দূরসম্পর্কীয়া-মূল : ওরহান পামুক, অনুবাদ : দুলাল আল মনসুর

৯৭৫ সালের ২৭ এপ্রিল। এই দিনটিতেই আমার সারা জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার মতো ঘটনা এবং কাকতালীয় ব্যাপারগুলোর শুরু। ভালিকোনাজি এভিনিউতে সিবেল আর আমি বসন্তসন্ধ্যার মৃদু হাওয়া গায়ে মাখিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম। হঠাৎ সিবেলের চোখে পড়ে যায়, দোকানের জানালায় বিখ্যাত জেনি কোলনের ডিজাইন করা একটা পার্স ঝুলছে। আমাদের আনুষ্ঠানিক বাগ্দান খুব দূরে নয় তখন। ফুরফুরে আর একটুখানি বেসামাল মেজাজে ছিলাম


আমরা। আমরা গিয়েছিলাম অভিজাত নিসান্তাসি এলাকার রেস্তোরাঁ ফুয়েতে। আমার মা-বাবার সঙ্গে ডিনার সেরে আমরা শেষে বাগ্দান অনুষ্ঠানের দিনক্ষণ ঠিক করতে আলোচনায় বসেছিলাম। জুনের মাঝামাঝি সময়ে ঠিক করা হলো বাগ্দান অনুষ্ঠানের দিন। কারণ লিসি নটর ডেম দ্য সিঁওতে পড়াশোনার সময়কার সিবেলের ঘনিষ্ঠ বান্ধবী নুরসিহান প্যারিস থেকে ওই সময়টায় আসতে পারবে আমাদের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে। সিবেল অনেক আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছে, বাগ্দান অনুষ্ঠানের জন্য তার পোশাক তৈরি করবে সিল্কি ইসমেতের কাছ থেকে। ইস্তাম্বুলে তখন এর মতো ব্যয়বহুল ও চাহিদাসম্পন্ন পোশাক তৈরিকারক আর নেই। আমার মা সিবেলকে তার ওই পোশাকের জন্য আগেই মুক্তার দানা উপহার দিয়েছিলেন। সেদিন সন্ধ্যায় আমার মায়ের সঙ্গে সিবেল আলাপ করছিল কিভাবে মুক্তার দানাগুলো পোশাকটার ওপর সেলাই করবে। আমার হবু শ্বশুরের ইচ্ছা ছিল, তার একমাত্র মেয়ের বাগ্দান অনুষ্ঠান হবে বিয়ের মূল অনুষ্ঠানের মতোই জাঁকজমকপূর্ণ। তার ইচ্ছাপূরণের ব্যাপারে আমার মায়ের সর্বাত্মক চেষ্টা ছিল। আমার বাবার পুলকিত হওয়ার বিষয়টা ছিল অন্য রকম_তার হবু পুত্রবধূ হতে যাচ্ছে সোরবনে পড়া একটা মেয়ে। পড়াশোনার জন্য ফ্রান্সে গেছে এমন মেয়ের খুব কদর ছিল তখনকার দিনের ইস্তাম্বুলের বুর্জোয়া সমাজে।
সেদিন সিবেলকে বাড়ি পেঁৗছে দিতে যাওয়ার সময় তার পুরু কাঁধের ওপর আদরের হাতে পেঁচিয়ে ধরে হাঁটছিলাম আর ভাবছিলাম আমার সৌভাগ্য আর সুখের কথা। ঠিক তখনই সিবেল বলে উঠল, 'আহ্, কী সুন্দর পার্স!' যদিও নেশার ঘোরে আমার মাথাটা একটু আনমনা ছিল, তবু আমি পার্সটার চেহারা আর দোকানের নাম লিখে রাখলাম। পরের দিন আবার সেই দোকানটায় গেলাম। আসলে আমি কোনো দিন ওই রকমের আপাতস্নিগ্ধ, শালীন ও আত্মতৃপ্তি-অন্বেষী মানুষ ছিলাম না। মেয়েদের কোনো উপহার কিনে দেওয়া কিংবা ফুল উপহার দেওয়া_এসবের জন্য সামান্যতম অজুহাত বা সুযোগের ব্যবহার করিনি কখনো। অবশ্য মনে মনে তাদের কিছু দেওয়ার মতো ইচ্ছা একেবারেই যে ছিল না, তাও নয়। তখনকার দিনে সিসলি, নিসান্তাসি ও বেবেক এলাকার পশ্চিমা রুচিঘেঁষা কাজহীন একঘেয়ে জীবনযাপনকারী গৃহিণীরা আর্ট গ্যালারি খোলা শুরু করেনি; করেছে অনেক পরে। তারা তখন বুটিকের দোকান চালাত, সেখানে মজুদ করে রাখত নারীদের ব্যবহার্য সব মনিহারি দ্রব্য। 'এলি' কিংবা 'ভোগ' ম্যাগাজিনে প্রদর্শিত লেটেস্ট মডেলের পোশাকাদি ব্যাগে ভরে নিয়ে আসত প্যারিস কিংবা মিলান থেকে আসার সময়। সেগুলোও রাখত তাদের দোকানে। হাস্যকর রকমের চড়া দামে ওই সব দ্রব্য তারা বিক্রি করত তাদেরই মতো একঘেয়ে জীবনযাপনকারী ধনী গৃহিণীদের কাছে।
প্যারিসের বিখ্যাত সেনে হানিমের নাম অনুসরণ করে রাখা সানজেলিজে নামের দোকানটির মালিক ছিলেন আমার মায়ের দিককার দূরসম্পর্কের আত্মীয়া। তবে সেদিন দুপুর ১২টার দিকে আমি যখন গেলাম, তিনি ওখানে ছিলেন না। পিতলের তৈরি ডাবল নবের উট মার্কা বেলে যে বিকট শব্দ হলো, সেটা মনে পড়লে এখনো আমার হৃৎপিণ্ড লাফিয়ে ওঠে। বাইরে গরম একটু থাকলেও ভেতরে ঢুকে বুঝতে পারলাম, খুব ঠাণ্ডা আর একটু বেশিই অন্ধকার। প্রথমে মনে হলো, ভেতরে কেউ নেই। দুপুরের রোদের আলো থেকে ভেতরে ঢুকে দৃষ্টি সহনীয় হতে একটু সময় লাগল। এরপর বুঝতে পারলাম, সজোরে তীরে আছড়ে পড়ার শক্তি নিয়ে আমার হৃৎপিণ্ড জায়গামতো এসে যাচ্ছে।
দৃষ্টির সামনে তাকে দেখতে পেয়ে তোতলাতে তোতলাতে কোনো রকমে বলতে পারলাম, 'জানালায় ঝুলিয়ে রাখা ম্যানিকিনের ওপরের ওই হাতব্যাগটা কিনতে চাই।'
'আপনি কি ক্রিম রঙের জেনি কোলনটার কথা বলছেন?'
