চরাচর-আর্সেনিকের ভয়াবহতা by আলম শাইন
আর্সেনিক একধরনের ধূসর ধাতব পদার্থ। একে সহজেই ভেঙে গুঁড়ো করা যায়। এর রাসায়নিক সংকেত অঝ। সাধারণত দুই রকম আর্সেনিক বিদ্যমান। জৈব ও অজৈব আর্সেনিক। জৈব অপেক্ষা অজৈব আর্সেনিক বেশি ক্ষতিকর। পানিতে প্রধানত অজৈব আর্সেনিক বেশি পাওয়া যায়। বিশেষজ্ঞদের মতে পানিতে আর্সেনিকের সহনীয় মাত্রা ০.০৫ পিপিএম।
অথচ বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন সীমান্ত এলাকার জেলাগুলোতে নলকূপের পানিতে আর্সেনিকের মাত্রা পেয়েছে ২ থেকে ২.৫ পিপিএম. যা জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি। ইতিমধ্যে তার প্রতিফলনও ঘটছে ব্যাপক হারে। বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোতে রীতিমতো দুর্যোগ আকার ধারণ করেছে। যদিও দেশের ৬১টি জেলায় আর্সেনিকের মাত্রাতিরিক্তের খবর পাওয়া গেছে। তথাপি উত্তরাঞ্চলের তুলনায় অন্য সব জেলা কিছুটা কম ঝুঁকিতে রয়েছে। এক সমীক্ষায় জানা যায়, বাংলাদেশের ৬৫ শতাংশ মানুষ এখন আর্সেনিক ঝুঁকির সম্মুখীন। এর মধ্যে ২৬৪টি উপজেলার মানুষ মারাত্মকভাবে আক্রান্ত। আক্রান্তদের বেশির ভাগেরই হাতে-পায়ে ফোস্কা এবং আঙুলের মাথায় পচন ধরছে। এ ছাড়া অনেকেরই বুকে-পিঠে কিংবা জিহ্বা, মাঢ়িতে ঘায়ের সৃষ্টি করছে। যা পরবর্তী সময়ে মারাত্মক ক্যান্সারে রূপ নিচ্ছে। অনেকের আবার কিডনি-যকৃৎ বিকল হয়ে পড়ছে। শুধু যে নলকূপের পানি পান করে তারা আর্সেনিকের বিষে আক্রান্ত হচ্ছে তা নয়; উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলসহ দেশের ৪৩টি জেলার মানুষ বোরো ধানের চালের ভাত খেয়েও মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হচ্ছেন। যেহেতু বোরো ধানচাষে প্রচুর ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার করা হয়, সেহেতু ওই ফসলে আর্সেনিকের বিষক্রিয়ায় স্বাভাবিকভাবে আক্রান্ত হয়। ১৯৮৮ সালে ভারতের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের 'দি স্কুল অব এনভায়রনমেন্টাল স্টাডিজ' প্রথম একটি সমীক্ষা চালায় পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জায়গায়। সে গবেষণায় আর্সেনিকের অবস্থান নির্ণয় হয় ৭০ থেকে ২০০ ফুট মাটির নিচে। প্রায় ৩৫ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে এর বিস্তৃতিও ধরা পড়ে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, গ্রীষ্মকালীন ফসলের জন্য ভূগর্ভস্থ পানির ব্যাপক ব্যবহারের কারণে মাটির কম্পোজিশনে পরিবর্তন ঘটে। যার ফলে ভূগর্ভস্থ পানিতে আর্সেনিকের দূষণ ঘটে। পরবর্তী সময়ে তা ছড়িয়ে পড়ে পূর্ববঙ্গেও। (উল্লেখ্য, আর্সেনিক মাটির নিচ দিয়ে দ্রুত ছড়াতে সক্ষম) আমরা জানতে পেরেছি ১৯৯৬ সালে প্রথম বাংলাদেশের ভূগর্ভস্থ পানিতে আর্সেনিকের সন্ধান পাওয়া গেছে। এরপর দীর্ঘ ১৫টি বছর কেটে গেলেও অদ্যাবধি আর্সেনিকের কবল থেকে মুক্তি পায়নি জাতি। প্রত্যন্ত অঞ্চলের অনেকেই এখনো জানে না আর্সেনিক আসলেই কী? তারা আর্সেনিকের বিষে আক্রান্ত হয়ে (বিশেষ করে হাত-পায়ের তালু কিংবা শরীরে কালচে বাদামি রঙের দাগ নিয়ে) কবিরাজ বা হাতুড়ে ডাক্তারের শরণাপন্ন হলে মামুলি চর্মরোগ হয়েছে বলে জেনে আসে। এতে ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি তারা যে মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। অথচ এ আক্রান্ত ব্যক্তিদের অনেকের ওপর পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে জানা গেছে, তাদের প্রস্রাবে ১০০ থেকে ১৬০ শতাংশ বেশি আর্সেনিক রয়েছে। যার ফলাফল নির্ঘাত মৃত্যু। বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, আর্সেনিক আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা নেই বললেই চলে। হতাশাজনক সংবাদটি শোনার পর আমাদের করার কিছু নেই মনে করে চুপচাপ বসে থাকলে চলবে না। এ মহামারি থেকে মুক্তি পেতে আমাদের সংগ্রাম করতে হবে। জনগণকে নিরাপদ পানি পানে উৎসাহী করতে হবে। বেশি বেশি প্রচার করে জনসচেতনতা গড়ে তুলতে হবে। এ ব্যাপারে এনজিও দাতা দেশ এবং আমাদের প্রচারমাধ্যমগুলোর বলিষ্ঠ ভূমিকা একান্ত কাম্য। তাহলে হয়তো আক্রান্তের সংখ্যা অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব হতে পারে।
আলম শাইন
আলম শাইন
No comments