বিশেষ সাক্ষাৎকার-বার-বেঞ্চের ভাষা হতে হবে বিনম্র by জয়নুল আবেদীন
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নতুন নির্বাচনে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের মনোনয়নে যথাক্রমে জয়নুল আবেদীন সভাপতি এবং মো. মমতাজ উদ্দিন আহমেদ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছেন। ৮ এপ্রিল আনুষ্ঠানিকভাবে তাঁরা দায়িত্ব নেবেন।
আগামী এক বছর বিচার বিভাগকে ঘিরে তাঁদের সম্ভাব্য ভূমিকা কী হবে, সে বিষয়ে তাঁরা অভিমত দিয়েছেন।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মিজানুর রহমান খান
প্রথম আলো বার নির্বাচন বা এর কার্যক্রম অনেকটাই জনগুরুত্ব হারিয়েছে বলে অনেকের ধারণা। আপনার মন্তব্য কি?
জয়নুল আবেদীন আমি তা মনে করি না। তবে বিগত নির্বাচনগুলোর চেয়ে এবারের নির্বাচন একটু স্বতন্ত্র। এবার আইনের একটি সংশোধনী এসেছে। আগে ছিল এক ব্যক্তি এক জায়গায় ভোটার হবেন। আর এখন এক ব্যক্তি বহু জায়গায় ভোটার হতে পারবেন। এবারে তাই ভোটারসংখ্যা দ্বিগুণ ছিল।
প্রথম আলো বারের নবনির্বাচিত সম্পাদক বলেছেন, এটা আগে থেকেই চলে আসছিল। মওদুদ সাহেব যখন দেখলেন যে বারে ও বার কাউন্সিলে বিএনপি সুবিধা করতে পারছে না, তিনি তখন আইন সংশোধন করে ভোটাধিকার খর্ব করেন।
জয়নুল আবেদীন এটা যাঁরা করেছিলেন তাঁরা বলতে পারবেন। ভোটাধিকার খর্ব করা কখনো ঠিক নয়।
প্রথম আলো বিএনপি বিচার বিভাগে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের যে অভিযোগ করছে তার প্রতিকারে কি পদক্ষেপ নেবেন?
জয়নুল আবেদীন আমি আগেও বারের সম্পাদক ও সহ-সম্পাদক ছিলাম। ১৯৯৭ সালে এ রকমের অবস্থার মুখোমুখি হয়েছিলাম। ওই সময়েও বিচারপতিদের ওপর একটা রাজনৈতিক প্রভাব লক্ষ করা গেছে।
প্রথম আলো আওয়ামী লীগের বিগত আমলের বিচার বিভাগের সমস্যার চেয়ে এবারের সমস্যার ফারাক কী?
জয়নুল আবেদীন এবারের সমস্যা আরও প্রকট। প্রধান বিচারপতি হচ্ছেন বিচার বিভাগ ও সংবিধানের অভিভাবক। বারের সঙ্গে বিচারপতিদের যদি সুসম্পর্ক থাকে এবং প্রধান বিচারপতি যদি বারের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে দায়িত্ব পালন করেন—মোট কথা বার ও বেঞ্চ যদি একত্র থাকে, তাহলে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ থেকে বিচার বিভাগকে রক্ষা করা সম্ভব। সে জন্য আইনজীবীদের মধ্যে একটা সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক থাকতে হবে। বারের সমস্যা নিয়ে আলাপ-আলোচনা ও মতৈক্যে পৌঁছার ধারাবাহিকতা থাকতে হবে। প্রধান বিচারপতি যদি আন্তরিকভাবে এগিয়ে আসেন, তাহলে পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব।
প্রথম আলো কখনো প্রতীয়মান হয় যে কোনো কোনো বেঞ্চ থেকে বিশেষ আইনজীবীরা তুলনামূলক বেশি সুবিধা বা প্রতিকার পেয়ে থাকেন।
জয়নুল আবেদীন তাঁদের সংখ্যা বেশি নয়। এমনকি সরকারি দলের সুবিধাভোগী আইনজীবীর সংখ্যাও নগণ্য। বর্তমান অ্যাটর্নি জেনারেল বিচার বিভাগের ওপর যতটা ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পেরেছেন, অতীতের কোনো অ্যাটর্নি জেনারেল সেটা পারেননি।
প্রথম আলো আপনি কি দু-একটি ঘটনা নির্দিষ্ট করে বলবেন?
