‘এখান থেকে আর পিছিয়ে যাব না’
নেতৃত্ব পাওয়ার পর থেকেই একটার পর আরেকটা চ্যালেঞ্জ এসে দাঁড়াচ্ছে সামনে। তবে কোনোটাই বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি সেভাবে। বরং এশিয়া কাপের সাফল্য বাংলাদেশ অধিনায়ক মুশফিকুর রহিমকে দেখাচ্ছে নতুন স্বপ্ন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন তারেক মাহমুদ
অধিনায়কত্ব কেমন উপভোগ করছেন?
মুশফিকুর রহিম: এখন তো বেশ ভালোই...। অধিনায়ক হিসেবে অভিষেক হয়েছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে। এরপর পাকিস্তান সিরিজ, এশিয়া কাপ। তিনটা বড় আসর। দল হিসেবে মোটামুটি ভালোই খেলেছি আমরা। অধিনায়ক হিসেবে পুরোপুরি সন্তুষ্ট বলব না। তবে আমি খুশি।
অধিনায়কত্বের ভালো-মন্দ দিকগুলো কী কী?
মুশফিক: সবই তো ভালো! দায়িত্বটা অনেক বেড়ে যায়। শুধু মাঠে না, মাঠের বাইরেও অনেক দায়িত্ব থাকে। সবার খোঁজখবর রাখা। ভালো-মন্দ জানা। ব্যক্তিগতভাবে কথা বলা। অনুশীলনে সাহায্য করা। তবে সবচেয়ে বেশি তৃপ্তি পাওয়া যায় সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতে পারলে। পারফরম্যান্স করার তাগিদও অনেক বেশি থাকে।
অধিনায়ক হওয়ার পর কয়েকটা ম্যাচে ব্যাট হাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। ম্যাচ জেতানো ইনিংস খেলেছেন। কারণ কি এটাই?
মুশফিক: সব সময়ই আশা থাকে, দল জিতলে তাতে মূল অবদান যেন আমার হয়। আর অধিনায়ক হলে ভালো কিছু করার আনন্দ দ্বিগুণ হয়ে যায়। আপনি যখন দলের জয়ে মূল ভূমিকা রাখবেন, আলাদা অনুভূতি হবেই।
সাকিব-তামিমকে বিতর্কিতভাবে সরিয়ে দেওয়ার পর আপনি অধিনায়ক হয়েছেন। শুরুতেই একটা চ্যালেঞ্জ ছিল। সেটা সামলে কীভাবে এগিয়েছেন?
মুশফিক: অনেক কিছু নিয়েই বিতর্ক চলছিল। আপনারা জানেন আমি সবাইকে একটা করে চিঠি দিয়েছিলাম, যেটাতে মনের যত কথা আছে সব বলার চেষ্টা করেছি। সবাই একসঙ্গে থাকলে অনেককে অনেক কিছু বলা যায় না। তবে আলাদাভাবে বললে বলা যায়। আমি বলতে চেয়েছিলাম আমাদের সামনে কী কী করণীয় এবং যা যা হয়ে গেছে, সেখান থেকে উত্তরণের জন্য কী কী দরকার। এ রকম পরিস্থিতিতে যেন সবাই এক থাকি। আমি আর রিয়াদ ভাই (মাহমুদউল্লাহ) বসে এগুলো ঠিক করেছি।
চিঠি দেওয়ার পরিকল্পনা কীভাবে এল? এটাকেই সবচেয়ে ভালো মাধ্যম মনে হলো কেন?
মুশফিক: ডায়েরি লেখার অভ্যাস আছে আমার। আমি জানি, অনেক কথা আছে যেগুলো এমনিতে বলা যায় না কিন্তু লিখতে গেলে বেরিয়ে আসে। আপনি নিজের হাতে লিখছেন...আবেগটাও অনেক বেশি থাকে। আমার মনে হলো লিখে দিলে সবাই গুরুত্বটা বুঝবে। ভাববে, শুধু তার জন্য আমি এতগুলো কথা লিখেছি। আমার মনে হয়েছে এতে কাজ হতে পারে।
নিজের ডায়েরির পুরোনো লেখা পড়েন?
