বাঘা তেঁতুল-বাঙালির কথা by সৈয়দ আবুল মকসুদ
বাঙালি যেখানকারই বাসিন্দা হোক, পৃথিবীর কোনো ভূখণ্ডের হোক, মঙ্গল গ্রহের হোক, পৃথিবীর উপগ্রহ চাঁদের হোক—সব জায়গায়ই স্বভাবে সে একই রকম। উদীয়মান সূর্যকে নমস্কার করতে সে অদ্বিতীয়। যে সূর্য ডুবে গেল, তাকে কষে দুটো গাল না দিলে তার ভাত হজম হয় না।
বাঙালি আজ যাকে সম্বোধন করে বন্ধু, কাল তাকে বলে দুশমন। আজ যাকে ডাকে দিদি, তিন বছর পরে হয়তো এমন কিছুতে সম্বোধন করবে, যা শুনলে কান লাল হয়ে যাবে নিষ্পাপ কিশোর-কিশোরীদের। খামোখাই বাঙালি কারও পেছনে গিয়ে জড়ো হয় না। সে কিছু চায়। যখন সে কিছু চায়, তখন একমুঠো চায় না। সে চায় এক ঝুড়ি অথবা আড়াই মণি চটের বস্তার পুরো এক বস্তা ভর্তি। যখন সে তা পায় না, তখন চুপ করে বসে থাকার পাত্র সে নয়, মুখ দিয়ে ফুটতে থাকে খইয়ের মতো খিস্তিখেউড়। সেসব সুবচন শুনলে কোনো ভদ্রলোকের করার মতো কাজ একটিই থাকে—কানে আঙুল দেওয়া।
প্রত্যাশিত কোনো কিছু না পেলে বাঙালি যে তার অসন্তুষ্টি ঘরের মধ্যে বসে বসে তার বউ বা স্বামী বা শাশুড়ির কাছে প্রকাশ করবে, তা নয়। তার অসন্তোষ প্রকাশের জায়গা অনেক। পান-সিগারেটের দোকানে দাঁড়িয়ে পান চিবোতে চিবোতে অথবা সিগারেটে আগুন ধরাতে গিয়ে তার মনের আগুন জ্বলে ওঠে। মুদি দোকানে তেল-নুন কিনতে গিয়ে দশ কথা না বললে নয়। ফুটপাতে চেনা-অচেনা কাউকে পেলেই হয়। মুখ খুলে যায়। বাসের মধ্যে চুপ করে বসে থাকার পাত্র বাঙালি নয়। সেখানে অসন্তোষ প্রকাশের জন্য মানুষের অভাব হয় না। তবে হাত-পা ছুড়ে অসন্তোষ প্রকাশের সবচেয়ে উপযুক্ত স্থান অফিস। বেতনটার জন্য কয়েক ঘণ্টা যখন বাধ্য হয়ে ওখানে থাকতেই হয়, সুতরাং তা উশুল করে কারও ওপর মনের ঝাল মিটিয়ে।
ভোটাভুটি করে কাউকে ক্ষমতায় বসাক অথবা ওসব ঝামেলায় না গিয়ে কেউ নিজেই যদি লাফ দিয়ে ক্ষমতার মগডালে গিয়ে বসে পড়ে—তার জন্য শুধু তিন-উল্লাস নয়, তিন লাফ দিতে বাঙালির প্রবল উৎসাহ। মুসলিম লীগকে কুপোকাত করে যুক্তফ্রন্ট বিজয়ী হলে আনন্দের বন্যা বয়ে গেল দুই বাংলায়। মওলানা ভাসানীকে কাঁধে করে নিয়ে কর্মীরা আরমানিটোলা মাঠে জনসভায় যায়। চার বছর পর গণতন্ত্রের কবর খনন করে আইয়ুব খান ক্ষমতা দখল করলে বাংলার আবালবৃদ্ধবুদ্ধিজীবীর সে কী প্রশংসা—মৌখিক ও লিখিতভাবে। চট্টগ্রাম থেকে পেশোয়ার পর্যন্ত ট্রেনে প্রমোদভ্রমণ। তারপর সফরনামা রচনা।
বাঙালি বাঙালিই—তা তারা বঙ্গের পুব দিকেই থাকুক আর পশ্চিম দিকেই থাকুক।