জয়নুল আবেদীন একজন আইনজীবীর দুঃখজনক মৃত্যু ঘটল। সেই ঘটনায় ১৩ জন আইনজীবী—যাঁরা উচ্চ আদালতে অহরহ জামিনের আবেদন করেন, তাঁদের বিষয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল যেভাবে ভূমিকা রেখেছেন—সেটা অভিনব ও অশ্রুতপূর্ব।
প্রথম আলো সংবিধান বলেছে, কোনো নাগরিককে কোনো অবস্থাতেই লাঞ্ছনাকর দণ্ড দেওয়া যাবে না। এর ব্যত্যয়ের বিরুদ্ধে বারের কার্যকরী ভূমিকা দেখা যায় না।
জয়নুল আবেদীন সংবিধানে বিচারপতিদের ক্ষমতা ও নাগরিকের অধিকার নির্দিষ্ট করে দেওয়া আছে। একটা গাড়ি যখন চলে তার অশ্বশক্তি অনেক দেওয়া থাকে। কিন্তু সেটার অহরহ প্রয়োগ কাম্য নয়। কাউকে দাঁড় করিয়ে রাখা বিচারপতির দায়িত্ব নয়। তাই বলছিলাম প্রধান বিচারপতির সঙ্গে আইনজীবীদের আলাপ-আলোচনার প্রক্রিয়া চলমান থাকতে হবে। কিন্তু সেটা অনুপস্থিত বলে মনে হয়। বিচারপতিদের মধ্যে রাজনৈতিক প্রভাব দূর করতে হবে সর্বাগ্রে। রাস্তার বক্তৃতাকে আদালতে টেনে আনার যে বিষয়, সেটা থেকে আদালতকে বাঁচাতে হবে। কোনো রাজনৈতিক নেতার বক্তব্য যদি আদালত তাঁর সুয়োমোটো ক্ষমতায় টেনে নেন, তখন জনগণের সঙ্গে আদালতের সংঘাত দেখা দেয়।
প্রথম আলো কিন্তু বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও পৃথক্করণ-সংক্রান্ত যেসব মৌলিক বিষয়, সেখানে দুই দলকে আমরা আলাদাভাবে চিনতে পারি না। উভয় দলের সমর্থক-আইনজীবীদের মধ্যে উত্তেজনা কিংবা বিরোধের যে বিষয়, তা ওই রাজনীতি থেকে উদ্ভূত। এ ব্যাপারে আপনি কী করবেন?
জয়নুল আবেদীন প্রত্যেক ব্যক্তির কর্মপন্থা ভিন্নতর। আগের কমিটির কর্মপন্থা ভিন্ন ছিল। আমারটা তাদের মতো নাও হতে পারে।
প্রথম আলো বিচারক নিয়োগ নিয়ে একটা কমিশন কিংবা নতুন আইন—কোনটা আপনার পছন্দ?
জয়নুল আবেদীন আমরা এখনো দায়িত্ব গ্রহণ করিনি। এ বিষয়ে আপনিও লিখেছেন। বর্তমান আইনমন্ত্রী যখন বারের সভাপতি ছিলেন, তাঁর সভাপতিত্বে বৈঠক হওয়ার পর প্রধান বিচারপতির সঙ্গে বৈঠক হয়েছিল, সেখানে বারের প্রস্তাবের ভিত্তিতে কতগুলো সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছিল। কিন্তু তা বাস্তবায়িত হয়নি। আইনমন্ত্রী হয়ে তিনি যা করেছেন তার যাতে পুনরাবৃত্তি না ঘটে, সে বিষয়ে আমাদের কিছু চেষ্টা থাকবে। বিচারক নিয়োগ-প্রক্রিয়ায় কোনো সুষুম নিয়ম-পদ্ধতি কোনো সরকারের আমলেই পালন করা হয়নি বলে আমার ব্যক্তিগত অভিমত।
প্রথম আলো গত সাড়ে তিন বছরের বিচারক নিয়োগ-প্রক্রিয়া নিয়ে কী বলবেন?