মুশফিক: অবশ্যই পড়ি। আমার চার-পাঁচটা ডায়েরি আছে। লেখার অভ্যাস আগেই ছিল, তবে বিকেএসপিতে পড়ার সময় থেকে নিয়মিত লেখা শুরু করি। প্রতিদিন যা-ই করতাম লিখে রাখতাম। এখন আর প্রতিদিন লেখা হয় না। তবে কিছু একটা শিখলাম বা ভালো লাগল, তখন লিখে রাখি।
সর্বশেষ কবে লিখেছেন ডায়েরিতে?
মুশফিক: এশিয়া কাপের ফাইনাল শেষে। বেশি লিখতে পারিনি। খুবই খারাপ লাগছিল।
কী লিখেছেন সেদিন, বলা যাবে?
মুশফিক: বড় ম্যাচে সাধারণত আমার একটা স্বপ্ন থাকে। সেদিন যেমন স্বপ্ন দেখেছিলাম, উইনিং শটটা আমি খেলেছি এবং খেলার পর উইকেটের ওপর শুয়ে পড়েছি। এ রকম একটা স্বপ্ন ছিল, মঞ্চটাও ওরকমই তৈরি হয়েছিল। কিন্তু গিয়ে তো আউট হয়ে গেলাম। তখন খুব খারাপ লেগেছিল। ডায়েরিতে সেই অনুভূতিই প্রকাশ করেছি। লিখেছি, ‘স্বপ্ন ঠিকই ছিল, তবে আমি শেষটা করতে পারিনি। ব্যাড লাক। আশা করি পরের বার হবে।’
আবার একটু অধিনায়কত্ব প্রসঙ্গ। অধিনায়কত্ব পাওয়ার পর সাকিব-তামিমকে নিয়ে নিশ্চয়ই একটু বেশি ভাবতে হয়েছে। কীভাবে সামলেছেন ব্যাপারটা?
মুশফিক: ওরা দুজনই অনেক পরিণত। একটা জিনিস শুধু আমি না, ওরাও বিশ্বাস করে যে এখানে কোনো ব্যক্তির ব্যাপার নয়, এখানে পুরো বাংলাদেশ। বাংলাদেশের ভালোর জন্য যা যা করা দরকার, আমরা করব। সাকিব, তামিম, মাশরাফি ভাই, আরও যারা আছে সবার সঙ্গে আমি বসেছি এবং সবাই এটা অনুধাবন করেছে। তারা বুঝেছে যেসব ঘটনা ঘটেছে, সেগুলো অপ্রত্যাশিত। কিছু জিনিস হয়তো সত্য, কিছু জিনিস সত্য না। সেদিক দিয়ে তারা অনেক ক্লিয়ার ছিল, আমিও ক্লিয়ার ছিলাম। অনূর্ধ্ব-১৫ থেকে আমরা একসঙ্গে খেলে আসছি। কাজেই বাইরের ঘটনার প্রভাব আমাদের ওপর পড়েনি। তা ছাড়া তামিম-সাকিব কী মানের খেলোয়াড় সবাই জানে। তাদের মতো খেলোয়াড় বাংলাদেশে আর হবে কি না আমার সন্দেহ আছে। তাদের দায়িত্ব অনেক বেশি। আমিও সেটা তাদের বোঝানোর চেষ্টা করেছি, ‘তোরা যে জায়গায়, হাজার হাজার লাখ লাখ মানুষ তোদের অনুসরণ করে। তোরা তোদের স্ট্যান্ডার্ড মেনটেইন করবি। সে জন্য যা সাপোর্ট দিতে হয়, আমি তা দেওয়ার চেষ্টা করব।’
তাদের দিক থেকে কেমন সাড়া পেয়েছেন?
মুশফিক: খেয়াল করলেই বুঝবেন...। তামিম, সাকিব, মাশরাফি ভাইসহ সবাই মাঠ এবং মাঠের বাইরে আমাকে অসাধারণ সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। অধিনায়ক হওয়ার পর সাকিব-তামিমও আমাকে অভিনন্দন জানিয়েছে। আমাকে ও রিয়াদ ভাইকে বলেছে, ‘আপনারা কোনো টেনশন করবেন না। আমাদের কী করতে হবে বলবেন। যা করতে হয় আমরা করব। সামনে অনেক বড় সিরিজ।’ এটা অনেক বড় ব্যাপার ছিল তখন।
সাকিবকে কিছুদিন আগে দলের সবার অটোগ্রাফসহ একটা পেইন্টিং উপহার দিয়েছেন। কী মনে করে এটা করলেন?