তার চোখে চোখ পড়তেই চিনে ফেললাম।
'জানালার পাশে ম্যানিকিনের সঙ্গে ঝোলানো হাতব্যাগটা'_প্রায় স্বপ্নের ঘোরের মধ্য থেকে বললাম।
'ও আচ্ছা, ঠিক আছে'_বলেই সে ব্যাগটার দিকে এগিয়ে গেল। মুহূর্তের মধ্যে হাইহিল স্যান্ডেল জোড়ার ভেতর থেকে পা বের করে ডিসপ্লে এলাকার দিকে হাঁটা দিল সে। নগ্ন পায়ের নখের দিকে তাকিয়ে দেখতে পেলাম, সে নখগুলো সযত্নে লাল নেইলপলিশে রাঙিয়েছে। আমার দৃষ্টি চলে গেল তার খালি স্যান্ডেল জোড়া থেকে এগিয়ে যাওয়া পা পর্যন্ত। মে মাস তখনো শুরু হয়নি। তবে তার পা জোড়া দেখলাম তামাটে বর্ণ ধারণ করেছে।
তার পায়ের দৈর্ঘ্যের কারণে ফিতাওয়ালা স্কার্টটাকে কিছুটা খাটো মনে হচ্ছিল। একটা কাঠির মাথায় পেঁচিয়ে ব্যাগটা নিয়ে সে চলে এল কাউন্টারে। সরু ও দক্ষ আঙুলে ব্যাগের গা থেকে টিস্যু পেপারের দলাগুলো ছড়িয়ে ফেলে জিপার আঁটা পকেটগুলো দেখাল আমাকে। ছোট পকেট দুটো শূন্য। আরেকটা গোপন কুঠুরির মতো পকেট দেখাল। সেখান থেকে একটা কার্ড বের করল; লেখা আছে 'জেনি কোলন'। তার অঙ্গভঙ্গি আর কার্যকলাপ দেখে মনে হলো, সে খুব রহস্যজনক আর একান্ত ব্যক্তিগত কিছু দেখাচ্ছে আমাকে।
আমি বলে উঠলাম, 'আরে ফুসুন, তুমি তো দেখি অনেক বড় হয়ে গেছ! সম্ভবত আমাকে চিনতে পারোনি।'
'অবশ্যই চিনেছি, কামাল স্যার। তবে মনে হলো, আপনি আমাকে চিনতে পারেননি। তাই ভাবলাম, আপনাকে বিরক্ত করার দরকার কী।'
কিছুক্ষণ নীরবে কাটল। ব্যাগের মধ্যে আরো একটা পকেট দেখাল সে। তার শারীরিক সৌন্দর্য, খাটো স্কার্ট এবং আরো কিছু বিষয় তার সামনে মনে হলো আমাকে কিছুটা অস্থির করে ফেলেছে। আমি স্বাভাবিক হতে পারছিলাম না।
'ইয়ে...আচ্ছা, ইদানীং কী করছ তুমি?'
'বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য পড়াশোনা করছি। আর এখানে আসি প্রতিদিনই। এই দোকানটাতে এলে নতুন নতুন মানুষের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ হয়।'
'বেশ তো, চমৎকার। আচ্ছা, এখন বলো দেখি, ব্যাগটার দাম কত?'
ভুরুতে ভাঁজ ফেলে হাতে লেখা মূল্য-চিরকুটটার দিকে তাকিয়ে বলল, 'এক হাজার পাঁচ শ লিরা (তখনকার দিনের ছোটখাটো সরকারি কর্মকর্তার ছয় মাসের বেতনের সমান)। তবে আমি নিশ্চিত, সেনে হানিম আপনার জন্য কোনো বিশেষ অফার দিতে পারতেন। কিন্তু তিনি তো দুপুরের খাবার খেতে বাড়িতে গেছেন। সম্ভবত খাবারের পর এতক্ষণ ঘুমিয়েও পড়েছেন। এখন অবশ্য তাঁকে ফোন করতেও পারছি না। তবে আপনি যদি আজকে সন্ধ্যার দিকে একটু আসতেন...।'
'তার আর দরকার নেই'_বলে ওয়ালেটটা খুলে জবুথবু হাতে ন্যাতানো নোটগুলো গুনতে লাগলাম। আমার মতো জবুথবু হাতে এবং অনভিজ্ঞতার ছাপ রেখে ফুসুন হাতব্যাগটা একটা কাগজে মুড়িয়ে আরেকটা প্লাস্টিকের ব্যাগে ভরে দিল। কাজটা করার পুরোটা সময় ধরেই ফুসুন বুঝতে পারল, আমি তার মধুরঙা বাহু আর সুদর্শনা অঙ্গভঙ্গি উপভোগ করছি। ফুসুন বেশ বিনয়ের সঙ্গেই আমার হাতে ধরিয়ে দিল ব্যাগটা। আমি ওকে ধন্যবাদ দিয়ে বললাম, 'নেসিবে খালা আর তোমার বাবাকে আমার শুভেচ্ছা পেঁৗছে দিয়ো।' ওই সময় আমি ওর বাবার নামটা মনে করতে পারছিলাম না। কিছুক্ষণ স্থবির হয়ে রইলাম, যেন আমার আত্মা আমার শরীরটাকে ফেলে স্বর্গের কোনো এক কোণে গিয়ে ফুসুনকে চুম্বনে আলিঙ্গন করছে। তারপর দরজা খুলে দ্রুত বের হয়ে এলাম। দরজার বেলটা এমন সুরে বেজে উঠল, যেন ক্যানারি পাখির ডাক শুনতে পেলাম। রাস্তায় বের হয়ে বাইরের গরম হাওয়া উপভোগ করতে করতে মনে হলো, হাতব্যাগটা কিনে ভালোই হয়েছে : আমার ভালোবাসা সিবেলের জন্য ব্যাগটা সত্যিই কিনে ফেললাম। ওই দোকানের কথা আর ফুসুনের কথা ভুলে যেতে চাই।
তার পরও রাতের খাবারের সময় মাকে বললাম, সিবেলের জন্য হাতব্যাগ কিনতে গিয়ে আমাদের দূরসম্পর্কের আত্মীয়া ফুসুনের সঙ্গে হঠাৎ দেখা হয়ে গেছে।
মা বললেন, 'ও হ্যাঁ, নেসিবের মেয়ে সেনের দোকানে কাজ করে। কী লজ্জার কথা! ওরা ছুটির দিনেও আর বেড়াতে আসে না। বিউটি কনটেস্টের বিষয়টা ওদের কী এক বেকায়দা অবস্থায় ফেলে দিয়েছে। আমি প্রতিদিনই দোকানটার পাশ দিয়ে যাই। কিন্তু ভেতরে গিয়ে মেয়েটাকে একটু হাই-হ্যালো বলার মতো কাজেও মন টানে না। তার পরও মনের ভেতরে একটু খারাপ লাগবে_তাও না। কিন্তু মেয়েটা যখন ছোট ছিল, তখন আমি ওর জন্য পাগল ছিলাম। নেসিবে যখন সেলাইয়ের কাজ করার জন্য আমাদের বাড়িতে আসত, মেয়েটাও মাঝে মাঝে আসত। কাবার্ড থেকে তোর খেলনা বের করে দিতাম। ওর মা যতক্ষণ সেলাই করতেন, ও আপন মনে খেলা করত। নেসিবের মা মানে মিহরিভার খালা খুব চমৎকার মানুষ ছিলেন।'
'ওদের সঙ্গে আমাদের আত্মীয়তার সম্পর্কটা আসলে কেমন?'