জয়নুল আবেদীন এ সময় তো সুষ্ঠু নিয়মকানুন অনুসরণ করা হয়নি। গত তিন-চার পর্বে দেওয়া নিয়োগ কী প্রক্রিয়ায় হয়েছে, তা কিন্তু এখনো সাধারণ আইনজীবীদের বোধগম্য নয়। আমি মনে করি, বিচারক নিয়োগে নির্দিষ্ট আইনকানুন থাকা দরকার।
প্রথম আলো কিন্তু বারের সম্পাদক তো বলছেন, গত সাড়ে তিন বছরে বিচারক নিয়োগ-প্রক্রিয়ায় আদৌ ত্রুটি ঘটেছে বলে তিনি মনে করেন না। তাহলে বারের নেতৃত্বে থেকে কী করে এ বিষয়ে সরব হবেন?
জয়নুল আবেদীন এ বিষয়ে সম্পাদক সাহেবের সহযোগিতা অবশ্যই দরকার আছে। তাঁর সঙ্গে এ বিষয়ে আমার এমন কোনো আলাপ-আলোচনা হয়নি। তবে দলীয় ভিত্তিতে নিয়োগ হতে পারে। কিন্তু আমরা তো এগুলো বাদ দিতে পারব না। কারও নিয়োগ বাতিলে সুপ্রিম কোর্ট বারের এখতিয়ারে নেই।
প্রথম আলো কিন্তু আওয়ামী লীগ-সমর্থিত বার জোট সরকারের আমলে নিয়োগ দেওয়া বিতর্কিত বিচারকদের বিরুদ্ধে রেজুলেশন নিয়েছিল। কিন্তু পরিহাস হলো, বিএনপির নিন্দায় তাঁরা এখন মুখর থাকলেও ওই রেজুলেশনের কথা বেমালুম ভুলে গেছেন। সুতরাং আপনাদের মধ্যে তফাতটা আসলে কোথায়?
জয়নুল আবেদীন আমি রেজুলেশন নেব কিন্তু তা বাস্তবায়ন করতে পারব না—সেদিকে আমরা যেতে চাইছি না। আমি বারের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রথম কাজ হচ্ছে, কার্যকর কমিটির সব নির্বাচিত সদস্যের সঙ্গে বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে পর্যায়ক্রমে আলোচনা করা। তার মধ্যে বার-বেঞ্চের সম্পর্ক উন্নয়নসহ এ বিষয়টিও থাকতে পারে।
প্রথম আলো আপিল বিভাগ বলেছেন, নিম্ন আদালতের বিচারকদের কর্মস্থলে তিন বছর থাকা তাঁদের বিচারিক স্বাধীনতার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। কিন্তু অহরহ এর লঙ্ঘন ঘটলেও বার নীরব।
জয়নুল আবেদীন লক্ষ করবেন, দেশের বিচার বিভাগকে দুর্বল করার জন্য কোনো না কোনো জায়গা থেকে কেউ সক্রিয় রয়েছে। কোথা থেকে কে কলকাঠি নাড়াচ্ছে—এটা আগে চিহ্নিত করুন। গণতন্ত্র রক্ষার পূর্বশর্ত হচ্ছে শক্তিশালী ও স্বাধীন বিচার বিভাগ। আমাদের দায়িত্ব হলো, যেখান থেকে যা-ই হোক না কেন, বার ও বেঞ্চের মধ্যে সুসম্পর্ক স্থাপন করে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ থেকে বিচার বিভাগকে রক্ষা করা।
প্রথম আলো আপনারা সুপ্রিম কোর্ট অঙ্গনে দলের স্বার্থে ছাতি ধরেন। আন্দোলন করেন। কিন্তু তা কখনো মাসদার হোসেন মামলার রায় বাস্তবায়ন না করা বা তা পদ্ধতিগতভাবে লঙ্ঘন করার প্রতিবাদে নয়।
জয়নুল আবেদীন দূরদর্শিতার সংকটের সঙ্গে হয়তো এর যোগসূত্র থাকবে। তবে সুপ্রিম কোর্ট বারের একটা সীমাবদ্ধতা রয়েছে। আমরা বাইরের রাজনীতি বা বিষয়কে সুপ্রিম কোর্টে আনতে পারব না।
প্রথম আলো ১১৬ অনুচ্ছেদকে বাহাত্তরের সংবিধানের মতো প্রতিস্থাপন, বিচারকদের বদলি ও কর্মস্থল নির্ধারণ সংবিধান অনুযায়ী ফুল কোর্টের, জিএ কমিটির এবং ব্যাপক অর্থে বার ও বেঞ্চের, সেখানে কী করে এসব বিষয় বাইরের বলে গণ্য হতে পারে?
