অলির ওপর হামলা-চট্টগ্রামে আদালত চত্বরে আওয়ামী লীগ কর্মীদের হাতে প্রহৃত ৩৫

লডিপির সভাপতি ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির সভাপতি কর্নেল (অব.) অলি আহমদ বীরবিক্রমের ওপর হামলা চালিয়েছেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল ১১টায় চট্টগ্রাম আদালত চত্বরে পুলিশের উপস্থিতিতে প্রকাশ্যে তার ওপর অতর্কিত আক্রমণ চালানো হয়। বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মী মানববর্ম তৈরি করে অলিকে রক্ষা করেন। তাদের গায়েও এসে লাগে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের ছোড়া


ইট-পাটকেল। হামলার ঘটনায় এলডিপির চট্টগ্রাম মহানগর কমিটির সভাপতি ওয়াহেদ আজগর, সাংবাদিক, আইনজীবীসহ আহত হন ৩০ থেকে ৩৫ জন। ভাংচুর করা হয় অলির গাড়িটিও। ঘটনার এক পর্যায়ে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা ধাওয়া
করলে এলডিপি নেতাকর্মী ও আইনজীবীদের সহায়তায় দ্রুত আদালত চত্বর ত্যাগ করে আত্মরক্ষা করেন অলি।
চট্টগ্রামের নারী সাংসদ চেমন আরা তৈয়বকে ইঙ্গিত করে কটূক্তি করায় দায়ের করা একটি মানহানি মামলায় হাজিরা দিতে গতকাল সকাল ১১টায় আদালতে যান কর্নেল অলি। আদালতে ঢোকার ও বের হওয়ার পথে দু'দফায় আক্রমণের শিকার হন তিনি। জাতীয় পতাকাবাহী গাড়িতে করে আদালতে ঢোকার সময় আগে থেকে অবস্থান করা আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা প্রথমে তার গতিপথ রোধ করেন। এ সময় মহিলা আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা অলিকে জুতা প্রদর্শন ও ছুড়ে মারেন এবং তার বিরুদ্ধে স্লোগান দিতে থাকেন। এ সময় ভাংচুর করা হয় অলির গাড়িটিও। পরে পুলিশি নিরাপত্তায় তিনি আদালতের ভেতর ঢোকেন। আদালত থেকে জামিন নিয়ে বের হওয়ার পথে তার ওপর দ্বিতীয় দফায় হামলা চালানো হয়। নেতাকর্মী পরিবেষ্টিত অবস্থায় আদালত থেকে বের হওয়ার পর তিনি উপস্থিত সংবাদ কর্মীদের সঙ্গে কথা বলার সময় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা চারদিক থেকে বৃষ্টির মতো ইটপাটকেল ছুড়তে থাকেন। এ সময় মানববর্ম তৈরি করে অলিকে রক্ষা করেন এলডিপি নেতাকর্মীরা। পরে আদালত ভবনের অদূরে লালদীঘি সংলগ্ন নগরীর বাসায় চলে যান তিনি। সেখানে চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি আহমদ খলিল খান, বর্তমান সিনিয়র সহসভাপতি অধ্যাপক শেখ মোঃ মহিউদ্দিনসহ বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীরা তাকে দেখতে যান।
এদিকে চন্দনাইশ আওয়ামী লীগরে সভাপতি হাবিবুর রহমান ও সাধারণ সম্পাদক ওয়াহিদুজ্জামান চৌধুরীর নেতৃত্বে যুব ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা হামলার ঘটনা ঘটিয়েছেন বলে অভিযোগ করেছে এলডিপি। এ ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন কর্নেল অলিসহ দলের সিনিয়র নেতারা।
হামলার ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাইলে এলডিপি সভাপতি কর্নেল অলি আহমদ সমকালকে বলেন, 'পুলিশের তত্ত্বাবধানে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরাই পরিকল্পিতভাবে আমার ও আমার নেতাকর্মীদের ওপর হামলা চালিয়েছ। এ হামলার পরিকল্পনা হয়েছে কোতোয়ালি থানায়। বুধবার রাতে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা থানার ওসির সঙ্গে বৈঠক করে এ পরিকল্পনা করেছে।' তিনি বলেন, 'প্রতিহিংসার রাজনীতিতে মেতে উঠেছে আওয়াম লীগ। এটা দেশের জন্য, গণতন্ত্রের জন্য শুভ নয়।' দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে বৈঠক করে এ হামলার ঘটনা সম্পর্কে করণীয় ঠিক করা হবে সমকালকে জানিয়েছেন তিনি।
চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা এলডিপির সাধারণ সম্পাদক মোঃ এয়াকুব অভিযোগ করে বলেন, চন্দনাইশসহ জেলা ও নগরীর বিভিন্ন স্থান থেকে আওয়ামী লীগ এবং অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের ক্যাডার বাহিনী জড়ো করে অলি আহমদের ওপর হামলা চালানো হয়েছে। এ ব্যাপারে দলের পক্ষ থেকে মামলা দায়ের করা হবে বলে জানিয়েছেন তিনি।
এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হলে অভিযুক্ত চন্দনাইশ আওয়ামী লীগের সভাপতি হাবিবুর রহমান মোবাইল ফোনে সমকালকে বলেন, 'চন্দনাইশে দলের দায়িত্বে আছি, অলি যখন আদালতে যান তখনও আমি তার বিরুদ্ধে মিছিল করেছি। তাই আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনাই স্বাভাবিক। তিনি যা করেছেন তা কখনোই ক্ষমাযোগ্য নয়। এ বেইজ্জতি (অপমান) তার কপালে লেখা ছিল।'
কটূক্তির মামলায় অলির জামিন :প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও চট্টগ্রামের নারী সাংসদ চেমন আরা তৈয়বকে ইঙ্গিত করে চন্দনাইশে একটি দলীয় সমাবেশে অশালীন বক্তব্য রাখার দায়ে কর্নেল অলির বিরুদ্ধে যে মামলা হয় তাতে জামিন পেয়েছেন তিনি। অতিরিক্ত মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মাহবুবুর রহমানের আদালত গতকাল অলিকে জামিন দেন। একজন স্থানীয় জামিনদার, একজন আইনজীবী ও ২০ হাজার টাকা মুচলেকায় তাকে এ জামিন দেওয়া হয়। আদালতে অলির পক্ষে এলডিপি চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা সভাপতি অ্যাডভোকেট কফিল উদ্দিন ও অ্যাডভোকেট আবদুস ছাত্তারসহ অর্ধশতাধিক আইনজীবী অংশ নেন। অন্যদিকে নগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট ইব্রাহিম হোসেন চৌধুরী বাবুল, মহানগর এডিশনাল পিপি অশোক দাশ, অতিরিক্ত জেলা পিপি আবদুর রশিদসহ আরও বেশ কয়েকজন আইনজীবী মামলার বাদী আফতাব আহমুদ শিমুলের পক্ষ নিয়ে অলির জামিনের বিরোধিতা করেন।
প্রসঙ্গত, গত ১৮ নভেম্বর চন্দনাইশে এলডিপির সমাবেশে কর্নেল অলি আহমেদ বলেন, 'চন্দনাইশে একজন মহিলা এমপি দিয়ে হাজার যুবকের সমস্যা সমাধান করা যাবে না। তাই টুঙ্গিপাড়া থেকেও সুন্দরী মহিলাদের এনে চন্দনাইশে দিলে যুব সমাজের কল্যাণ হবে।' এ ব্যাপারে গত ১৯ নভেম্বর আদালতে তার বিরুদ্ধে মানহানি মামলা করেন চন্দনাইশের আফতাব মাহমুদ শিমুল নামের এক ব্যবসায়ী।
সাংবাদিক আইনজীবীসহ আহত হলেন যারা :চট্টগ্রাম আদালত চত্বরে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের হামলায় এলডিপি নেতাকর্মী ছাড়াও আহত হয়েছেন সাংবাদিক, আইনজীবীসহ ৩০-৩৫ জন। দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের ছোড়া ইটপাটকেলের আঘাতে আহত হয়েছেন সময় টিভির ক্যামেরা জার্নালিস্ট বিপ্লব মজুমদার ও এটিএনের ক্যামেরা জার্নালিস্ট মোঃ ফরিদসহ আরও কয়েকজন। তাদের মধ্যে বিপ্লব ও ফরিদকে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। আইনজীবী মোজাফফর আহমদ ও আইনজীবী মোঃ ফরিদসহ আরও কয়েকজন আইনজীবীও আহত হন। এছাড়া নগর এলডিপির সভাপতি ওয়াহেদ আজগরসহ প্রায় ২৫ জন নেতাকর্মী আহত হন। ওয়াহেদ আজগরকে নগরীর একটি ক্লিনিকে চিকিৎসা দেওয়া হয়। আহতদের মধ্যে রয়েছেন জেলা ছাত্রদলের কয়েকজন নেতাকর্মীও। এছাড়া রয়েছেন সাতকানিয়া এলডিপি সভাপতি মোঃ শাহজাহান চৌধুরী, পটিয়া উপজেলা নেতা মোঃ আইয়ুব, আনোয়ারা ছাত্রদল নেতা মোঃ শাজাহান, সাতকানিয়া এলডিপি নেতা আফরোজা আফসানা, এলডিপি নেতা মোঃ জমির, সুলতান মাহমুদ খোকন, মোঃ ইউনুস, নাজিম, শওকত, নুরুল আলমসহ আরও কয়েকজন নেতাকর্মী।