মুশফিক: অনেক দিন ধরেই চিন্তাটা ছিল। সাকিব যখন ওয়ানডের সেরা অলরাউন্ডার হয়, তখন থেকেই। এরপর যখন টেস্টেও এক নম্বর হলো, ভাবলাম এটাই সেরা সময়। রিয়াদ ভাইও বললেন, ভালো আইডিয়া। সাকিব সবার সেরা। সে জন্য ও সবার কাছ থেকেই নানাভাবে অভিনন্দন-শুভেচ্ছা পায়। আমি ভাবলাম, আমরাই তো ওর সবচেয়ে কাছের। আমাদের কাছ থেকে এমন কিছু পেলে সেটাই হবে তার জন্য বেশি আনন্দের।
আপনি একটু আবেগী। ড্রেসিংরুমেও অনেক সময় সেটা প্রকাশ হয়ে যায়। অধিনায়ক হওয়ার পর বলেছিলেন, আবেগ নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করবেন। কতটা পারছেন সেটা?
মুশফিক: আসলে কখনো এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়, যখন আপনাকে শক্ত হতে হয়। অনেক সময় কঠিন কথা বলতে হয়। দলের জন্য যেটা ভালো হয়, সেটা আমি সব সময়ই বলি। গত তিন-চার মাসেও বলেছি। অন্যরা আমার কথাকে সম্মান জানিয়েছে। হ্যাঁ, মাঝে মাঝে আবেগ এসে যায়। চেষ্টা করি নিয়ন্ত্রণ করতে। না পারলে আড়ালে চলে যাই। তবে এশিয়া কাপের ফাইনালের ওটার (কান্না) জন্য আমি দুঃখিত।
বিপিএলের সময় একটা মন্তব্য করে বোর্ডের বিরাগভাজন হয়েছিলেন, যাতে এশিয়া কাপে আপনার অধিনায়ক হওয়া নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছিল। ওই সময় মনের অবস্থা কী ছিল?
মুশফিক: সেদিন হারার পর একটু মন খারাপ ছিল। পরে বুঝতে পারি, জাতীয় দলের অধিনায়ক হিসেবে ওভাবে বলা আমার ঠিক হয়নি। আমি বোর্ডের অধীনে আছি। তাদের বিরুদ্ধে বলা মানে নিজের পরিবারের বিরুদ্ধে বলা। এটা ঠিক নয়। পরে আমি ক্ষমা চেয়েছি। ওনারাও (বিসিবি) সেটা গ্রহণ করেছেন। আমার মনে হয় এ কারণেই আলোচনা ছিল যে আমাকে বোর্ড নেতৃত্ব থেকে সরিয়ে দেবে। ওই দুইটা দিন শুধু আমি না, আমার পরিবারের লোকজনও অনেক টেনশনে ছিল।
ক্ষমা চাওয়াতেই তা হলে এশিয়া কাপে আপনাকে নেতৃত্ব দিয়েছে বোর্ড...
মুশফিক: হ্যাঁ, অবশ্যই। একটা চিঠি দিয়ে আমাকে আমার ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়েছিল। তখন আমিও আরেকটা চিঠি দিয়ে জানাই যে আমি এর জন্য দুঃখিত। ভবিষ্যতে এ রকম কিছু হবে না।
এশিয়া কাপ আপনাদের ওপর প্রত্যাশার চাপ বাড়িয়ে দিয়েছে। সাফল্যটা যে ফ্লুক নয়, সেটা প্রমাণের চাপও তো আছে, তাই না?