জয়নুল আবেদীন কিন্তু এখানে সরকারি প্রশাসনই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমরা সরকারি যন্ত্রসংশ্লিষ্ট নই। আমরা আইনজীবীদের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধি।
প্রথম আলো সভাপতি হিসেবে আপনার এই মুহূর্তের বড় উদ্বেগ ও করণীয় কী হবে?
জয়নুল আবেদীন ভাষার বিনম্র ব্যবহারে একটা ব্যত্যয় ঘটেছে। বিচারক ও আইনজীবীদের ভাষা অবশ্যই বিচক্ষণ হতে হবে। আমরা এটা অবশ্যই নিশ্চিত করতে সচেষ্ট হব ইনশা আল্লাহ। আমি ও আমার সম্পাদক দুজনেই একমত যে, দলীয় রাজনীতিকে সুপ্রিম কোর্ট অঙ্গনে টেনে আনার চেষ্টা প্রতিহত করতে হবে।
প্রথম আলো খুব আশাব্যঞ্জক অঙ্গীকার। তাহলে সুপ্রিম কোর্ট অঙ্গনে মিছিল ও বিক্ষোভ নিষিদ্ধ করে লেখা বিচারপতি আবদুল মতিনের রায়টি কার্যকর করুন।
জয়নুল আবেদীন সেটা পুরোপুরি না পারলেও এটা বলব, আন্দোলন ভিন্ন বিষয়। যখন বিচারিক যন্ত্রের কিছু বিকল করা হবে তখন আন্দোলনের বিকল্প নেই। তবে তা রাজনৈতিক নয়, তাও হতে হবে জুডিশিয়াস বা সুবিবেচনাপ্রসূত।
প্রথম আলো আপনাকে ধন্যবাদ।
জয়নুল আবেদীন আপনাকেও ধন্যবাদ।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মিজানুর রহমান খান
প্রথম আলো বার নির্বাচন বা এর কার্যক্রম অনেকটাই জনগুরুত্ব হারিয়েছে বলে অনেকের ধারণা। আপনার মন্তব্য কি?
জয়নুল আবেদীন আমি তা মনে করি না। তবে বিগত নির্বাচনগুলোর চেয়ে এবারের নির্বাচন একটু স্বতন্ত্র। এবার আইনের একটি সংশোধনী এসেছে। আগে ছিল এক ব্যক্তি এক জায়গায় ভোটার হবেন। আর এখন এক ব্যক্তি বহু জায়গায় ভোটার হতে পারবেন। এবারে তাই ভোটারসংখ্যা দ্বিগুণ ছিল।
প্রথম আলো বারের নবনির্বাচিত সম্পাদক বলেছেন, এটা আগে থেকেই চলে আসছিল। মওদুদ সাহেব যখন দেখলেন যে বারে ও বার কাউন্সিলে বিএনপি সুবিধা করতে পারছে না, তিনি তখন আইন সংশোধন করে ভোটাধিকার খর্ব করেন।
জয়নুল আবেদীন এটা যাঁরা করেছিলেন তাঁরা বলতে পারবেন। ভোটাধিকার খর্ব করা কখনো ঠিক নয়।
প্রথম আলো বিএনপি বিচার বিভাগে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের যে অভিযোগ করছে তার প্রতিকারে কি পদক্ষেপ নেবেন?
জয়নুল আবেদীন আমি আগেও বারের সম্পাদক ও সহ-সম্পাদক ছিলাম। ১৯৯৭ সালে এ রকমের অবস্থার মুখোমুখি হয়েছিলাম। ওই সময়েও বিচারপতিদের ওপর একটা রাজনৈতিক প্রভাব লক্ষ করা গেছে।
প্রথম আলো আওয়ামী লীগের বিগত আমলের বিচার বিভাগের সমস্যার চেয়ে এবারের সমস্যার ফারাক কী?
জয়নুল আবেদীন এবারের সমস্যা আরও প্রকট। প্রধান বিচারপতি হচ্ছেন বিচার বিভাগ ও সংবিধানের অভিভাবক। বারের সঙ্গে বিচারপতিদের যদি সুসম্পর্ক থাকে এবং প্রধান বিচারপতি যদি বারের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে দায়িত্ব পালন করেন—মোট কথা বার ও বেঞ্চ যদি একত্র থাকে, তাহলে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ থেকে বিচার বিভাগকে রক্ষা করা সম্ভব। সে জন্য আইনজীবীদের মধ্যে একটা সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক থাকতে হবে। বারের সমস্যা নিয়ে আলাপ-আলোচনা ও মতৈক্যে পৌঁছার ধারাবাহিকতা থাকতে হবে। প্রধান বিচারপতি যদি আন্তরিকভাবে এগিয়ে আসেন, তাহলে পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব।
প্রথম আলো কখনো প্রতীয়মান হয় যে কোনো কোনো বেঞ্চ থেকে বিশেষ আইনজীবীরা তুলনামূলক বেশি সুবিধা বা প্রতিকার পেয়ে থাকেন।
জয়নুল আবেদীন তাঁদের সংখ্যা বেশি নয়। এমনকি সরকারি দলের সুবিধাভোগী আইনজীবীর সংখ্যাও নগণ্য। বর্তমান অ্যাটর্নি জেনারেল বিচার বিভাগের ওপর যতটা ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পেরেছেন, অতীতের কোনো অ্যাটর্নি জেনারেল সেটা পারেননি।
প্রথম আলো আপনি কি দু-একটি ঘটনা নির্দিষ্ট করে বলবেন?
জয়নুল আবেদীন একজন আইনজীবীর দুঃখজনক মৃত্যু ঘটল। সেই ঘটনায় ১৩ জন আইনজীবী—যাঁরা উচ্চ আদালতে অহরহ জামিনের আবেদন করেন, তাঁদের বিষয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল যেভাবে ভূমিকা রেখেছেন—সেটা অভিনব ও অশ্রুতপূর্ব।
প্রথম আলো সংবিধান বলেছে, কোনো নাগরিককে কোনো অবস্থাতেই লাঞ্ছনাকর দণ্ড দেওয়া যাবে না। এর ব্যত্যয়ের বিরুদ্ধে বারের কার্যকরী ভূমিকা দেখা যায় না।
জয়নুল আবেদীন সংবিধানে বিচারপতিদের ক্ষমতা ও নাগরিকের অধিকার নির্দিষ্ট করে দেওয়া আছে। একটা গাড়ি যখন চলে তার অশ্বশক্তি অনেক দেওয়া থাকে। কিন্তু সেটার অহরহ প্রয়োগ কাম্য নয়। কাউকে দাঁড় করিয়ে রাখা বিচারপতির দায়িত্ব নয়। তাই বলছিলাম প্রধান বিচারপতির সঙ্গে আইনজীবীদের আলাপ-আলোচনার প্রক্রিয়া চলমান থাকতে হবে। কিন্তু সেটা অনুপস্থিত বলে মনে হয়। বিচারপতিদের মধ্যে রাজনৈতিক প্রভাব দূর করতে হবে সর্বাগ্রে। রাস্তার বক্তৃতাকে আদালতে টেনে আনার যে বিষয়, সেটা থেকে আদালতকে বাঁচাতে হবে। কোনো রাজনৈতিক নেতার বক্তব্য যদি আদালত তাঁর সুয়োমোটো ক্ষমতায় টেনে নেন, তখন জনগণের সঙ্গে আদালতের সংঘাত দেখা দেয়।
প্রথম আলো কিন্তু বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও পৃথক্করণ-সংক্রান্ত যেসব মৌলিক বিষয়, সেখানে দুই দলকে আমরা আলাদাভাবে চিনতে পারি না। উভয় দলের সমর্থক-আইনজীবীদের মধ্যে উত্তেজনা কিংবা বিরোধের যে বিষয়, তা ওই রাজনীতি থেকে উদ্ভূত। এ ব্যাপারে আপনি কী করবেন?
