ধর নির্ভয় গান-শুদ্ধ সংস্কৃতিতে আমাদের মুক্তি এবং ছায়ানট by আলী যাকের

জ ছায়ানটের সুবর্ণজয়ন্তী উদ্যাপনের দিন ফিরে যেতে ইচ্ছা করে সেই তারুণ্যের দিনগুলোতে। আবার ওইসব আকাশছোঁয়া মানুষগুলোর সামনে বসে নতুন করে শুদ্ধ সংস্কৃতির পথে পথচলা শুরু করতে ইচ্ছা হয় বড়। আজকের তরুণ, যারা ছায়ানটের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কিংবা ছায়ানটের প্রতি অনুগত তাদের প্রতি আবেদন যে, শুদ্ধ সংস্কৃতিকে হাতিয়ার করে অবক্ষয়ী বাংলাদেশকে আবার আলোকোজ্জ্বল মুক্ত দেশ গড়ার শপথ নিতে হবে। তাহলেই যে লাখো মানুষের প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে এই স্বাধীনতা, তা হবে সার্থক


৩০ চৈত্র ১৯৬৯ সাল। আজ রাতের আর ঘণ্টা দুয়েক পেরোলেই পহেলা বৈশাখের সূর্যোদয় হবে বাংলাদেশে। আমরা কয়েকজন, ছায়ানটের নিতান্তই মেঠোকর্মী, নিরলসভাবে কাজে করে চলেছি রমনা পার্কের বটতলায় মঞ্চ সাজাতে। যদিও বটতলা নামটি এখন সকলেরই জানা। আসলে ওটি কিন্তু অশ্বত্থ গাছ। বোধি বৃক্ষ। উদ্ভিদ বিজ্ঞানে যার নাম ফাইকাস রিলিজিয়ন্সিস। এই গাছেরই তলায় দীর্ঘদিন ধরে উপাসনা করার পর গৌতম বুদ্ধ নির্বাণ লাভ করেছিলেন। বটগাছও একই প্রজাতির। এরও প্রথম নাম ফাইকাস। তবে দ্বিতীয় নামটি বেঙ্গলিয়ান্সিস। বোধ করি লাতিন ভাষায় উদ্ভিদ বিজ্ঞানের পাতায় বাংলা নামে এই একটি বৃক্ষই রয়েছে। রমনা উদ্যানের ওই বোধিবৃক্ষের নিচেই প্রতি বছর পহেলা বৈশাখ উদযাপন উপলক্ষে উৎসবের আসর বসায় ছায়ানট। এই যোগটি কিন্তু কাকতালীয় হলেও আমি মনে করি তাৎপর্যপূর্ণ। ছায়ানট জ্ঞানবৃক্ষের ছায়ার নিচে স্থান করে নেবে_ এই তো স্বাভাবিক। ছায়ানট আজ একটি ইনস্টিটিউশন। এর জন্ম ১৯৬১তে রবীন্দ্র শতবার্ষিকী পালন উপলক্ষে। আজ হয়তো অনেকেই ছায়ানটকে কেবল একটি সঙ্গীত শিক্ষার কেন্দ্র হিসেবে জানেন। কিন্তু যখন ছায়ানটের জন্ম হয়েছিল, তখন এর তাৎপর্য ছিল ভিন্ন। একটি জাতির নিজস্বতা, স্বকীয়তা সম্বন্ধে জানতে হলে সর্বাগ্রে প্রয়োজন তার নিজস্ব সংস্কৃতিকে চিহ্নিত করা এবং সেই সংস্কৃতির চর্চার মাধ্যমে নিজস্ব জাতিসত্তাকে বিশ্বের সামনে তুলে ধরা। এই উদ্দেশ্য নিয়েই আমার ধারণা, ছায়ানটের জন্ম হয়েছিল। ছায়ানটের যখন জন্ম হয় তখন আমি নিতান্তই কৈশোর থেকে তারুণ্যে উত্তীর্ণ হয়েছি। অতএব, তখনকার কোনো প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা আমার নেই। তবে পরবর্তী পর্যায়ে ওয়াহিদ ভাই এবং সন্্জীদা আপার সানি্নধ্যে আসার সুযোগ যখন পেলাম তখন অনুধাবন করি যে, ছায়ানটের ভূমিকা কেবল সঙ্গীত শিক্ষার বিস্তার নয়, বাঙালির আত্মপরিচয়ে তাকে দীক্ষিত করাও বটে। ছায়ানট অবশ্যই একটি সাংস্কৃতিক সংঘ। তবে এই সংস্কৃতির সংজ্ঞা আরও অনেক ব্যাপক। এতে বিধৃত আছে একটি জাতির ভাষা, লোকাচার, খাদ্য, মূল্যবোধ, পরিচ্ছদ, শিক্ষা, আদর্শ, প্রায়োগিক শিল্পকলা ইত্যাদির নির্যাস। অতএব, যারা সেই ষাটের দশকের শুরুতেই ছায়ানটের জন্মের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন তারা নিজস্ব জাতিসত্তা নিয়ে একটি স্বাধীন বাঙালি জাতির কথাই ভেবেছিলেন।