মুশফিক: এটা আমাদের জন্য একটা চ্যালেঞ্জ। এশিয়া কাপ শুরুর আগে কেউই ভাবেনি আমরা এত ভালো খেলব। ফাইনালের পর আমরা সবাই ড্রেসিংরুমে প্রতিজ্ঞা করেছি, এখান থেকে আর পিছিয়ে যাব না। ব্যাপারটা এমন না যে আমরা এখন প্রতি ম্যাচেই জিতব। তবে যে শুরুটা করেছি, খেলায়-শরীরী ভাষায় ভালো কিছু করার যে আগ্রহ ফুটে উঠছে, এটা যেন ধরে রাখি। এক-দেড় বছরও যদি ধরে রাখতে পারি, দেখবেন অনেক ম্যাচই আমার জিতছি। আমাদের টার্গেট প্রতি ম্যাচে ভালো খেলা এবং একটার চেয়ে আরেকটা ম্যাচে ভালো খেলা। পাকিস্তান সফর না হলে ইচ্ছা আছে কিছু প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক ক্রিকেট খেলা। বোর্ড সভাপতি, কোচ স্টুয়ার্ট ল সবার সঙ্গে কথা হয়েছে। দুবাই বা অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে, অথবা কাউকে এনেও যেন আমরা প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক সিরিজের মধ্যে থাকতে পারি। এশিয়া কাপের পর লম্বা বিরতি পড়ে গেলে আগস্টে জিম্বাবুয়ে সিরিজটা সহজ হবে না। আমরা চাই আমাদের ছন্দটা যেন নষ্ট না হয়। এই জায়গা থেকে আমাদের আর নিচে নামার সুযোগ নেই। সবাই যেন সেভাবেই স্বপ্ন দেখি।
পাকিস্তান সফর নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে। খেলোয়াড় হিসেবে আপনি বা আপনার দলের অন্যরা পাকিস্তানে যাওয়াটাকে কতটা নিরাপদ মনে করছেন?
মুশফিক: কার সাথে, কোথায়—এসবের চেয়ে আমাদের কাছে খেলাটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। পাকিস্তানে যাওয়াটা যদি নিরাপদ হয় এবং আইসিসি সবুজ সংকেত দেয়, তা হলে আমাদের যেতে কোনো সমস্যা নেই। আমাদের মূল কাজ ক্রিকেট খেলা। যেহেতু সামনে লম্বা একটা বিরতি আছে, আমরা চাইব প্রতিযোগিতামূলক ক্রিকেটে থাকতে। যদি সব দিক দিয়ে যাওয়া নিরাপদ হয়, তা হলে অবশ্যই যাব।
মুশফিকুর রহিম: এখন তো বেশ ভালোই...। অধিনায়ক হিসেবে অভিষেক হয়েছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে। এরপর পাকিস্তান সিরিজ, এশিয়া কাপ। তিনটা বড় আসর। দল হিসেবে মোটামুটি ভালোই খেলেছি আমরা। অধিনায়ক হিসেবে পুরোপুরি সন্তুষ্ট বলব না। তবে আমি খুশি।
অধিনায়কত্বের ভালো-মন্দ দিকগুলো কী কী?
মুশফিক: সবই তো ভালো! দায়িত্বটা অনেক বেড়ে যায়। শুধু মাঠে না, মাঠের বাইরেও অনেক দায়িত্ব থাকে। সবার খোঁজখবর রাখা। ভালো-মন্দ জানা। ব্যক্তিগতভাবে কথা বলা। অনুশীলনে সাহায্য করা। তবে সবচেয়ে বেশি তৃপ্তি পাওয়া যায় সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতে পারলে। পারফরম্যান্স করার তাগিদও অনেক বেশি থাকে।
অধিনায়ক হওয়ার পর কয়েকটা ম্যাচে ব্যাট হাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। ম্যাচ জেতানো ইনিংস খেলেছেন। কারণ কি এটাই?
মুশফিক: সব সময়ই আশা থাকে, দল জিতলে তাতে মূল অবদান যেন আমার হয়। আর অধিনায়ক হলে ভালো কিছু করার আনন্দ দ্বিগুণ হয়ে যায়। আপনি যখন দলের জয়ে মূল ভূমিকা রাখবেন, আলাদা অনুভূতি হবেই।
সাকিব-তামিমকে বিতর্কিতভাবে সরিয়ে দেওয়ার পর আপনি অধিনায়ক হয়েছেন। শুরুতেই একটা চ্যালেঞ্জ ছিল। সেটা সামলে কীভাবে এগিয়েছেন?