সিদ্ধার্থ শঙ্করের প্রায়-ফ্যাসিবাদী সরকারকে হটিয়ে যেদিন জ্যোতি বসু ক্ষমতায় আসেন, সেদিন বাঙালির সে কী উল্লাস! জ্যোতি বসু যখন মৃত্যুশয্যায়, তখন আমি কলকাতায় গিয়েছিলাম। দিন দশেক ডাক্তাররা তাঁকে কোনো রকমে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন। ওই মুহূর্তটিতে শত্রু-মিত্র সবার সহানুভূতি একজনের প্রাপ্য। কিন্তু জ্যোতিবাবু সম্পর্কে এমন সব জঘন্য কথা সেখানকার বাংলা-ইংরেজি কাগজে লেখা হচ্ছিল, যা কোনোভাবে তাঁর চোখে পড়লে বেদনার তীব্র আঘাতে তিনি বেঁচে উঠতেন।
জ্যোতিবাবুর মনোনীত উত্তরাধিকারী হিসেবে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য যখন মুখ্যমন্ত্রী হন, ডান-বাম কাগজগুলো তাঁকে লেনিন, মাও ও চৌ এন লাইয়ের চেয়ে কিঞ্চিৎ যোগ্য হিসেবে বিবেচনা করে। পৃথিবীর সমাজতন্ত্র ও অ-সমাজতন্ত্র—দুটোর ভবিষ্যৎ তাঁরই হাতে। বসু ও ভট্টাচার্য এক রকম নেতা নন। তখন আমি বলেছিলাম, মার্ক্সের কবর হয়েছে লন্ডনে, তাঁর কুলখানিটা কলকাতায় সম্পন্ন হবে ভট্টাচার্যের হাতে। বন্ধুরা বিশ্বাস করেননি।
সুবিধাবাদী বুদ্ধিজীবীসহ সাধারণ মানুষের ইচ্ছায় কলকাতায় ক্ষমতার পালাবদল ঘটেছে। আনন্দের বন্যা বইছে সেখানে। এপারের নেতা থেকে সংবাদকর্মীরাও তাতে শরিক। আনন্দ প্রকাশের ধরনটা বাঙালিসুলভ। পুব-পশ্চিম দুই দিকেই প্রতিক্রিয়া প্রকাশের ধরনটাও একেবারেই বাঙালির মতো। বুদ্ধদেব ও বামরা তাঁদের কর্মফল ভোগ করবেন। কিন্তু বাম-বিরোধীদের কাউকে ছয় মাস পরে এ কথা বলতে না হয়, ‘তখনই বলছিলাম মাইরি—।’
শান্তিপূর্ণ উপায়ে ক্ষমতা পরিবর্তনের ব্যবস্থার নাম গণতন্ত্র। গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় গুণ এটি। তা ছাড়া গণতন্ত্র হলো জনগণের কল্যাণমূলক কাজে প্রতিযোগিতার ব্যাপার—প্রতিহিংসার নয়। বাঙালির গণতন্ত্রে প্রতিযোগিতার চেয়ে প্রতিহিংসা বেশি। ভালো গণতন্ত্রের শিক্ষা হলো, বিজয়ীরা পরাজিতের সঙ্গে পরামর্শ করে দেশের ও সাধারণ মানুষের স্বার্থে কাজ করবেন। বড়লোকদের ভোটে নয়, সাধারণ মানুষের ভোটেই সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে বিজয়ীরা ক্ষমতা পান। সুতরাং, সাধারণ মানুষের স্বার্থরক্ষাই তাঁদের নৈতিক দায়িত্ব। কিন্তু সেই দায়িত্ব মন্দ-গণতন্ত্রের নেতারা পালন করেন না।
