যিক উপাদানসমূহের মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় ও দুঃসাধ্য।’ আরেকজন কে যেন বলেছেন, ‘বিজ্ঞাপন হচ্ছে অর্ধ সত্যকে পূর্ণ মিথ্যায় রূপান্তর করার কলাকৌশল।’ তা পত্রিকার পাতায় একসঙ্গে বিজ্ঞাপন বেরোল, ‘উচ্চশিক্ষিত, বিত্তশালী পাত্রের জন্য অমুক উপন্যাসের সুন্দরী নায়িকার মতো পাত্রী চাই।’ অতঃপর ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে উপন্যাসটির সব কপি বিক্রি হয়ে নিঃশেষ এবং বিলেতের এক ফুলের দোকানি নাকি লিখে রেখেছিল: ‘ধূমপান ও আপনার স্ত্রীর জন্মতারিখ ভুলে যাওয়া—দুটোই আপনার স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।’
আর হ্যাঁ, বিলবোর্ড ছাড়াও সংবাদপত্র, টিভি আর রেডিওই হচ্ছে বিজ্ঞাপনের প্রধান বাহন। সেই ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষলগ্নে মার্ক টোয়েন যখন মিসৌরির একটি ছোট্ট পত্রিকার সম্পাদক, তখন এক গ্রাহকের কাছ থেকে পত্রিকার ভাঁজে এক মরা মাকড়সা পাওয়ার অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি লিখে পাঠিয়েছিলেন, ‘মাকড়সাটি আমাদের পত্রিকায় পর্যবেক্ষণ করছিল, কোন বণিক আমাদের এই পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেননি, যাতে করে সে ওই বণিকের গুদামঘরে গিয়ে জাল বুনে নিরুপদ্রবে অবশিষ্ট জীবন কাটাতে পারে।’ আর বর্তমানে? বর্তমানে তো আমাদের দেশে জাতীয় দৈনিকসমূহের প্রথম পাতার প্রায় অর্ধেকটা জুড়ে প্রায়ই থাকে বাণিজ্যিক পণ্যের বিজ্ঞাপন। আমার বিশ্বাস, আগের দিনের প্রবীণ সম্পাদকেরা এটা দেখতে পেলে নির্ঘাৎ হার্ট অ্যাটাকে মারা যেতেন।
তো সংবাদপত্রের প্রসঙ্গে মনে পড়ে গেল: অনেক আগে গল্প শুনেছিলাম, এক ভদ্রলোকের পোষা কুকুরটি হারিয়ে যাওয়ায় তিনি বিরাট পুরস্কার ঘোষণা করে পরদিন পত্রিকায় প্রকাশের জন্য বিজ্ঞাপনের কপি দিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু পরদিন তাঁর বাসায় পত্রিকাটি পৌঁছাতে দেরি হওয়ায় তিনি স্বয়ং পত্রিকা অফিসে এসে খোঁজ নিয়ে জানতে পেলেন, পুরস্কারের লোভে পত্রিকা অফিসের সবাই কুকুরটির সন্ধানে বেরিয়ে পড়ায় সেদিন আর পত্রিকাটি বেরোয়নি। সেই গল্পটির সঙ্গে অধুনা যোগ হয়েছে: বিদেশে এক ভদ্রলোক পত্রিকা অফিসে এসে বললেন, ‘আমি আমার স্ত্রীর হারিয়ে যাওয়া পোষা বিড়ালটির জন্য ৫০০ ডলার পুরস্কার ঘোষণা করে একটা হারানো বিজ্ঞপ্তি দিতে চাই।’ পত্রিকার প্রতিনিধি তখন তাঁকে প্রশ্ন করে বসলেন, ‘একটা বিড়ালের জন্য ৫০০ ডলার অফার করা কি বেশি হয়ে যাচ্ছে না?’