মুশফিক: অনেক কিছু নিয়েই বিতর্ক চলছিল। আপনারা জানেন আমি সবাইকে একটা করে চিঠি দিয়েছিলাম, যেটাতে মনের যত কথা আছে সব বলার চেষ্টা করেছি। সবাই একসঙ্গে থাকলে অনেককে অনেক কিছু বলা যায় না। তবে আলাদাভাবে বললে বলা যায়। আমি বলতে চেয়েছিলাম আমাদের সামনে কী কী করণীয় এবং যা যা হয়ে গেছে, সেখান থেকে উত্তরণের জন্য কী কী দরকার। এ রকম পরিস্থিতিতে যেন সবাই এক থাকি। আমি আর রিয়াদ ভাই (মাহমুদউল্লাহ) বসে এগুলো ঠিক করেছি।
চিঠি দেওয়ার পরিকল্পনা কীভাবে এল? এটাকেই সবচেয়ে ভালো মাধ্যম মনে হলো কেন?
মুশফিক: ডায়েরি লেখার অভ্যাস আছে আমার। আমি জানি, অনেক কথা আছে যেগুলো এমনিতে বলা যায় না কিন্তু লিখতে গেলে বেরিয়ে আসে। আপনি নিজের হাতে লিখছেন...আবেগটাও অনেক বেশি থাকে। আমার মনে হলো লিখে দিলে সবাই গুরুত্বটা বুঝবে। ভাববে, শুধু তার জন্য আমি এতগুলো কথা লিখেছি। আমার মনে হয়েছে এতে কাজ হতে পারে।
নিজের ডায়েরির পুরোনো লেখা পড়েন?
মুশফিক: অবশ্যই পড়ি। আমার চার-পাঁচটা ডায়েরি আছে। লেখার অভ্যাস আগেই ছিল, তবে বিকেএসপিতে পড়ার সময় থেকে নিয়মিত লেখা শুরু করি। প্রতিদিন যা-ই করতাম লিখে রাখতাম। এখন আর প্রতিদিন লেখা হয় না। তবে কিছু একটা শিখলাম বা ভালো লাগল, তখন লিখে রাখি।
সর্বশেষ কবে লিখেছেন ডায়েরিতে?
মুশফিক: এশিয়া কাপের ফাইনাল শেষে। বেশি লিখতে পারিনি। খুবই খারাপ লাগছিল।
কী লিখেছেন সেদিন, বলা যাবে?
মুশফিক: বড় ম্যাচে সাধারণত আমার একটা স্বপ্ন থাকে। সেদিন যেমন স্বপ্ন দেখেছিলাম, উইনিং শটটা আমি খেলেছি এবং খেলার পর উইকেটের ওপর শুয়ে পড়েছি। এ রকম একটা স্বপ্ন ছিল, মঞ্চটাও ওরকমই তৈরি হয়েছিল। কিন্তু গিয়ে তো আউট হয়ে গেলাম। তখন খুব খারাপ লেগেছিল। ডায়েরিতে সেই অনুভূতিই প্রকাশ করেছি। লিখেছি, ‘স্বপ্ন ঠিকই ছিল, তবে আমি শেষটা করতে পারিনি। ব্যাড লাক। আশা করি পরের বার হবে।’
আবার একটু অধিনায়কত্ব প্রসঙ্গ। অধিনায়কত্ব পাওয়ার পর সাকিব-তামিমকে নিয়ে নিশ্চয়ই একটু বেশি ভাবতে হয়েছে। কীভাবে সামলেছেন ব্যাপারটা?