ফিরে আসি '৬৯-এর চৈত্র মাসের সেই রাতে। আমরা কিছু মানুষ গান-বাজনা কিছুই করতাম না, ছিলাম ছায়ানটের কর্মী বাহিনী। নিজেদের আমরা বলতাম 'শতরঞ্চি টানার দল'। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে মঞ্চের পেছনে পট টাঙানো থেকে শুরু করে মঞ্চের ওপরে শতরঞ্চি বিছানো ছিল আমাদের কাজ। এ ছাড়াও গতরে খাটার তাবৎ কাজেও স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে এগিয়ে যেতাম। সেই রাতে আমরা শতরঞ্চি টানাটানি করছি আর অশ্বত্থ গাছ থেকে বিশালাকারে শুয়োপোকা সব টপটপ করে মঞ্চে পড়ছে। আমরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলাম যে, পরের দিন যখন ছায়ানটের শিল্পীরা এই মঞ্চে বসে অনুষ্ঠান পরিবেশন করবে, তখন শিল্পীদের গায়ে যদি এসব শুয়োপোকা পড়ে, তাহলে এক বীভৎস দৃশ্যের সৃষ্টি হবে। আমরা সেই শেষ রাতে ধূপধুনো জোগাড় করলাম, মশা মারার স্প্রে জোগাড় করলাম এবং মঞ্চের ওপরে দাঁড়িয়ে সেই স্প্রে ছিটানোর চেষ্ট করলাম অশ্বত্থের পাতায়। সঙ্গে সঙ্গে চারপাশ থেকে ধূপের ধোঁয়ার কুণ্ডলীও পাকিয়ে উঠতে লাগল। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই বৃষ্টির মতো শুয়োপোকা পড়তে লাগল মঞ্চের ওপর। বেশিরভাগই আমাদের শরীরে। ফলে আমাদের একেকজনের হাত, মুখ, কাঁধ চুলকাতে চুলকাতে একশেষ। কারও কারও মুখ ফুলে গেল। কিন্তু তখন জেদ চেপে গেছে। ভাবছি, মন্ত্রের সাধন কিংবা শরীর পাতন। পহেলা বৈশাখের সকালে শিল্পীরা যখন নির্বিবাদে ওই মঞ্চে বসে গান গাইছেন তখনও আমরা সারাদেহে চুনমাখা অদ্ভুত চেহারা নিয়ে মঞ্চের পেছনে মুখ গোমড়া করে বসে আছি। কিন্তু কী আনন্দ, কী আনন্দ! অনুষ্ঠান তো হচ্ছে, খুব ভালোভাবেই হচ্ছে। এই যে অতি সামান্য একটা দায়িত্বের কথা উল্লেখ করলাম এখানে, বিভিন্ন সময়ে এর চেয়ে আরও অনেক বড় দায়িত্ব পালন করেছেন আমাদের অগ্রজরা, আমাদের বন্ধুরা এবং আজও করছেন আমাদের অনুজরাও। তাই ছায়ানট আজকে তর্কাতীতভাবে বাংলাদেশের প্রধান সাংস্কৃতিক কেন্দ্র।
অন্ধকারাচ্ছন্ন পাকিস্তানি যুগের উর্দি পরিহিত সামরিক জান্তার অনুশাসনে যখন আমরা বিপর্যস্ত তখনই বাঙালি সংস্কৃতি রবীন্দ্রভাবনায় অনুপ্রাণিত হয়ে ছায়ানটের মাধ্যমে নিজস্ব অভিব্যক্তি খুঁজে পায়। প্রথম বর্ষবরণ হয় ১৯৬৭ সালে। মঞ্চ পাতা হয় এই রমনা উদ্যানের অশ্বত্থ গাছের নিচে। এই অনুষ্ঠানে প্রচলিত ধর্মাচরণের কোনো স্পর্শ নেই, অন্ধকারকে বিদূরিত করে সঙ্গীতের সংবেদন মনকে অত্যাশ্চর্য ভক্তিমাখা আনন্দরসে আপ্লুত করে তুলেছিল ওই নিবেদন। সূর্য অন্ধকারকে বিতাড়িত করে। মানুষ আলোর পিয়াসী। এই আলোকের ঝরনাধারায় সব তমসাকে দূর করে দৃপ্ত পদক্ষেপে যাত্রা শুরু হয় ছায়ানটের। বাঙালির এই উৎসব অকথিতভাবে আপনা থেকে জাতীয়তার উপলব্ধিতে সব মানুষের অন্তর ভরে তোলে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের বছর ছাড়া এই আয়োজনে কখনও ছেদ পড়েনি। ২০০১ সালে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বোমা বিস্টেম্ফারণের মাধ্যমে বাঙালির সর্বজনীন এই উৎসবকে থামানোর চেষ্টা হয়েছিল, কিন্তু অকুতোভয় বাঙালি সেই হুমকিকে গ্রাহ্য করেনি। সেই বছরের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়া কয়েকজন কিশোর শিল্পী পরবর্তী সময়ে সক্ষাৎকারে বলেছিল, পরের বছরেও তারা মঞ্চে বসে গান গাইবে। বাঙালি সংস্কৃতির এই উৎসবে তারা অংশ নেবেই।
ছায়ানটের সঙ্গে আমার সম্পর্ক সেই ইউনিভার্সিটিতে পড়ার কাল থেকেই। আমি আজকে যে সংস্কৃতিকর্মী হিসেবে মোটামুটি স্বীকৃত হয়েছি তার পেছনে ছায়ানট এবং ছায়ানটের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের অবদান সবচেয়ে বেশি। আমার ভাই এবং বন্ধু বেনুই (মাহ্মুদুর রহমান, নজরুলগীতিবিশারদ) আমার হাত ধরে ছায়ানটে নিয়ে যায়। আমাদের সংস্কৃতি বিষয়ক রুচির উন্নয়নে বেনু সর্বদাই সচেষ্ট ছিল। এ কথা অনস্বীকার্য যে, আজ সঙ্গীত সম্বন্ধে আমার যদি সামান্য কোনো সুরুচির সৃষ্টি হয় এর পেছনে প্রথমত বেনু, তারপর ছায়ানটের অবদান সবচেয়ে বেশি। শিল্পকলার প্রতি আমার আকর্ষণ ছিল ