বিদ্যুৎ : লোডশেডিং ও মূল্যবৃদ্ধি by ড. এম শামসুল আলম
দেশের জ্বালানি ও বিদ্যুৎ পরিস্থিতি নিয়ে জনগণের উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা কমেনি। জ্বালানি উপদেষ্টা ২২ মার্চ এক মতবিনিময় সভায় বলেছেন, 'বর্তমান সরকারের আমলে বিদ্যুৎ খাতে যত কাজ হয়েছে ও হচ্ছে, অতীতে কখনোই তা হয়নি। এ সময়ের মধ্যে ২১ লাখ নতুন বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হয়েছে।
এসব কথা গণমাধ্যমকর্মীদের বোঝানো যায় না।' কেন বোঝানো যায় না? কেন মানুষের উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা কমে না? অতীতে বিভিন্ন সরকারের আমলে বিদ্যুৎ সমস্যা নিয়ে বিভিন্নভাবে কথা ও কাজ কম হয়নি। সেসব কথা ও কাজের কোনো সমাধান আসেনি। বরং বিরূপ সমালোচনার জন্ম হয়েছে। জ্বালানি উপদেষ্টার মতে, বর্তমান সরকারের কথা ও কাজে সে বিদ্যুৎ সমস্যার যদি সমাধান হয় এবং সরকার সফল হয়, তাহলে সে সম্পর্কে জনগণকে জানাতে মিডিয়ার কার্পণ্য করার কথা নয়। অথচ উপদেষ্টার মতে, মিডিয়া কার্পণ্য করছে। এই প্রেক্ষাপট নিয়েই আজকের লেখা।
২. গত ১৮ মার্চ জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে প্রতি একক বিদ্যুতের ০.৪১ টাকা পাইকারি মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাবের ওপর গণশুনানি হয়। বর্তমানে বিদ্যুতের পাইকারি মূল্য ৩.৭৪ টাকা। এর সঙ্গে ভর্তুকির অর্থ পাঁচ হাজার কোটি টাকা যোগ হলে আর ঘাটতি থাকে না। গত বছর এ বিদ্যুতের প্রকৃত ব্যয় ছিল ৪.৮ টাকা। প্রস্তাবে বলা হয়েছে, তেলের মূল্য ও ব্যবহার উভয় বৃদ্ধির কারণে তা দাঁড়িয়েছে ৬.১৬ টাকায়। মার্চ-জুন পর্যন্ত উৎপাদন ব্যয়ের সঙ্গে সমন্বয় করা হলে তা হয় ৬.৬৮ টাকা। পাইকারি মূল্য ৩.৭৪ টাকা বিদ্যমান থাকায় ঘাটতি আরো বেড়েছে।
৩. লিটারপ্রতি পাঁচ টাকা মূল্যবৃদ্ধির কারণে ৯.৬ লাখ টন তরল জ্বালানির বর্ধিত ব্যয় চার মাসের (মার্চ-জুন '১২) উৎপাদিত বিদ্যুতের ওপর সমন্বয় করা হলে এই জ্বালানি মূল্যবৃদ্ধির জন্য প্রতি একক বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি হবে ০.৪১ টাকা। যদি সে জ্বালানির পরিমাণ ৪.৬৮ লাখ টন হয়, তাহলে বৃদ্ধি হবে ০.২২ টাকা। চার মাসের স্থলে ছয় মাসের উৎপাদিত বিদ্যুতের ওপর সমন্বয় করা হলে বৃদ্ধি হবে ০.১৯ টাকা। কিন্তু হিসাবে একদিকে জ্বালানি বরাদ্দের পরিবর্তে চাহিদা ধরা হয়েছে এবং অন্যদিকে ছয় মাসের জ্বালানি খরচের বাড়তি ব্যয় ছয় মাসের স্থলে চার মাসের উৎপাদিত বিদ্যুতের ওপর সমন্বয় করা হয়েছে। এ উভয় কারণে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাবটি যৌক্তিক ও ন্যায়সংগত হয়নি। ২৯ মার্চ ২০১২ বিআরসি এক আদেশে বিদ্যুতের পুনর্বার মূল্যবৃদ্ধি করেছে। এই বৃদ্ধির হার পাইকারি ১৮ পয়সা এবং ভোক্তা পর্যায়ে খুচরা ৩০ পয়সা।