মুশফিক: ওরা দুজনই অনেক পরিণত। একটা জিনিস শুধু আমি না, ওরাও বিশ্বাস করে যে এখানে কোনো ব্যক্তির ব্যাপার নয়, এখানে পুরো বাংলাদেশ। বাংলাদেশের ভালোর জন্য যা যা করা দরকার, আমরা করব। সাকিব, তামিম, মাশরাফি ভাই, আরও যারা আছে সবার সঙ্গে আমি বসেছি এবং সবাই এটা অনুধাবন করেছে। তারা বুঝেছে যেসব ঘটনা ঘটেছে, সেগুলো অপ্রত্যাশিত। কিছু জিনিস হয়তো সত্য, কিছু জিনিস সত্য না। সেদিক দিয়ে তারা অনেক ক্লিয়ার ছিল, আমিও ক্লিয়ার ছিলাম। অনূর্ধ্ব-১৫ থেকে আমরা একসঙ্গে খেলে আসছি। কাজেই বাইরের ঘটনার প্রভাব আমাদের ওপর পড়েনি। তা ছাড়া তামিম-সাকিব কী মানের খেলোয়াড় সবাই জানে। তাদের মতো খেলোয়াড় বাংলাদেশে আর হবে কি না আমার সন্দেহ আছে। তাদের দায়িত্ব অনেক বেশি। আমিও সেটা তাদের বোঝানোর চেষ্টা করেছি, ‘তোরা যে জায়গায়, হাজার হাজার লাখ লাখ মানুষ তোদের অনুসরণ করে। তোরা তোদের স্ট্যান্ডার্ড মেনটেইন করবি। সে জন্য যা সাপোর্ট দিতে হয়, আমি তা দেওয়ার চেষ্টা করব।’
তাদের দিক থেকে কেমন সাড়া পেয়েছেন?
মুশফিক: খেয়াল করলেই বুঝবেন...। তামিম, সাকিব, মাশরাফি ভাইসহ সবাই মাঠ এবং মাঠের বাইরে আমাকে অসাধারণ সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। অধিনায়ক হওয়ার পর সাকিব-তামিমও আমাকে অভিনন্দন জানিয়েছে। আমাকে ও রিয়াদ ভাইকে বলেছে, ‘আপনারা কোনো টেনশন করবেন না। আমাদের কী করতে হবে বলবেন। যা করতে হয় আমরা করব। সামনে অনেক বড় সিরিজ।’ এটা অনেক বড় ব্যাপার ছিল তখন।
সাকিবকে কিছুদিন আগে দলের সবার অটোগ্রাফসহ একটা পেইন্টিং উপহার দিয়েছেন। কী মনে করে এটা করলেন?
মুশফিক: অনেক দিন ধরেই চিন্তাটা ছিল। সাকিব যখন ওয়ানডের সেরা অলরাউন্ডার হয়, তখন থেকেই। এরপর যখন টেস্টেও এক নম্বর হলো, ভাবলাম এটাই সেরা সময়। রিয়াদ ভাইও বললেন, ভালো আইডিয়া। সাকিব সবার সেরা। সে জন্য ও সবার কাছ থেকেই নানাভাবে অভিনন্দন-শুভেচ্ছা পায়। আমি ভাবলাম, আমরাই তো ওর সবচেয়ে কাছের। আমাদের কাছ থেকে এমন কিছু পেলে সেটাই হবে তার জন্য বেশি আনন্দের।
আপনি একটু আবেগী। ড্রেসিংরুমেও অনেক সময় সেটা প্রকাশ হয়ে যায়। অধিনায়ক হওয়ার পর বলেছিলেন, আবেগ নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করবেন। কতটা পারছেন সেটা?
মুশফিক: আসলে কখনো এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়, যখন আপনাকে শক্ত হতে হয়। অনেক সময় কঠিন কথা বলতে হয়। দলের জন্য যেটা ভালো হয়, সেটা আমি সব সময়ই বলি। গত তিন-চার মাসেও বলেছি। অন্যরা আমার কথাকে সম্মান জানিয়েছে। হ্যাঁ, মাঝে মাঝে আবেগ এসে যায়। চেষ্টা করি নিয়ন্ত্রণ করতে। না পারলে আড়ালে চলে যাই। তবে এশিয়া কাপের ফাইনালের ওটার (কান্না) জন্য আমি দুঃখিত।
বিপিএলের সময় একটা মন্তব্য করে বোর্ডের বিরাগভাজন হয়েছিলেন, যাতে এশিয়া কাপে আপনার অধিনায়ক হওয়া নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছিল। ওই সময় মনের অবস্থা কী ছিল?