পৌনে এক শতাব্দী আগে বঙ্গীয় সমাজে গণতন্ত্রের সূচনা হয়েছে। এর মধ্যে পুবে ও পশ্চিমে যতবারই জনগণের ভাগ্য পরিবর্তনের সুযোগ এসেছে, ততবারই তা নস্যাৎ হয়ে গেছে একশ্রেণীর মানুষের অসংযম ও আতিশয্যে। বাঙালির আনন্দ প্রকাশের নাম উন্মত্ততা, তার বিজয়োল্লাস পরিণত হয় কার্নিভালে। প্রতিপক্ষকে জব্দ ও জখম করায় তার সীমাহীন আনন্দ। পুবের মানুষ শিক্ষা পেয়েছে ১৯৯৬, ২০০১ এবং ২০০৮-এ। পশ্চিমের ভাইবোনদের পালা এবার ২০১১-তে। লক্ষণটা যেন একই রকম মনে হচ্ছে। বাঙালির জয় হোক।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
প্রত্যাশিত কোনো কিছু না পেলে বাঙালি যে তার অসন্তুষ্টি ঘরের মধ্যে বসে বসে তার বউ বা স্বামী বা শাশুড়ির কাছে প্রকাশ করবে, তা নয়। তার অসন্তোষ প্রকাশের জায়গা অনেক। পান-সিগারেটের দোকানে দাঁড়িয়ে পান চিবোতে চিবোতে অথবা সিগারেটে আগুন ধরাতে গিয়ে তার মনের আগুন জ্বলে ওঠে। মুদি দোকানে তেল-নুন কিনতে গিয়ে দশ কথা না বললে নয়। ফুটপাতে চেনা-অচেনা কাউকে পেলেই হয়। মুখ খুলে যায়। বাসের মধ্যে চুপ করে বসে থাকার পাত্র বাঙালি নয়। সেখানে অসন্তোষ প্রকাশের জন্য মানুষের অভাব হয় না। তবে হাত-পা ছুড়ে অসন্তোষ প্রকাশের সবচেয়ে উপযুক্ত স্থান অফিস। বেতনটার জন্য কয়েক ঘণ্টা যখন বাধ্য হয়ে ওখানে থাকতেই হয়, সুতরাং তা উশুল করে কারও ওপর মনের ঝাল মিটিয়ে।
ভোটাভুটি করে কাউকে ক্ষমতায় বসাক অথবা ওসব ঝামেলায় না গিয়ে কেউ নিজেই যদি লাফ দিয়ে ক্ষমতার মগডালে গিয়ে বসে পড়ে—তার জন্য শুধু তিন-উল্লাস নয়, তিন লাফ দিতে বাঙালির প্রবল উৎসাহ। মুসলিম লীগকে কুপোকাত করে যুক্তফ্রন্ট বিজয়ী হলে আনন্দের বন্যা বয়ে গেল দুই বাংলায়। মওলানা ভাসানীকে কাঁধে করে নিয়ে কর্মীরা আরমানিটোলা মাঠে জনসভায় যায়। চার বছর পর গণতন্ত্রের কবর খনন করে আইয়ুব খান ক্ষমতা দখল করলে বাংলার আবালবৃদ্ধবুদ্ধিজীবীর সে কী প্রশংসা—মৌখিক ও লিখিতভাবে। চট্টগ্রাম থেকে পেশোয়ার পর্যন্ত ট্রেনে প্রমোদভ্রমণ। তারপর সফরনামা রচনা।
বাঙালি বাঙালিই—তা তারা বঙ্গের পুব দিকেই থাকুক আর পশ্চিম দিকেই থাকুক।
সিদ্ধার্থ শঙ্করের প্রায়-ফ্যাসিবাদী সরকারকে হটিয়ে যেদিন জ্যোতি বসু ক্ষমতায় আসেন, সেদিন বাঙালির সে কী উল্লাস! জ্যোতি বসু যখন মৃত্যুশয্যায়, তখন আমি কলকাতায় গিয়েছিলাম। দিন দশেক ডাক্তাররা তাঁকে কোনো রকমে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন। ওই মুহূর্তটিতে শত্রু-মিত্র সবার সহানুভূতি একজনের প্রাপ্য। কিন্তু জ্যোতিবাবু সম্পর্কে এমন সব জঘন্য কথা সেখানকার বাংলা-ইংরেজি কাগজে লেখা হচ্ছিল, যা কোনোভাবে তাঁর চোখে পড়লে বেদনার তীব্র আঘাতে তিনি বেঁচে উঠতেন।