৪. জানু-জুন ২০১২ লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী এই ছয় মাসে তেল_বিদ্যুৎ উৎপাদনে তরল জ্বালানি চাহিদা ধরা হয় ৯.৬ লাখ টন। ফার্নেস অয়েল ৮.০৫ লাখ টন এবং ডিজেল ১.৫৫ লাখ টন। অথচ বিপিসি বরাদ্দ দিয়েছে ৪.৬৮ লাখ টন (ফার্নেস অয়েল ৩.৯ লাখ টন এবং ডিজেল ৭৮ হাজার টন)। জানু-ফেব্রু ২০১২ এই দুই মাসে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যয় হয়েছে ফার্নেস অয়েল ১.৫২ লাখ টন এবং ডিজেল ৪২ হাজার টন।
৫. অতঃপর মার্চ-জুন এই চার মাসে চাহিদা ফার্নেস অয়েল ৬.৫৪ লাখ টন এবং ডিজেল ১.১৩ লাখ টন। অথচ এ সময়ের জন্য বরাদ্দ আছে ফার্নেস অয়েল ২.৪ লাখ টন এবং ডিজেল ৩৫ হাজার টন। মার্চ-জুন এ সময়ে মাসে গড়ে ৬৭০.৪৮ মিলিয়ন একক তেল-বিদ্যুৎ উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু তেলের স্বল্পতার কারণে উৎপাদন হবে ২৪১.৩৭ (৩৬ শতাংশ) মিলিয়ন একক, যা জানুয়ারি মাসে উৎপাদিত তেল-বিদ্যুতের (৫৮১ মিলিয়ন একক) ৪১.৫৪ শতাংশ।
৬. মার্চ-জুন এই চার মাসের জন্য উৎপাদিত গ্যাস-বিদ্যুতের পরিমাণ ধরা হয়েছে প্রায় ১০ হাজার মিলিয়ন একক। এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে যে পরিমাণ গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত হতে হবে, স্বল্পতার কারণে সে পরিমাণ গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করা সম্ভব না হওয়ায় ওই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব হবে না, ২০ শতাংশ কম উৎপাদন হবে। লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী গ্যাস-বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাসের দৈনিক চাহিদা প্রায় ১০০ কোটি ঘনফুট। কোনোভাবেই ৮০ কোটি ঘনফুটের বেশি দেওয়া যাচ্ছে না। লোডশেডিং মোকাবিলার জন্য সাময়িক ব্যবস্থা হিসেবে জরুরি বিবেচনায় সার কারখানার উৎপাদন বন্ধ রেখে বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাস দেওয়া হচ্ছে।
৭. তথ্যাদিতে দেখা যায়, এ বছর গরমে বিদ্যুতের সর্বোচ্চ চাহিদা হতে পারে ৭.৫ হাজার মেগাওয়াট। জ্বালানি স্বল্পতার কারণে হয়তো ছয় হাজার মেগাওয়াটও উৎপাদন হবে না। অথচ উৎপাদন ক্ষমতা ৮.৩ হাজার মেগাওয়াট ছাড়িয়ে যেতে পারে। সে জন্য ঘাটতি হতে পারে ১.৫ হাজার মেগাওয়াটেরও বেশি। কলকারখানাসহ অন্যান্য গ্রাহককে নতুন সংযোগ দেওয়ার ফলে চাহিদা বাড়তে পারে আরো এক হাজার মেগাওয়াট। আবাসিক গ্রাহকদের নতুন সংযোগ দেওয়া অব্যাহত রাখার পাশাপাশি প্রায় ১৯ হাজার নতুন সংযোগ দেওয়া হচ্ছে শিল্পপ্রতিষ্ঠানে। তাতে চাহিদা বৃদ্ধি হতে পারে ১.৪ হাজার মেগাওয়াট। জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত না করে অপরিকল্পিত বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি হওয়ায় সেই অনুপাতে বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়নি।