জয়নুল আবেদীন প্রত্যেক ব্যক্তির কর্মপন্থা ভিন্নতর। আগের কমিটির কর্মপন্থা ভিন্ন ছিল। আমারটা তাদের মতো নাও হতে পারে।
প্রথম আলো বিচারক নিয়োগ নিয়ে একটা কমিশন কিংবা নতুন আইন—কোনটা আপনার পছন্দ?
জয়নুল আবেদীন আমরা এখনো দায়িত্ব গ্রহণ করিনি। এ বিষয়ে আপনিও লিখেছেন। বর্তমান আইনমন্ত্রী যখন বারের সভাপতি ছিলেন, তাঁর সভাপতিত্বে বৈঠক হওয়ার পর প্রধান বিচারপতির সঙ্গে বৈঠক হয়েছিল, সেখানে বারের প্রস্তাবের ভিত্তিতে কতগুলো সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছিল। কিন্তু তা বাস্তবায়িত হয়নি। আইনমন্ত্রী হয়ে তিনি যা করেছেন তার যাতে পুনরাবৃত্তি না ঘটে, সে বিষয়ে আমাদের কিছু চেষ্টা থাকবে। বিচারক নিয়োগ-প্রক্রিয়ায় কোনো সুষুম নিয়ম-পদ্ধতি কোনো সরকারের আমলেই পালন করা হয়নি বলে আমার ব্যক্তিগত অভিমত।
প্রথম আলো গত সাড়ে তিন বছরের বিচারক নিয়োগ-প্রক্রিয়া নিয়ে কী বলবেন?
জয়নুল আবেদীন এ সময় তো সুষ্ঠু নিয়মকানুন অনুসরণ করা হয়নি। গত তিন-চার পর্বে দেওয়া নিয়োগ কী প্রক্রিয়ায় হয়েছে, তা কিন্তু এখনো সাধারণ আইনজীবীদের বোধগম্য নয়। আমি মনে করি, বিচারক নিয়োগে নির্দিষ্ট আইনকানুন থাকা দরকার।
প্রথম আলো কিন্তু বারের সম্পাদক তো বলছেন, গত সাড়ে তিন বছরে বিচারক নিয়োগ-প্রক্রিয়ায় আদৌ ত্রুটি ঘটেছে বলে তিনি মনে করেন না। তাহলে বারের নেতৃত্বে থেকে কী করে এ বিষয়ে সরব হবেন?
জয়নুল আবেদীন এ বিষয়ে সম্পাদক সাহেবের সহযোগিতা অবশ্যই দরকার আছে। তাঁর সঙ্গে এ বিষয়ে আমার এমন কোনো আলাপ-আলোচনা হয়নি। তবে দলীয় ভিত্তিতে নিয়োগ হতে পারে। কিন্তু আমরা তো এগুলো বাদ দিতে পারব না। কারও নিয়োগ বাতিলে সুপ্রিম কোর্ট বারের এখতিয়ারে নেই।
প্রথম আলো কিন্তু আওয়ামী লীগ-সমর্থিত বার জোট সরকারের আমলে নিয়োগ দেওয়া বিতর্কিত বিচারকদের বিরুদ্ধে রেজুলেশন নিয়েছিল। কিন্তু পরিহাস হলো, বিএনপির নিন্দায় তাঁরা এখন মুখর থাকলেও ওই রেজুলেশনের কথা বেমালুম ভুলে গেছেন। সুতরাং আপনাদের মধ্যে তফাতটা আসলে কোথায়?