বাবা টেলিভিশন দেখায় ব্যস্ত ছিলেন বলে মা তাঁর বাবার পরিবারের ওই অধ্যায় সম্পর্কে বিস্তারিত বলা শুরু করলেন। প্রজাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা কামাল আতাতুর্কের জন্ম যে বছর, আমার নানার জন্মও সেই বছর। তিনিও সেমসি এফেন্দে স্কুলে পড়াশোনা করেছেন। আমার নানা এথেম কামাল আমার নানিকে বিয়ে করার আগে আরো একটা বিয়ে করেছিলেন। মাত্র ২৩ বছর বয়সে নানার সেই বিয়েটা খুব তাড়াহুড়া করেই হয়েছিল বলে মনে হয়। নানার সেই প্রথম স্ত্রী ছিলেন ফুসুনের নানির মা। তাঁর পূর্বপুরুষদের আদি বসবাস ছিল লেবাননে। বলকান যুদ্ধে এদির্নের বিতাড়নের সময় তিনি মারা যান, যদিও ওই মহিলার গর্ভে আমার নানার কোনো সন্তান হয়নি। তাঁর আগের স্বামীর পক্ষের এক মেয়ে ছিল। তাঁর আগের স্বামী ছিল একজন শেখ। আগের স্বামীর সঙ্গে বিয়ের সময় মহিলার বয়স ছিল একেবারেই অল্প। ফুসুনের নানি নানাজানের হাতে মানুষ হয়েছিলেন। সুতরাং তাঁর এবং ফুসুনের মায়ের সঙ্গে আমাদের সরাসরি আত্মীয়তার সম্পর্ক তেমন একটা ছিল না। তবু আমার মা ফুসুনের মাকে আত্মীয়তার সেই দূরসম্পর্কের সুতোর বলেই আমার খালা বলে পরিচয় করিয়েছেন। তাঁদের বাড়ি তেসভিকিয়ের পেছনের একটা রাস্তায়। ছুটির দিন উপলক্ষে তাঁরা শেষবারের মতো যখন এসেছিলেন, মা তখন তাঁদের খুব একটা উষ্ণতায় বরণ করেননি। কারণ তাঁর দুই বছর আগে মাকে কিছু না বলে নেসিবে খালা তাঁর ১৬ বছর বয়সী মেয়ে বিউটিকে কনটেস্টে পাঠিয়েছিলেন। ফুসুন তখন মেয়েদের স্কুল নিসান্তাসিলিসিতে পড়াশোনা করছিল। পরে মা জেনেছিলেন, নেসিবে খালা ফুসুনকে ওই কাজে লজ্জা পাওয়া কিংবা বাধা দেওয়ার বদলে বরং উৎসাহ দিয়েছিলেন। মা একসময় নেসিবে খালাকে খুব ভালো জানতেন এবং সাধ্যমতো বিপদে-আপদে রক্ষা করার চেষ্টা করতেন। কিন্তু কথাটা শোনার পরে নেসিবে খালার প্রতি মায়ের মন কঠোর হয়ে যায়।
অন্যদিকে নেসিবে খালা আমার মায়ের প্রতি সব সময়ই শ্রদ্ধাবোধ পোষণ করতেন। বয়সে আমার মা তাঁর চেয়ে ২০ বছরের বড়। আর নেসিবে খালা যখন সেলাইয়ের কাজের খোঁজে ইস্তাম্বুলের অভিজাত মহলের বাড়ি বাড়ি ঘুরতেন, তখন মা তাঁকে বিভিন্নভাবে সহায়তা করতেন। 'ওরা বেপরোয়া রকমের গরিব ছিল'_মা বললেন। তাঁর কথা অতিরঞ্জনের মতো শোনাবে বলে মা আরো বললেন, 'জানিস বাছা, তখনকার দিনে শুধু ওরাই গরিব ছিল, তা নয়; তুরস্কের প্রায় সবাই গরিব ছিল তখন।' নেসিবে খালার জন্য পরিচিত বা ঘনিষ্ঠজনদের অনেকের কাছেই সুপারিশ করে দিতেন মা। আর একবার কিংবা কোনো কোনো বছর দুইবারও আমাদের বাড়িতে ডাকতেন তাঁকে। তাঁকে দিয়ে বিয়েশাদি কিংবা অন্য কোনো অনুষ্ঠানের জন্য পোশাক তৈরি করে নিতেন মা। তাঁদের ওই সেলাইকর্ম আমার স্কুল টাইমের মধ্যে চলত বলে তাঁর সঙ্গে আমার খুব একটা দেখা হয়নি। তবে ১৯৫৭ সালে একটা বিয়ের অনুষ্ঠানের জন্য জরুরি ভিত্তিতে পোশাক দরকার হওয়ায় মা নেসিবে খালাকে সুয়াদিয়েতে আমাদের গ্রীষ্মকালীন বাড়িতে ডেকেছিলেন। তৃতীয় তলার পেছনের রুম থেকে সমুদ্র দেখা যেত। ওই রুমের জানালার পাশে বসে মা ও নেসিবে খালা তালগাছের পাতার ফাঁক দিয়ে বৈঠাচালিত আর মোটরচালিত নৌকা ও পিয়ারের ওপর থেকে ছোট ছোট বাচ্চার পানিতে লাফিয়ে পড়ার দৃশ্য দেখেছেন। ইস্তাম্বুলের দৃশ্য আঁকানো সেলাইয়ের বাঙ্ খুলেছেন নেসিবে খালা। আর তাঁদের দুজনের চারপাশে তখন নেসিবে খালার কাঁচি, সুচ, গজফিতা, শিস্তি, ফিতার তৈরি ক্ষুদ্রাকৃতির পোশাকের নমুনা এবং আরো সব জিনিস থাকত। কাজের ফাঁকে তাঁদের মুখে উচ্চারিত হতো তখন গরম আবহাওয়া আর মশার উৎপাতের কথা এবং এরূপ বৈরী পরিবেশে সেলাইয়ের কষ্টের কথা। দুজন তখন দুই বোনের মতোই হাস্য-কৌতুকেও মেতেছেন। রাতের প্রায় অর্ধেক প্রহরজুড়ে তাঁরা কাজ করেছেন আমার মায়ের সিঙ্গার সেলাই মেশিনে। আমার মনে আছে, আমাদের বাবুর্চি বেকরি ওই রুমে গ্লাসের পর গ্লাস লেবুর শরবত নিয়ে আসত। নেসিবে খালার বয়স তখন ২০ বছর; পেটে বাচ্চা। এটা-ওটা খেতে মন চাইত। দুপুরের খাওয়ার সময় মা হালকা হাসির সুরে বেকরিকে বলতেন, 'বাচ্চা-পেটে মায়ের যখন যা খেতে মন চায়, তা-ই দিতে হবে। নইলে পেটের বাচ্চাটা দেখতে কুৎসিত হবে।' তখন আমি উৎসাহ নিয়ে তাঁর ছোটখাটো পেটের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। ফুসুনের প্রতি সেটাই ছিল আমার প্রথম আগ্রহের সময়। অবশ্য তখন আমরা কেউই জানি না নেসিবে খালার পেটের মধ্যে ছেলে আছে না মেয়ে।
মনে হলো, মা ফুসুনের বিষয়টা আরেকটু ফাঁপিয়ে বললেন, 'নেসিবে ওর মেয়েকে বিউটি কনটেস্টে পাঠানোর কথা মেয়ের বাবাকেও বলেনি। মেয়ের বয়স সম্পর্কে মিথ্যা তথ্য দিয়ে কনটেস্টে পাঠিয়েছিল। ভাগ্যিস মেয়েটা জিততে পারেনি। তা না হলে বাইরে ওর বদনামের অন্ত থাকত না। স্কুল কর্তৃপক্ষ এখনো আভাস পায়নি। খবর পেয়ে গেলে মেয়েটাকে স্কুল থেকে বের করে দিত। লিসি স্কুলের পড়াশোনা এত দিন হয়তো শেষ করে ফেলেছে মেয়েটা। ও সম্ভবত আর পড়াশোনার মধ্যে নেই। অবশ্য ওর বিষয়ে সঠিক কিছু জানি না। ছুটির দিনগুলোতে এখন আর ওরা বেড়াতেও আসে না। কোন ধরনের মেয়েরা, কোন ধরনের নারীরা বিউটি কনটেস্টে যায়, সেটা জানে না এমন মানুষ কি দেশে আছে নাকি? তোর সঙ্গে কেমন আচরণ করল ফুসুন?'