মুশফিক: সেদিন হারার পর একটু মন খারাপ ছিল। পরে বুঝতে পারি, জাতীয় দলের অধিনায়ক হিসেবে ওভাবে বলা আমার ঠিক হয়নি। আমি বোর্ডের অধীনে আছি। তাদের বিরুদ্ধে বলা মানে নিজের পরিবারের বিরুদ্ধে বলা। এটা ঠিক নয়। পরে আমি ক্ষমা চেয়েছি। ওনারাও (বিসিবি) সেটা গ্রহণ করেছেন। আমার মনে হয় এ কারণেই আলোচনা ছিল যে আমাকে বোর্ড নেতৃত্ব থেকে সরিয়ে দেবে। ওই দুইটা দিন শুধু আমি না, আমার পরিবারের লোকজনও অনেক টেনশনে ছিল।
ক্ষমা চাওয়াতেই তা হলে এশিয়া কাপে আপনাকে নেতৃত্ব দিয়েছে বোর্ড...
মুশফিক: হ্যাঁ, অবশ্যই। একটা চিঠি দিয়ে আমাকে আমার ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়েছিল। তখন আমিও আরেকটা চিঠি দিয়ে জানাই যে আমি এর জন্য দুঃখিত। ভবিষ্যতে এ রকম কিছু হবে না।
এশিয়া কাপ আপনাদের ওপর প্রত্যাশার চাপ বাড়িয়ে দিয়েছে। সাফল্যটা যে ফ্লুক নয়, সেটা প্রমাণের চাপও তো আছে, তাই না?
মুশফিক: এটা আমাদের জন্য একটা চ্যালেঞ্জ। এশিয়া কাপ শুরুর আগে কেউই ভাবেনি আমরা এত ভালো খেলব। ফাইনালের পর আমরা সবাই ড্রেসিংরুমে প্রতিজ্ঞা করেছি, এখান থেকে আর পিছিয়ে যাব না। ব্যাপারটা এমন না যে আমরা এখন প্রতি ম্যাচেই জিতব। তবে যে শুরুটা করেছি, খেলায়-শরীরী ভাষায় ভালো কিছু করার যে আগ্রহ ফুটে উঠছে, এটা যেন ধরে রাখি। এক-দেড় বছরও যদি ধরে রাখতে পারি, দেখবেন অনেক ম্যাচই আমার জিতছি। আমাদের টার্গেট প্রতি ম্যাচে ভালো খেলা এবং একটার চেয়ে আরেকটা ম্যাচে ভালো খেলা। পাকিস্তান সফর না হলে ইচ্ছা আছে কিছু প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক ক্রিকেট খেলা। বোর্ড সভাপতি, কোচ স্টুয়ার্ট ল সবার সঙ্গে কথা হয়েছে। দুবাই বা অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে, অথবা কাউকে এনেও যেন আমরা প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক সিরিজের মধ্যে থাকতে পারি। এশিয়া কাপের পর লম্বা বিরতি পড়ে গেলে আগস্টে জিম্বাবুয়ে সিরিজটা সহজ হবে না। আমরা চাই আমাদের ছন্দটা যেন নষ্ট না হয়। এই জায়গা থেকে আমাদের আর নিচে নামার সুযোগ নেই। সবাই যেন সেভাবেই স্বপ্ন দেখি।
পাকিস্তান সফর নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে। খেলোয়াড় হিসেবে আপনি বা আপনার দলের অন্যরা পাকিস্তানে যাওয়াটাকে কতটা নিরাপদ মনে করছেন?
মুশফিক: কার সাথে, কোথায়—এসবের চেয়ে আমাদের কাছে খেলাটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। পাকিস্তানে যাওয়াটা যদি নিরাপদ হয় এবং আইসিসি সবুজ সংকেত দেয়, তা হলে আমাদের যেতে কোনো সমস্যা নেই। আমাদের মূল কাজ ক্রিকেট খেলা। যেহেতু সামনে লম্বা একটা বিরতি আছে, আমরা চাইব প্রতিযোগিতামূলক ক্রিকেটে থাকতে। যদি সব দিক দিয়ে যাওয়া নিরাপদ হয়, তা হলে অবশ্যই যাব।
No comments