জয়নুল আবেদীন আমি রেজুলেশন নেব কিন্তু তা বাস্তবায়ন করতে পারব না—সেদিকে আমরা যেতে চাইছি না। আমি বারের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রথম কাজ হচ্ছে, কার্যকর কমিটির সব নির্বাচিত সদস্যের সঙ্গে বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে পর্যায়ক্রমে আলোচনা করা। তার মধ্যে বার-বেঞ্চের সম্পর্ক উন্নয়নসহ এ বিষয়টিও থাকতে পারে।
প্রথম আলো আপিল বিভাগ বলেছেন, নিম্ন আদালতের বিচারকদের কর্মস্থলে তিন বছর থাকা তাঁদের বিচারিক স্বাধীনতার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। কিন্তু অহরহ এর লঙ্ঘন ঘটলেও বার নীরব।
জয়নুল আবেদীন লক্ষ করবেন, দেশের বিচার বিভাগকে দুর্বল করার জন্য কোনো না কোনো জায়গা থেকে কেউ সক্রিয় রয়েছে। কোথা থেকে কে কলকাঠি নাড়াচ্ছে—এটা আগে চিহ্নিত করুন। গণতন্ত্র রক্ষার পূর্বশর্ত হচ্ছে শক্তিশালী ও স্বাধীন বিচার বিভাগ। আমাদের দায়িত্ব হলো, যেখান থেকে যা-ই হোক না কেন, বার ও বেঞ্চের মধ্যে সুসম্পর্ক স্থাপন করে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ থেকে বিচার বিভাগকে রক্ষা করা।
প্রথম আলো আপনারা সুপ্রিম কোর্ট অঙ্গনে দলের স্বার্থে ছাতি ধরেন। আন্দোলন করেন। কিন্তু তা কখনো মাসদার হোসেন মামলার রায় বাস্তবায়ন না করা বা তা পদ্ধতিগতভাবে লঙ্ঘন করার প্রতিবাদে নয়।
জয়নুল আবেদীন দূরদর্শিতার সংকটের সঙ্গে হয়তো এর যোগসূত্র থাকবে। তবে সুপ্রিম কোর্ট বারের একটা সীমাবদ্ধতা রয়েছে। আমরা বাইরের রাজনীতি বা বিষয়কে সুপ্রিম কোর্টে আনতে পারব না।
প্রথম আলো ১১৬ অনুচ্ছেদকে বাহাত্তরের সংবিধানের মতো প্রতিস্থাপন, বিচারকদের বদলি ও কর্মস্থল নির্ধারণ সংবিধান অনুযায়ী ফুল কোর্টের, জিএ কমিটির এবং ব্যাপক অর্থে বার ও বেঞ্চের, সেখানে কী করে এসব বিষয় বাইরের বলে গণ্য হতে পারে?
জয়নুল আবেদীন কিন্তু এখানে সরকারি প্রশাসনই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমরা সরকারি যন্ত্রসংশ্লিষ্ট নই। আমরা আইনজীবীদের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধি।
প্রথম আলো সভাপতি হিসেবে আপনার এই মুহূর্তের বড় উদ্বেগ ও করণীয় কী হবে?
জয়নুল আবেদীন ভাষার বিনম্র ব্যবহারে একটা ব্যত্যয় ঘটেছে। বিচারক ও আইনজীবীদের ভাষা অবশ্যই বিচক্ষণ হতে হবে। আমরা এটা অবশ্যই নিশ্চিত করতে সচেষ্ট হব ইনশা আল্লাহ। আমি ও আমার সম্পাদক দুজনেই একমত যে, দলীয় রাজনীতিকে সুপ্রিম কোর্ট অঙ্গনে টেনে আনার চেষ্টা প্রতিহত করতে হবে।
প্রথম আলো খুব আশাব্যঞ্জক অঙ্গীকার। তাহলে সুপ্রিম কোর্ট অঙ্গনে মিছিল ও বিক্ষোভ নিষিদ্ধ করে লেখা বিচারপতি আবদুল মতিনের রায়টি কার্যকর করুন।
জয়নুল আবেদীন সেটা পুরোপুরি না পারলেও এটা বলব, আন্দোলন ভিন্ন বিষয়। যখন বিচারিক যন্ত্রের কিছু বিকল করা হবে তখন আন্দোলনের বিকল্প নেই। তবে তা রাজনৈতিক নয়, তাও হতে হবে জুডিশিয়াস বা সুবিবেচনাপ্রসূত।
প্রথম আলো আপনাকে ধন্যবাদ।
জয়নুল আবেদীন আপনাকেও ধন্যবাদ।
No comments