মা এভাবেই হয়তো ইঙ্গিত দিলেন, ফুসুন হয়তো অন্য পুরুষদের সঙ্গে বিছানায় যাওয়া শুরু করেছে। 'মিলিয়েত' পত্রিকায় অন্যান্য প্রতিযোগীর সঙ্গে ফুসুনের ফটোগ্রাফ ছাপা হওয়ার সময় নিসান্তাসি স্কুলের আমার একসময়কার বন্ধুরাও এ রকমই মন্তব্য করেছে। তবে পুরো বিষয়টা আমার কাছে বিব্রতকর মনে হওয়ায় আমি আর আগ্রহ দেখাইনি। মায়ের সামনে আমি নীরব থাকলাম। কিছুক্ষণ পর মা আমার দিকে আঙুল তুলে সতর্ক করে দিয়ে বললেন, 'সাবধান থাকিস। একটা চমৎকার, সুদর্শনা আর গুণবতী মেয়ের সঙ্গে তোর বাগ্দান হতে যাচ্ছে। সিবেলের জন্য যে পার্সটা কিনেছিস, সেটা আমাকে দেখাচ্ছিস না কেন?' তারপর বাবাকে ডেকে বললেন, 'মমতাজ, দেখো, কামাল সিবেলের জন্য একটা পার্স কিনে এনেছে।' বাবা টিভির পর্দা থেকে চোখ না তুলেই ছেলে এবং ছেলের প্রিয়তমা কতটা সুখী, সে ব্যাপারে নিজের সন্তুষ্টি প্রকাশ করে বললেন, 'সত্যি?'
আশাপাশের ভবনগুলোর ভিত কাঁপিয়ে রাস্তা দিয়ে যখন সাতসাতের কেরানিদের সমবয়সী ব্যস্ত গাড়িঘোড়া চলত, তখন আমার প্রণয়িনী সিবেল চলে আসত আমার সঙ্গে দেখা করতে। কাজের অবসরে অফিসেই আমরা শারীরিক মিলনের স্বর্গীয় স্বাদ নিতাম। ইউরোপ থেকে সিবেল আধুনিক ও নারীবাদী ধারণা নিয়ে এলেও সেক্রেটারিদের সম্পর্কে তার মতামত ছিল আমার মায়ের মতামতের মতোই। মাঝেমধ্যে বলে ফেলত, 'অফিসে এসব করতে আমার মন চায় না। নিজেকে তোমার একজন সেক্রেটারির মতোই মনে হয়।' কিন্তু তার কথায় কান না দিয়ে তাকে সোফার দিকে নিয়ে যাওয়ার সময় পরিষ্কার বুঝতে পারতাম, সে আসলে তখনকার দিনের তুরস্কের অন্য মেয়েদের মতোই আছে_বিয়ের আগে যৌন মিলনে তার ভয়।
পশ্চিমা ধাঁচের ধনী পরিবারের যেসব মেয়ে ইউরোপে সময় কাটিয়ে এসেছে, তারা এ নিষেধের বেড়াজাল থেকে আস্তে আস্তে বের হয়ে আসার চেষ্টা করে এবং বিয়ের আগে তাদের ছেলেবন্ধুদের সঙ্গে যৌন মিলনের অভিজ্ঞতা অর্জন করে। সিবেল নিজেও মাঝেমধ্যে নিজেকে ওই সব সাহসী মেয়ের অন্যতম বলে মনে করত। আমার সঙ্গে তার শারীরিক মিলন ঘটেছিল এগারো মাস আগে। তার নিজের পক্ষে যুক্তিটা ছিল_ আমাদের বিয়ের পাকা কথা অনেক আগেই ঠিক হয়ে গেছে এবং আমাদের বিয়ের খুব বেশি দেরি নেই। অবশ্য সিবেলের সাহসকে আমি বাড়িয়ে দেখানোর চেষ্টা করছি না। সে যখন বুঝতে পেরেছিল আমি বিয়ের সিদ্ধান্তে সত্যিই সিরিয়াস, আমার মতো মানুষকে বিশ্বাস করা যায় বলে যখন তার আত্মবিশ্বাস তৈরি হলো কিংবা অন্য কথায় সে যখন বুঝতে পারল আমাদের বিয়েটা সত্যিই হবে, তখনই কেবল সে নিজেকে আমার কাছে সমর্পণ করেছে। নিজেকে ভদ্র ও দায়িত্ববান মনে করতাম বলেই তাকে বিয়ে করার সব ইচ্ছাই আমার ছিল। কিন্তু যদি ইচ্ছা না থাকত, তাহলে সে আমার কাছে তার কুমারীত্ব বিকিয়ে দিয়েছে বলে কোনো রকম দায়বদ্ধতা থাকত না আমার। খোলা মনের ও আধুনিক হওয়ার মতো যে সাধারণ বিষয়টা আমাদের মধ্যে ছিল, তার ওপর একটা দায়বদ্ধতা তৈরি করল আমাদের এই বিবাহপূর্ব মেলামেশার ব্যাপারটা। তার কারণে আমরা একে অন্যের সঙ্গে আরো ঘনিষ্ঠ হয়ে গেলাম।
সিবেল মাঝেমধ্যে খুব গুরুত্বসহকারে আমাদের বিয়ের একটা দিন-তারিখ ঠিক করার কথা বলত। সে কারণেও দায়বদ্ধতাটা আরো বেশি করে চেপে বসত। তবে অন্যান্য সময় যখন হালাস্কারগাজি এভিনিউতে গমগম শব্দে গাড়িঘোড়া চলাচল করছে, লোকজনের ব্যস্ততায় আরো সব কোলাহল চলছে আর আমরা অফিসের ভেতরে রতি মিলনের সুখানুভূতিতে ডুবে গেছি, তখন আমরা দুজনই খুব উপভোগ করেছি। মনে আছে, অফিসের আবছা অন্ধকার কক্ষে আমার বাহুডোরে তাকে জড়িয়ে আমি মনে মনে বলছি, আমি কত সুখী; বাকি জীবনও তাকে নিয়ে আমার কত সুখে কাটবে! একদিন আমাদের ওই রকম সুখের অভিজ্ঞতার পর সাতসাতের লোগোসংবলিত একটা ছাইদানিতে সিগারেটের শেষ অংশটা গুঁজে দিচ্ছিলাম, আমার সেক্রেটারির চেয়ারে বসে সিবেল টাইপরাইটারে আঙুল দিয়ে খটাখট করে যাচ্ছিল আর তখনকার দিনের একটা হাস্যরসের ম্যাগাজিনে উপস্থাপিত এক নারীর সুস্পষ্ট শরীরী আবেদন দেখে জোরে জোরে হাসছিল।
যেদিন তাকে ওই পার্সটা কিনে দিলাম, সেদিন সন্ধ্যায় ফুয়ে রেস্তোরাঁয় ডিনারের পর সিবেলকে জিজ্ঞেস করলাম, 'মেরহামেত অ্যাপার্টমেন্টে আমার মায়ের যে ফ্ল্যাটটা আছে, এর পর থেকে ওখানে আমাদের দেখা-সাক্ষাতের ব্যবস্থা করলে ভালো হয় না? বাড়িটার পেছনে কী চমৎকার একটা বাগান!'