৮. শুনানিতে বলা হয়, ভর্তুকির পরিবর্তে ঘাটতি মোকাবিলায় পিডিবি ৩ শতাংশ সুদে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে লোন পায়। ফলে গত বছর এ লোনের জন্য পিডিবি সুদ পরিশোধ করেছে ১২৬ কোটি টাকা। শুনানিতে প্রকাশ পায়, বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি সহনীয় পর্যায়ে রাখার জন্য বিইআরসির প্রস্তাবের আলোকে পাঁচ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি প্রদানে প্রধানমন্ত্রী প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হন। অথচ এ ভর্তুকি প্রদান করা হয়নি। বরং বিদ্যুৎ খাতকে লোনগ্রস্ত করায় উল্টো সুদ দিতে হয়েছে ১২৬ কোটি টাকা। এ অবস্থা বিদ্যুৎ খাতকে অরো নাজুক পরিস্থিতিতে ফেলেছে বিধায় পিডিবি বলেছে, 'ঘাটতি মোকাবিলায় হয় ভর্তুকির নীতি অনুসরণ করা হোক, নয়তো মূল্যবৃদ্ধি করা হোক। যদি তা না হয়, তাহলে বিদ্যুৎ উৎপাদন কমিয়ে ব্যয় কমাতে হবে। এভাবে আর চলে না। ব্যক্তি খাত থেকে কেনা বিদ্যুতের বিল পরিশোধে শুধু লোনই হচ্ছে না, তাদের পেনশন-প্রভিডেন্ট ফান্ডও উজাড় হচ্ছে।' শুনানিতে জানা যায়, পাইকারি বিদ্যুতের সরবরাহ ব্যয় কমে হবে ২০১৬ সালে ৪.৫০ টাকা এবং ২০১৭ সালে ৪.০০ টাকা।
৯. গত এক বছরে চারবার বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে। সম্প্রতি আবারও আরেক দফা বৃদ্ধি পেয়েছে। এ বৃদ্ধি চলতি মার্চ মাসের বিদ্যুৎ বিলে কার্যকর হবে। সুতরাং অন্তর্বর্তীকালীন এ ঘাটতি বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির মাধ্যমে মোকাবিলা করা জনস্বার্থসম্মত নয়। কারণ অস্বাভাবিকভাবে ক্রমাগত বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি পাওয়ায় দ্রব্যমূল্যও অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে মুদ্রাস্ফীতি দ্রুত বাড়ছে। পরবর্তী সময়ে বিদ্যুতের মূল্য কমলেও দ্রব্যমূল্য কমবে না।
১০. গত জোট সরকারের আমলে গ্রামগঞ্জে হাজার হাজার মাইল লাইন নির্মাণ হয়েছে। তখন সে লাইনে বিদ্যুৎ আসেনি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে বহু বিদ্যুৎ প্লান্ট নির্মাণ করা হয়েছে। লাখ লাখ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা বেড়েছে। অথচ সেই তুলনায় বিদ্যুৎ উপাদন না হওয়ায় বিদ্যুৎ সংকট কাটেনি। মানুষ বিদ্যুৎ পায়নি। ফলে এ দুই সরকারই অপরিকল্পিত লাইন ও প্লান্ট নির্মাণের কারণে জনগণের বিরাগভাজন হয়েছে এবং বিভিন্নভাবে সমালোচনার শিকার হয়েছে। বর্তমান সরকারের আমলে বহু নতুন বিদ্যুৎ প্লান্ট নির্মাণ ও বহু নতুন বিদ্যুৎ সংযোগ অব্যাহত আছে। অথচ জ্বালানি স্বল্পতার কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন ভয়ানকভাবে ব্যাহত। এ পরিস্থিতির আশু উন্নতি না হলে বর্তমান সরকারও আগের দুই সরকারের অনুরূপ পরিণতির শিকার হতে পারে এমন আশঙ্কা জ্বালানি উপদেষ্টার মধ্যে মোটেও কাজ না করায় জ্বালানি ও বিদ্যুৎ পরিস্থিতি নিয়ে জনগণের উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা কমে না।
লেখক : জ্বালানি বিশেষজ্ঞ
No comments