খালেদার ক্ষোভ :এদিকে অলি আহমদের ওপর হামলার ঘটনায় তীব্র নিন্দা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। তিনি ক্ষমতাসীন দলের উদ্দেশে বলেন, 'সন্ত্রাসী-গুণ্ডাপাণ্ডাদের সামলান। অন্যথায় এর চরম দায় আপনাদেরকে বহন করতে হবে।' গতকাল বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে তিনি এ কথা বলেন।
ঘটনায় দায়ী ব্যক্তিদের অবিলম্বে গ্রেফতার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির জোর দাবি জানান খালেদা জিয়া। তিনি বলেন, মিথ্যাবাদী ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকার মুখে গণতন্ত্র ও মুক্তিযুদ্ধের বুলি আওড়ালেও তারা মুক্তিযোদ্ধাদের লাঞ্ছিত ও অপমান করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করে না। ইতিপূর্বে দেশের স্বনামধন্য সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী ও সাংবাদিকসহ গণ্যমান্য ব্যক্তিদের একাধিকবার লাঞ্ছিত এবং অপমানিত করেছে। এ ছাড়াও শাসকগোষ্ঠীর অপশাসনের বিরোধিতাকারী বরেণ্য রাজনীতিক ও মুক্তিযোদ্ধাদের অপমান ও নির্যাতন করা তাদের একটি নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন, স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব বিকিয়ে দেওয়া পদলেহী এই সরকারের গোপন চুক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রামী মানুষের কঠিন প্রতিরোধে অলি আহমদ শামিল থাকছেন বলেই তাকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে 'আওয়ামী দুষ্কৃতকারীরা' হামলা চালিয়েছে। ঘটনায় এলডিপিসহ অন্যান্য দলের আহত নেতাকর্মীদের আশু সুস্থতা কামনা করেন খালেদা জিয়া।
অপর এক বিবৃতিতে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর অভিযোগ করেন, 'পরিকল্পিতভাবে' অলি আহমদের জীবননাশের উদ্দেশ্যেই হামলা করা হয়েছে।
অলির ওপর হামলার নিন্দা বিএনপির :চট্টগ্রামে এলডিপি সভাপতি অলি আহমদের ওপর হামলার নিন্দা জানিয়েছে বিএনপি। দলের যুগ্ম মহাসচিব রিজভী আহমেদ বলেন, হত্যার উদ্দেশ্যেই পুলিশের ছত্রছায়ায় আওয়ামী লীগের 'সন্ত্রাসী বাহিনী' অলি আহমদের ওপর হামলা চালিয়েছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে অলির ওপর হামলার ঘটনায় বিকেলে বিএনপির পক্ষ থেকে এ প্রতিক্রিয়া জানানো হয়। নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন রিজভী।
রিজভী আহমেদ বলেন, খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে চলমান আন্দোলনে অলি সম্পৃক্ত হওয়ার কারণেই ক্ষমতাসীনরা তার প্রাণশক্তি স্তব্ধ করে দিতে চায়। চট্টগ্রামে তারা হায়েনার মতো তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে খালেদা জিয়ার খুলনা রোডমার্চ বিষয়ে বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরেন দফতরের দায়িত্বপ্রাপ্ত এই যুগ্ম মহাসচিব। তিনি জানান, শনিবার সকাল ১০টায় উত্তরার হাউজ বিল্ডিং থেকে রোডমার্চ শুরু হবে। গাজীপুর, টাঙ্গাইল, পাবনা, কুষ্টিয়া ও ঝিনাইদহ হয়ে প্রথম দিন যশোরে বিরতি হবে। ২৭ নভেম্বর খুলনা গিয়ে কর্মসূচি শেষ হবে।

No comments

Powered by Blogger.