সিবেল জিজ্ঞেস করল, 'বিয়ের পর আমাদের দুজনের নতুন বাড়িতে ওঠার ব্যাপারটা কি আরো পিছিয়ে দিতে চাও?'
'না ডার্লিং, সে রকম কিছু বোঝাচ্ছি না আমি।'
'আমি তোমার সঙ্গে গোপনে লুকিয়ে-চুরিয়ে আর এ রকম করতে পারব না। তাতে মনে হয় আমি তোমার ভাড়া করা কোনো মহিলা।'
'ঠিকই বলেছ।'
'ওই ফ্ল্যাটে দেখা করার বুদ্ধিটা কোথা থেকে পেলে তুমি?'
'বাদ দাও ওসব'_বলে প্লাস্টিক ব্যাগে মোড়ানো পার্সটা বের করছিলাম আর আমার চারপাশের মানুষজনের হৈচৈ, আনন্দ দেখছিলাম।
কোনো উপহার হতে পারে অনুমান করেই সিবেল জিজ্ঞেস করল, 'কী এটা?'
'একটা সারপ্রাইজ, খুলে দেখো।'
'সত্যি?' প্লাস্টিক ব্যাগটা খুলে পার্সটা বের করার সময় তার সারা মুখে ছড়িয়ে পড়ল শিশুসুলভ হাসি। পরমুহূর্তেই হতাশায় হাসিটা উবে গেল। সিবেল অবশ্য হতাশা ঢাকার চেষ্টাও করল।
'তোমার কি মনে আছে, গত রাতে তোমাকে যখন বাড়ি পেঁৗছে দিতে যাচ্ছিলাম, তুমি ওই দোকানটাতে পার্সটা দেখে পছন্দ করেছিলে?'
'ও, হ্যাঁ। তোমার দেখি সব মনে আছে!'
'তোমার পছন্দ হয়েছে দেখে আমি খুব খুশি। আমাদের বাগ্দান অনুষ্ঠানে তোমার বাহুতে এর সৌন্দর্য দেখার মতো হবে।'
'বলতে আমার মন চাইছে না তবু বলতে হচ্ছে, আমাদের বাগ্দান অনুষ্ঠানের পার্স তো অনেক আগেই পছন্দ করা হয়েছে। মন খারাপ করো না, সোনা। তুমি এত কষ্ট করে আমার জন্য এ উপহারটা কিনেছ, সেটা কি কম নাকি। ঠিক আছে, তবে ভেবো না আমি তোমার প্রতি নির্দয় হচ্ছি : আমাদের বাগ্দান অনুষ্ঠানে এই পার্সটা হাতে নিতে পারব না। কারণ এটা নকল।'
'কী?'
'কামাল, জান আমার, এটা তো আসল জেনি কোলন নয়। এটা নকল।'
'তুমি চিনলে কী করে?'
'তুমি ভালো করে দেখো না। লেবেলটা কিভাবে চামড়ার সঙ্গে সেলাই করেছে, দেখেছ? আমি প্যারিস থেকে এই আসল জেনি কোলনটা কিনেছিলাম_এবার এটার দিকে ভালো করে তাকাও। এমনি এমনি তো ফ্রান্স আর সারা পৃথিবীতে এটার এত কদর নয়। সবখানেই এটা একটা ভিন্নধর্মী ব্র্যান্ড বলেই পরিচিত। জেনি কোলনে এ রকম সস্তা সুতা কখনোই ব্যবহার করবে না।'
আসল সেলাইয়ের দিকে তাকিয়ে মুহূর্তের জন্য আমি নিজেকে জিজ্ঞেস করলাম, আমার হবু বধূ এ রকম বিজয়িনীর সুরে কথা বলছে কেন? অবসরপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূতের মেয়ে সিবেল। তার বাবা তার দাদার সূত্রে পাওয়া সব সম্পত্তি বিক্রি করে দিয়ে এখন কপর্দকশূন্য। তার মানে সিবেল আসলে সরকারি কর্মকর্তার মেয়ে। এ বোধটাই তাকে অস্থির করেছে, অসহায়ত্বে ফেলে দিয়েছে। এ রকম অসহায় বোধ করলে সিবেল তার দাদির কথা বলত। তার দাদি পিয়ানো বাজাতেন। কিংবা দাদার কথা বলত। দাদা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। কিংবা বলত, তার দাদার খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল সুলতান আবদুল হামিদের সঙ্গে। তবে সিবেলের এই নাজুক ভাবটা আমাকে তার আরো কাছে টানত। তার প্রতি আরো ঘনিষ্ঠ ভালোবাসা জেগে উঠত আমার ভেতরে।
সত্তরের দশকের শুরুর দিকে টেঙ্টাইল ও রপ্তানি বাণিজ্যের প্রসারের সঙ্গে এবং এই প্রসারের ফলস্বরূপ ইস্তাম্বুলের জনসংখ্যা তিন গুণ হয়ে যাওয়ায় শহরাঞ্চলে এবং আমাদের নিকটবর্তী এলাকায় জমির দাম বাড়তে থাকে রকেটের গতিতে। এই স্রোতের মুখে আমার বাবার সম্পত্তি বিগত দশকে প্রায় পাঁচ গুণ বেড়ে গেছে। তথাপি আমাদের বংশীয় নামের (কাপড় উৎপাদনকারী) ওপর কোনো রকম সন্দেহ পড়তেই পারে না যে আমাদের সম্পদের কৃতিত্ব কয়েক প্রজন্মের কাপড় উৎপাদনের পেশার ওপরই প্রতিষ্ঠিত। পরিবারের ক্রমবর্ধমান সম্পদের ব্যাখ্যায়ও নিজেকে প্রবোধ দিতে পারলাম না। কারণ আমার কেনা পার্সটা ছিল নকল।
আমার ক্রমেই ডুবে যাওয়া মানসিক অবস্থা দেখে সিবেল আমার হাতটা আদর করে ধরে জিজ্ঞেস করল, 'পার্সটার দাম কত নিয়েছ?'