জ্যোতিবাবুর মনোনীত উত্তরাধিকারী হিসেবে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য যখন মুখ্যমন্ত্রী হন, ডান-বাম কাগজগুলো তাঁকে লেনিন, মাও ও চৌ এন লাইয়ের চেয়ে কিঞ্চিৎ যোগ্য হিসেবে বিবেচনা করে। পৃথিবীর সমাজতন্ত্র ও অ-সমাজতন্ত্র—দুটোর ভবিষ্যৎ তাঁরই হাতে। বসু ও ভট্টাচার্য এক রকম নেতা নন। তখন আমি বলেছিলাম, মার্ক্সের কবর হয়েছে লন্ডনে, তাঁর কুলখানিটা কলকাতায় সম্পন্ন হবে ভট্টাচার্যের হাতে। বন্ধুরা বিশ্বাস করেননি।
সুবিধাবাদী বুদ্ধিজীবীসহ সাধারণ মানুষের ইচ্ছায় কলকাতায় ক্ষমতার পালাবদল ঘটেছে। আনন্দের বন্যা বইছে সেখানে। এপারের নেতা থেকে সংবাদকর্মীরাও তাতে শরিক। আনন্দ প্রকাশের ধরনটা বাঙালিসুলভ। পুব-পশ্চিম দুই দিকেই প্রতিক্রিয়া প্রকাশের ধরনটাও একেবারেই বাঙালির মতো। বুদ্ধদেব ও বামরা তাঁদের কর্মফল ভোগ করবেন। কিন্তু বাম-বিরোধীদের কাউকে ছয় মাস পরে এ কথা বলতে না হয়, ‘তখনই বলছিলাম মাইরি—।’
শান্তিপূর্ণ উপায়ে ক্ষমতা পরিবর্তনের ব্যবস্থার নাম গণতন্ত্র। গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় গুণ এটি। তা ছাড়া গণতন্ত্র হলো জনগণের কল্যাণমূলক কাজে প্রতিযোগিতার ব্যাপার—প্রতিহিংসার নয়। বাঙালির গণতন্ত্রে প্রতিযোগিতার চেয়ে প্রতিহিংসা বেশি। ভালো গণতন্ত্রের শিক্ষা হলো, বিজয়ীরা পরাজিতের সঙ্গে পরামর্শ করে দেশের ও সাধারণ মানুষের স্বার্থে কাজ করবেন। বড়লোকদের ভোটে নয়, সাধারণ মানুষের ভোটেই সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে বিজয়ীরা ক্ষমতা পান। সুতরাং, সাধারণ মানুষের স্বার্থরক্ষাই তাঁদের নৈতিক দায়িত্ব। কিন্তু সেই দায়িত্ব মন্দ-গণতন্ত্রের নেতারা পালন করেন না।
পৌনে এক শতাব্দী আগে বঙ্গীয় সমাজে গণতন্ত্রের সূচনা হয়েছে। এর মধ্যে পুবে ও পশ্চিমে যতবারই জনগণের ভাগ্য পরিবর্তনের সুযোগ এসেছে, ততবারই তা নস্যাৎ হয়ে গেছে একশ্রেণীর মানুষের অসংযম ও আতিশয্যে। বাঙালির আনন্দ প্রকাশের নাম উন্মত্ততা, তার বিজয়োল্লাস পরিণত হয় কার্নিভালে। প্রতিপক্ষকে জব্দ ও জখম করায় তার সীমাহীন আনন্দ। পুবের মানুষ শিক্ষা পেয়েছে ১৯৯৬, ২০০১ এবং ২০০৮-এ। পশ্চিমের ভাইবোনদের পালা এবার ২০১১-তে। লক্ষণটা যেন একই রকম মনে হচ্ছে। বাঙালির জয় হোক।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
No comments