‘এইটার জন্য নয়’, ভদ্রলোক চটপট জবাব দিলেন, ‘এইটাকে আমি নিজে পানিতে ডুবিয়ে মেরেছি।’
আর টিভিতে বাণিজ্যিক বিজ্ঞাপন? এটার কথা আর কী বলব! আগে প্রোগ্রামের মাঝে মাঝে থাকত বিজ্ঞাপন, আজকাল বিজ্ঞাপনের মাঝে মাঝে দেখানো হয় প্রোগ্রাম। এবং টিভির সুন্দরী সংবাদ পাঠিকা যখন বলেন, ‘এবারে বিজ্ঞাপন বিরতি’, তখন মনে ভাবনা জাগে, ‘বিরতি’ না বলে ‘বিরক্তি’ বললেই বোধ হয় অধিকতর সংগত হতো। তা টিভির প্রায় একমাত্র আয়ের উৎসই যেহেতু বিজ্ঞাপন, সেহেতু প্রাইভেট টিভি চ্যানেলের সংখ্যা বৃদ্ধি পেলেই আমাদের ভয় হয়, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম না আরেক দফা বৃদ্ধি পায়। কেননা বিজ্ঞাপনের খরচ অন্তর্ভুক্ত করেই তো উৎপাদন ব্যয় ধরা হয়ে থাকে। অবশ্য টিভির বাণিজ্যিক বিজ্ঞাপনগুলো একদিক দিয়ে কিন্তু শিক্ষামূলক—ওগুলো আমাদের শেখায় বিজ্ঞাপনদাতা আমাদের কতটা বোকা মনে করেন আর আমাদের ধৈর্যশক্তিই বা কতটুকু!
তবে টিভিতে প্রদর্শিত বিজ্ঞাপনসমূহের কুশীলবেরা যেসব পণ্যের গুণগান করেন, সেসব পণ্য ওঁরা নিজেরা কেনেন ও ব্যবহার করেন কি না, সেটাই আসল কথা। আমাদের দেশের এক মডেলকে এ ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে তিনি নাকি বলেছিলেন, ‘দেশীয় সাবানের অ্যাড করে আমি যে মোটা পয়সা পাই, তা দিয়ে বিদেশি সাবান কিনি।’ আর আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সংগীতজ্ঞ জিওভানি মার্টিনেলি একবার জিজ্ঞাসিত হয়ে বলেছিলেন, ‘আমি ধূমপানের কথা চিন্তাও করতে পারি না।’ অতঃপর তাঁকে যখন বলা হলো ‘কিন্তু আপনি একবার একটি সিগারেটের বিজ্ঞাপনে তো বলেছেন যে ওটা আপনার কণ্ঠস্বরের ক্ষতি করে না।’ তখন তিনি সহাস্যে বললেন, ‘তা ঠিকই তো বলেছি। আমি ধূমপান করি না বিধায় ওই সিগারেট দ্বারা আমার কণ্ঠস্বরের ক্ষতির প্রশ্নই ওঠে না।’ অবশ্য বর্তমানে মিডিয়ায় সিগারেটের বিজ্ঞাপন প্রচার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
শেষ করছি বিলবোর্ডে বিজ্ঞাপনসংক্রান্ত মজার গল্পটি দিয়ে: আমাদের পুরান ঢাকার বাসিন্দা চান্দুমিয়া ওর বন্ধু জুম্মনকে নিয়ে বেড়াতে গেছে কলকাতায়। সেখানে গিয়ে সে এক জায়গায় বিলবোর্ডে লেখা আছে দেখতে পেল, ‘গোপালের গেঞ্জি ও জাঙ্গিয়া পরুন’। দেখেই সে বন্ধুকে উদ্দেশ করে বলে উঠল, ‘দেখছসনি, হালায় কী লেখছে? গোপালের গেঞ্জি ও জাঙ্গিয়া যদি আরেক ব্যাটায় পইরা ফালায়, তাইলে গোপালে আইসা পরবটা কী?’
আতাউর রহমান: রম্য লেখক; ডাক বিভাগের সাবেক মহাপরিচালক।
No comments