'পনেরো শ লিরা'_আমি বললাম। 'তুমি যদি না চাও এটা তাহলে আগামীকাল আমি বদলে নিয়ে আসতে পারব।'
'তোমাকে এটা বদলে আনতে হবে না, সোনা। তুমি বরং ওদের টাকা ফেরত দিতে বলো। কারণ ওরা তোমাকে আসলেই ঠকিয়েছে।'
'দোকানের মালিক সেনে হানিম আমার দূরসম্পর্কীয় আত্মীয়া হন'_হতাশায় ভ্রু কুঞ্চিত করে বললাম।
পার্সের ভেতরটা দেখছিলাম আমি, তখনই সিবেল আমার হাত থেকে নিতে নিতে বলল, 'তুমি কত কিছু বোঝো, সোনা! কত বুদ্ধি তোমার; কতটা সংস্কৃতিমনা তুমি, কিন্তু কোনো নারী তোমাকে কত সহজে ঠকিয়ে দিতে পারে, সে সম্পর্কে তোমার মোটেও ধারণা নেই।'
পরের দিন দুপুরে সেই একই প্লাস্টিক ব্যাগে মুড়িয়ে পার্সটা হাতে নিয়ে আমি সানজেলিজে বুটিকে আবার গেলাম। আমি ভেতরে পা বাড়াতেই বেলটা বেজে উঠল। কিন্তু আবারও সেই আবছা অন্ধকার। প্রথমে মনে হলো, ভেতরে কেউ নেই। স্বল্প আলোর দোকানটার অদ্ভুত নীরবতা ভেঙে ক্যানারি পাখিটা চিক চিক চিক করে ডেকে উঠল। তারপর একটা টবের সাইক্লামেনগাছের বিশাল পাতার ফাঁক দিয়ে দেখতে পেলাম ফুসুনের ছায়া। ফিটিং রুমে এক মহিলা পোশাক ট্রাই করে দেখছিল তার মাপমতো হয় কি না। সেই মহিলাকে সাহায্য করার জন্যই ফুসুন তার সামনে দাঁড়িয়েছিল। ফুসুন এবার পরেছে খুব চমৎকার এবং নয়ন ভোলানো একটা ব্লাউজ। কচুরিপানা রঙের একটা প্রিন্টের কাপড়ে তৈরি ব্লাউজটা। জায়গায় জায়গায় সবুজ পাতা আর বুনো ফুলের ছাপ। চারপাশে তাকিয়ে আমাকে দেখতে পেয়ে ফুসুন মিষ্টি করে হাসল।
চোখের ইশারায় ফিটিং রুম দেখিয়ে আমি বললাম, 'খুব ব্যস্ত আছ মনে হচ্ছে।'
আমার কথার জবাব দিতে গিয়ে ফুসুন বলল, 'এই তো আমাদের হয়ে গেল আর কি।' যেন অলস ভঙ্গিতে সে তার ওই ক্রেতার সঙ্গেই কথা বলছে।
এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখতে পেলাম ক্যানারি পাখিটা ওপরে-নিচে পাখা ঝাপটাচ্ছে, এক কোনায় একগাদা ফ্যাশন ম্যাগাজিন পড়ে আছে; অন্যদিকে ইউরোপ থেকে আমদানি করা বিভিন্ন জিনিস। কোনো কিছুতেই দৃষ্টি স্থির রাখতে পারলাম না। অতি সাধারণ একটা অনুভূতি বলে যতই উড়িয়ে দিতে চাই না কেন, যখনই ফুসুনের দিকে তাকিয়েছি, তাকে খুব পরিচিত এবং আপন মনে হয়েছে_এই চমকে দেওয়া সত্যটাকে কখনোই অস্বীকার করতে পারিনি। তাকে দেখতে আমারই মতো, ছোটবেলায় মাথায় হালকা কোঁকড়ানো চুল ছিল, বড় হতে হতে অনেকটা সোজা হয়ে গেছে। ফুসুনের চুলের ওপর যেন আরোপিত সোনালি রং যোগ হয়েছে তার পরিষ্কার ত্বক আর গাঢ় প্রিন্টের ব্লাউজের কারণে। আমার মনে হলো, তার জায়গায় নিজেকে স্থাপন করলে খুব সহজেই তাকে আমি গভীরভাবে বুঝতে পারব। কিন্তু তখনই আবার বেদনার্ত স্মৃতিও হানা দিল। তার সম্পর্কে অন্যদের মন্তব্য মনের ওপর ভর করতে লাগল: আমার বন্ধুরা তার কথা উল্লেখ করে বলেছে, সে যেন 'প্লেবয় পত্রিকার সামগ্রী'। ফুসুনের কি সত্যিই অন্য পুরুষদের শয্যাসঙ্গ উপভোগের অভিজ্ঞতা আছে? আমি নিজেকে বুঝিয়ে বললাম, 'পার্সটা ফেরত দিয়ে টাকা নিয়ে তাড়াতাড়ি কেটে পড়ো। তুমি তো চমৎকার একটা মেয়ের সঙ্গে বাগ্দানে আবদ্ধ হতে যাচ্ছ।' আমি বাইরে নিসান্তাসি স্কয়ারের দিকে দৃষ্টি ফেরাতে চাইলাম। ঠিক তখনই ধোঁয়াটে কাচের ভেতর ফুসুনের ভুতুড়ে অবয়বটা প্রতিফলিত হলো।
ফিটিং রুমের মহিলা স্কার্টের ভেতর থেকে নিজেকে বের করে তাড়াহুড়া করে দোকানের বাইরে চলে গেল। ফুসুন স্কার্টগুলো জায়গামতো গুছিয়ে রাখল। আকর্ষণীয় ঠোঁট দুটো আমার দৃষ্টির সামনে মেলে দিয়ে ফুসুন বলল, 'গতকাল সন্ধ্যায় আপনাকে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যেতে দেখেছি।' ফুসুন ঠোঁটে হালকা গোলাপি রঙের লিপস্টিক লাগিয়েছে। লিপস্টিকটার নাম মিসলিন, যদিও সেটা তুরস্কে সে সময় খুব পরিচিত হয়ে উঠেছে তবু ফুসুনের ঠোঁটে সেটা খুব ব্যতিক্রমী আর আকর্ষণীয় মনে হচ্ছিল।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, 'কখন দেখেছ আমাকে?'
'সন্ধ্যার একেবারে শুরুতেই। আপনার সঙ্গে ছিলেন সিবেল হানিম। রাস্তার অন্য পাশের ফুটপাত দিয়ে যাচ্ছিলাম আমি। কোথাও একসঙ্গে খেতে যাচ্ছিলেন মনে হয়?'
'হ্যাঁ।'
'আপনাদের দুজনকে খুব চমৎকার মানিয়েছে।' সুখী অল্পবয়স্কদের দেখে খুশি হলে বয়স্ক মানুষ যেমন করে বলে থাকেন, ফুসুনের কথা বলার ভঙ্গিটা সে রকম মনে হলো।
সিবেলকে সে কিভাবে চেনে তা আর জিজ্ঞেস করলাম না। আমি বললাম, 'তোমার একটু সাহায্য দরকার আমার।' ব্যাগটা খোলার সময় বিব্রতকর আর আতঙ্কগ্রস্ত মনে হচ্ছিল আমাকে। বললাম, 'এই পার্সটা ফেরত দিতে চাই।'
'অবশ্যই, আমি সানন্দচিত্তে বদলে দিতে পারি ওটা। আপনি বরং এর বদলে এই মার্জিত হাতমোজা জোড়া নিতে পারেন কিংবা এই যে হ্যাট দেখছেন, এগুলোও নিতে পারেন। প্যারিস থেকে নতুন আনা হয়েছে এগুলো। সম্ভবত সিবেল হানিম এ পার্সটা পছন্দ করেননি, তাই না?'
লজ্জিত ভঙ্গিতে বললাম, 'আমি পার্সটা বদলে নিতে চাচ্ছি না; আমি বরং টাকাটাই ফেরত চাই।'
তার মুখের ওপর হতাশা আর ভয়ের ছাপ দেখতে পেলাম। সে জিজ্ঞেস করল, 'কেন?'
আমি কিছুটা ফিসফিসিয়ে বললাম, 'এটা আসল জেনি কোলন নয় মনে হচ্ছে। মনে হয় এটা নকল।'
'কী বলছেন?'
আমি অসহায়ত্ব প্রকাশ করে বললাম, 'আমি আসলে এসব জিনিস ভালো করে চিনি না।'
সে কিছুটা কর্কশ ভঙ্গিতে বলল, 'এখানে এ রকমটি কখনো ঘটেনি। আপনি টাকাটা এখনই ফেরত চান?'
