চরাচর-ভাওয়ালরত্ন নুরুল ইসলাম

মাজজীবনে অবক্ষয়ের সময়ে যাঁরা সমাজকে সঠিক পথে পরিচালনার জন্য হাল ধরেন, তাঁদের অন্যতম পুরোধা শিক্ষকসমাজ। একদিকে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেওয়া, অন্যদিকে সেই আলোতে সমাজকে আলোকিত করা_এমন কঠিন কিন্তু মহৎ কাজটি করে থাকে শিক্ষকসমাজ। আর যেসব শিক্ষক এই সমাজের নৈতিকতার ধ্বজাটি উঁচু করে ধরে রাখেন, নিঃসন্দেহে তাঁরা শিক্ষকদের আদর্শ। এমনই একজন শিক্ষক হলেন নুরুল ইসলাম ভাওয়ালরত্ন।


তাঁর জন্ম ঐতিহ্যবাহী এক শিক্ষক পরিবারে। তিনি নিজেও পেশা হিসেবে বেছে নিলেন শিক্ষকতা। একে ঠিক পেশা বাছাই বলা যায় না, বলা যায় শিক্ষার জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করা। যিনি হতে পারতেন একজন সচিব বা উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, কালক্রমে তিনি হয়ে গেলেন একজন শিক্ষক। এরপর যুগের পর যুগ শুধু শিক্ষার আলো ছড়িয়ে যাওয়া। অর্ধশতাব্দীকাল ধরে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে যাওয়া এই মানুষটিকে জয়দেবপুরবাসী ডাকেন 'নুরু স্যার' নামে। শিক্ষাব্রতী ও শিক্ষাদরদি এই মানুষটির জন্ম ইংরেজি ১৯৩৪ সালে গাজীপুর জেলার জয়দেবপুর থানার মৈরান গ্রামে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করেন তিনি। ইচ্ছা করলে যোগ দিতে পারতেন পাবলিক সার্ভিসে। কিন্তু অর্থবিত্ত-ক্ষমতা একজন শিক্ষকের কাছে তুচ্ছ। তিনি ক্যাডার পদে চাকরিতে যোগ না দিয়ে যোগ দিলেন শিক্ষক পদে। ১৯৫৮ সালে গাজীপুর জেলার ঐতিহ্যবাহী রানী বিলাসমণি সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে তিনি যোগদান করেন। প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন ১৯৭১ সালে। তাঁর সুদক্ষ পরিচালনায় বিদ্যালয়টি ১৯৮৮ ও ১৯৯১ সালে দেশের শ্রেষ্ঠ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মর্যাদা লাভ করে। তিনি নিজেও দুইবার দেশের শ্রেষ্ঠ শিক্ষক হিসেবে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা লাভ করেন। প্রথমবার ১৯৮৮ সালে এবং পরে ১৯৯১ সালে। কর্মজীবনে কৃতিত্বের পুরস্কারস্বরূপ ১৯৯১ সালে তিনি 'ভাওয়ালরত্ন' উপাধিতে ভূষিত হন। সংস্কৃতিক্ষেত্রে অবদান রাখার জন্য ১৯৯৭ সালে তিনি কবি গোবিন্দ দাস স্মৃতি স্বর্ণপদক লাভ করেন। অনুষ্ঠান, সভা, সেমিনারে নুরু স্যারের বক্তৃতার জুড়ি মেলা ভার। এত প্রাপ্তির পরও বসে নেই নুরু স্যার। ৭৭ বছর বয়সেও নিয়মিত জয়দেবপুর কিন্ডারগার্টেন নামের শিশুদের একটি বিদ্যালয়ে যান। তাঁর ভেতরে বাস করে আরেক শিশু, যে শিশু প্রতিদিন সকাল-বিকেল জয়দেবপুর শহরের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত চষে বেড়ায়। রিকশা কিংবা প্রাইভেট কারে তাঁকে দেখা যায় না কখনোই। ১৯৭১ সালের ১৯ মার্চ মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে জয়দেবপুরে সংঘটিত প্রথম সশস্ত্র সংগ্রামে তাঁর ছিল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। জাগ্রত চৌরঙ্গীর বেদিমূলে তাই আমরা দেখি তাঁরই লেখা কবিতার চরণ_'ডান হাতে তাজা গ্রেনেড আমার/বাম হাতে রাইফেল/বিদ্রোহী আমি মুক্তিপিয়াসী/প্রাণ সদা উদ্বেল।/আমি তোমাদের চেনা/আমি যে মুক্তিসেনা।' তাই নুরু স্যারের কণ্ঠে শিক্ষকদের উদ্দেশে শুনি সরল স্বীকারোক্তি, 'অধ্যবসায়বলে অর্জিত হয় সফলতা, জ্ঞানচর্চায় চাই তৃষিত অভিনিবিষ্টতা। দায়িত্ব পালনে হতে হবে নিষ্ঠাবান, নীতি ও আদর্শে নিবেদিত হবে মনপ্রাণ। সন্ধানীমনস্কতার সরণি ধরে হতে হবে আগুয়ান। একজন শিক্ষক হবেন আদর্শের প্রতীক, প্রজ্ঞাবান। তিনিই ঘটাবেন জ্ঞানজ্যোতির বিকিরণ। ছাত্রছাত্রীরা তাঁর সন্তানসম আদর্শের ধন। সংকীর্ণতার ঊধর্ে্ব হবে তাঁর অবস্থান, নিজের কর্মপ্রণালিতে মুদ্রিত হবে প্রমাণ।
সাইফুল ইসলাম খান

No comments

Powered by Blogger.