'হ্যাঁ'_আমি বোকার মতো বলে ফেললাম।
বেদনায় মুখখানা তার কালো হয়ে গেল। নিজের বোকামিতে জর্জরিত হয়ে বিকল্প চিন্তাটা এল, হায় খোদা, ব্যাগটা রেখে চলে গেলেই তো হতো; সিবেলকে বললে হতো টাকা ফেরত নিয়ে এসেছি। ফুসুনকে বললাম, 'দেখো ফুসুন, এখানে তোমার কিংবা সেনের কোনো হাত নেই। আমরা তুরস্কবাসী খোদাভক্তি দেখিয়ে থাকি : ইউরোপের ফ্যাশনের সব কিছু নকল করতে অভ্যস্ত আমরা।' বলার সময় মুখে একটুখানি হাসি নিয়ে আসার চেষ্টা করলাম। বললাম, 'আমাদের ক্ষেত্রে একটা হাতব্যাগের যে ভূমিকা, সেটা হয়ে গেলেই হলো : কোনো নারীর হাতে শোভাবর্ধন করলেই হলো। কোন ব্র্যান্ডের তৈরি, কে তৈরি করল কিংবা এটা আসল কি না_এসব বিষয় বড় কথা নয়।' তবে আমার নিজের মতোই ফুসুনও বিশ্বাস করল বলে মনে হলো না।
সে ওই একই রকম কর্কশ ভঙ্গিতে বলল, 'না, আমি আপনার টাকা ফেরত দিয়ে দিচ্ছি।' আমি নিচের দিকে তাকিয়ে নীরব হয়ে রইলাম। আমার মূর্খতার জন্য লজ্জিত হয়ে সামনে যা আছে মেনে নেওয়ার জন্য মনে মনে প্রস্তুত হলাম।
ফুসুন নিঃশব্দে কাঁদতে শুরু করল। কী এত আবেগ চলে এল বুঝে উঠতে পারিনি। তবে আমি দুই হাত দিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরতেই সে আমার বুকে মাথা রেখে কাঁদতেই লাগল। আমি ফিসফিস করে বললাম, 'ফুসুন, কেঁদো না প্লিজ, আই অ্যাম সরি।' তার নরম চুলে আর কপালে আদর করে দিয়ে বললাম, এ রকম কিছু হয়েছে ভুলে যাও প্লিজ। হাতব্যাগটা যে নকল, শুধু এটুকুই সত্য। এর পেছনে আর তো কিছু নেই।'
শিশুর মতো লম্বা শ্বাস নিয়ে দু-একবার ফুঁপিয়ে উঠল। এরপর আবারও সজোরে কান্নায় ভেঙে পড়ল ফুসুন। ওর শরীর, সুন্দর বাহুর ছোঁয়া, আমার বুকের সঙ্গে ওর বুক লেগে থাকার অনুভূতি, খুব স্বল্প সময়ের জন্য হলেও ওকে ওইভাবে ধরে থাকার কারণে আমার মাথাটা কেমন করে উঠল। সম্ভবত প্রতিবার ওকে স্পর্শ করার ফলে আমার কামনা-বাসনা জেগে ওঠার কারণে সেটাকে আমি দমন করার চেষ্টা করে যাচ্ছিলাম বলেই ওরকমটি হয়ে থাকতে পারে। আমি স্মৃতি থেকে মায়াবী সেই অনুভূতিটা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করলাম : আমরা একে অন্যকে দীর্ঘদিন ধরে চিনি এবং এতক্ষণ একে অন্যের খুব ঘনিষ্ঠ সানি্নধ্যে আছি। তবে মুহূর্তের জন্য হলেও মনে পড়ে গেল, সে আমার কান্নাজর্জর মিষ্টি বোন। আর সম্ভবত যেহেতু আমি জানতাম দূরসম্পর্কে হলেও তার সঙ্গে আমার আত্মীয়তার সম্পর্ক আছে_লম্বা লম্বা হাত-পা, কোমল হাড্ডি আর নরম-কোমল কাঁধ আমার নিজের কথাই মনে করিয়ে দিল। আমি মেয়ে হলে, আমার বয়স ১২ বছর কম হলে যা হতাম, সে তো এই। আমি ওর সোনালি চুলে আদর করতে করতে বললাম, 'ভেঙে পড়ার কিছু নেই।'
ব্যাখ্যা করার ভঙ্গিতে ফুসুন বলল, 'দেরাজটা খুলে আপনার টাকাটা দিতে পারছি না। সেনে হানিম দুপুরের খাবারের জন্য বাড়িতে যাওয়ার সময় তালা দিয়ে ওটার চাবি নিয়ে যান। কী করব, বলতে লজ্জাও লাগছে।' আবার আমার বুকে মাথা ঠেকিয়ে কান্না শুরু করল ফুসুন। আমি আদুরে আবেগে তার চুলের ওপর হাত বুলিয়ে দিতে লাগলাম। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে ফুসুন বলতে লাগল, 'আমি সময় কাটানোর জন্য, লোকজনের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করার জন্য এখানে কাজ করি! আমি টাকা-পয়সার জন্য এখানে কাজ করি না!'
বোকার মতো হৃদয়হীনভাবে বললাম, 'টাকার জন্য কাজ করাটা বিব্রত হওয়ার মতো কিছু নয়।'
অবোধ বিষণ্ন শিশুর মতো বলে উঠল ফুসুন, 'হ্যাঁ, আমার বাবা একজন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক...। দুই সপ্তাহ আগে আমার বয়স ১৮ হয়েছে। আমি মা-বাবার বোঝা হয়ে থাকতে চাইনি।'
আমার ভেতরে যৌন পশুটা মাথা বের করার চেষ্টা করছে আশঙ্কায় আমি ওর চুলের ওপর থেকে আমার হাত সরিয়ে নিলাম। ফুসুন সম্ভবত বিষয়টা খুব তাড়াতাড়িই বুঝতে পারল। সেও নিজেকে সামলে নিল। আমরা দুজনই পিছিয়ে দাঁড়ালাম।
চোখ মুছতে মুছতে ফুসুন বলল, 'আমি যে কান্নাকাটি করেছি, এ কথা কাউকে বলবেন না, প্লিজ।'
'ঠিক আছে, বলব না। আমি প্রমিজ করছি, ফুসুন। এটা দুই বন্ধুর মধ্যে পবিত্র প্রতিজ্ঞা হয়ে থাকবে। আমাদের দুজনের গোপন বিষয়ে একে অন্যকে বিশ্বাস করতে পারি।'
ওর মুখে হাসি ছড়িয়ে পড়ল। আমি বললাম, 'পার্সটা এখানেই রেখে যাচ্ছি। টাকা নিতে পরে আসব।'
'ঠিক আছে, রেখে যেতে পারেন। তবে টাকা নিতে আপনার নিজের আসার দরকার নেই। সেনে হানিম জোর দিয়ে বলতে থাকবে, এটা নকল নয়। শেষে আপনার আফসোস হবে।'
'তাহলে অন্য কিছুর সঙ্গে বদল করে নেওয়া যেতে পারে।'
'না না, সেটা আর করার দরকার নেই'_ফুসুন আন্তরিক হয়ে কপট রাগ দেখিয়ে বলল।
আমি সম্মত হয়ে বললাম, 'ঠিক আছে। তার আর দরকার নেই।'
দৃঢ়তার সঙ্গে ফুসুন বলল, 'না, একেবারে বাদ দিয়ে যেতে হবে না। সেনে হানিম এলে আমি তার কাছ থেকে আপনার টাকা নিয়ে রাখব।'
উত্তরে আমি বললাম, 'আমি চাই না তুমি আবার ওই মহিলার কাছেও বিব্রত হও।'
'আপনি ভাববেন না। কী করে টাকা ফেরতের ব্যবস্থা করতে হবে আমি জানি'_হালকা করে হাসার চেষ্টা করে ফুসুন বলল। 'আমি বলতে চাইছি, সিবেল হানিমের এ রকম হাতব্যাগ একটা আছে। সে জন্যই সে এটা ফেরত দেওয়ার চেষ্টা করছে। ঠিক আছে?'
আমি বললাম, 'চমৎকার আইডিয়া। তবে ওই কথাই সেনে হানিমকে আমি নিজে বললে অসুবিধা কোথায়?'
'না, আপনি বলবেন সেটা আমি চাই না'_ফুসুন জোর দিয়ে বলল। 'কারণ তিনি আপনাকে বেকায়দায় ফেলে ব্যক্তিগত কথা বের করার চেষ্টা করবেন। দোকানে আসবেন না। দরকার হলে আপনার টাকা আমি ভেসিহে খালার কাছে রেখে আসব।'
'না না, মাকে এর মধ্যে জড়িয়ো না। মা আরো বেশি খুঁতখুঁতে।'
'ফুসুন ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, তাহলে আপনার টাকা কোথায় রেখে আসব?'
আমি বললাম, '১৩১ তেসভিকিয়ে এভিনিউয়ের মেহরামেত অ্যাপার্টমেন্টে মায়ের একটা ফ্ল্যাট আছে। আমেরিকা যাওয়ার আগে ওই ফ্ল্যাটটা আমার লোকচক্ষুর অন্তরাল হওয়ার জায়গা ছিল। ওখানে গিয়ে পড়াশোনা করতাম, গান শুনতাম। পেছনে বাগানওয়ালা চমৎকার একটা বাড়ি। দুপুরের খাবার খেতে, কাগজপত্রের কাজকর্ম সারতে এখনো ওখানে যাই। সাধারণত দুইটা থেকে চারটার মধ্যে_এ সময়টা ওখানে কাটাই।'
'অবশ্যই আমি আপনার টাকা ওখানে দিয়ে আসতে পারব। অ্যাপার্টমেন্টের নম্বরটা কত?'
'৪'_ফিসফিসিয়ে বললাম, যেন বাকি তিনটা শব্দ বের হচ্ছিল না, আমার গলার ভেতরেই লীন হয়ে যাচ্ছিল_'তৃতীয় তলা, বিদায়'!
গোটা চিত্র আমার হৃদয়ে পরিষ্কার হয়ে ফুটে উঠল আর আমার হৃৎস্পন্দন ঘন হয়ে এল। বাইরে বের হয়ে আসার আগে শক্তি সঞ্চয় করে যেন কিছুই ঘটেনি এমনভাবে ওর দিকে শেষবারের মতো তাকালাম। বাইরে আমার সব লজ্জা আর দোষ এপ্রিলের বাতাসের অকারণ উষ্ণতার সকল স্বর্গীয় চিত্রকল্পের সঙ্গে মিশে গেল। নিসান্তাসির ফুটপাতগুলো যেন রহস্যময় কোনো হলুদবর্ণে রঞ্জিত হয়ে গেছে।
সামনে এগোনোর সময় ছায়ার নিচ দিয়ে চলার চেষ্টা করলাম, বিশেষ করে বিল্ডিংগুলোর ছায়া এবং দোকানগুলোর জানালার পাশের চাঁদোয়ার নিচ দিয়ে। ওই দোকানগুলোর পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় চোখ পড়ে গেল একটা হলুদ রঙের জগের দিকে। মন থেকে জোর তাগিদ অনুভব করলাম ভেতরে ঢুকে জগটা কেনার। বিভিন্ন জায়গা থেকে হঠাৎ করে কেনা অন্য কোনো বস্তু যতটা দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে, ওই জগটা বিগত ২০ বছরে ততটা মন্তব্য আকর্ষণ করেনি কারো কাছ থেকেই। জগটা আমাদের খাবার টেবিলে রাখা ছিল অনেক দিন। প্রথমে আমার বাবা ও মা, পরে মা ও আমি ওই টেবিলে একসঙ্গে খাবার খেয়েছি। জগটার হাতল ছোঁয়ার সময় প্রতিবারই আমার ওই সময়ের দুর্দশার কথা মনে পড়েছে। ওই সময়ের দুর্দশার কারণে আমি বাইরের মানুষের সঙ্গ ত্যাগ করে নিজেকে গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছি। জগটার হাতলে হাত দিয়ে আমি যখন স্মৃতির অতলে ডুবে গেছি, দেখেছি মা আমার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন : তাঁর চোখ ভরা দুঃখবোধ আর ভর্ৎসনা।
সেই দুপুরে বাড়ি পেঁৗছে মাকে চুমু খেয়ে অভ্যর্থনা জানালাম। আগে আগে বাড়ি ফেরা দেখে মা খুশি হয়েছিলেন ঠিকই, তবে বিস্মিতও হয়েছিলেন। মাকে বললাম, জগটা কিনেছি খেয়ালের বশে। আরো বললাম, 'মেরহামেত অ্যাপার্টমেন্টের চাবিটা দেবে, মা? অফিস মাঝেমধ্যে বড্ড বেশি হৈহল্লাপূর্ণ হয়ে যায়; আমি কোনো কাজে মনোযোগ দিতে পারি না। ভাবছিলাম অ্যাপার্টমেন্টে গেলে একটু নিরিবিলি কাজ করার সুযোগ পেতাম। আমি ছোট থাকতে ওখানে গিয়ে কাজ করে দেখেছি, ভালোই হয়।'
মা বললেন, 'এত দিনে নিশ্চয়ই এক ইঞ্চি পুরু ধুলো জমে আছে।' অবশ্য মা দেরি না করে তাঁর রুমে চাবিটা আনতেও গেলেন। চাবিটা একটা লাল ফিতার সঙ্গে বাঁধা ছিল। চাবিটা আমার হাতে দিয়ে মা জিজ্ঞেস করলেন, 'লাল ফুলের কুতাহিয়া ফুলদানিটার কথা তোর মনে আছে? বাড়িতে কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না। দেখিস তো ওখানে ফেলে এসেছি কি না। আর অত বেশি কাজ নিয়ে পড়ে থাকিস না তো। তোদের বাবা সারা জীবন কঠোর পরিশ্রম করেছেন, যাতে তোরা একটু আনন্দে থাকতে পারিস। হাসি-আনন্দে থাকাটা তোদের প্রাপ্য। বসন্তের এই সুন্দর আলো হাওয়া, সিবেলকে নিয়ে বাইরে একটু ঘুরতেও তো পারিস।'
আমার হাতের মুঠোয় চাবিটা পুরে দিয়ে একটা অদ্ভুত চাহনিতে তাকিয়ে মা বললেন, সাবধানে থাকিস। আমরা ছোট থাকতে কোনো বিষয়ে সতর্ক করে দিতে মা ওইভাবে তাকাতেন। তাঁর চাহনির অর্থ দাঁড়ায়_একটা চাবির সঠিক দেখভাল করার চেয়ে জীবনে গভীর এবং প্রতারণাপূর্ণ বিপদ থাকতে পারে, যা আগে কখনো সন্দেহের আওতায় আনাই হয়নি।

No comments

Powered by Blogger.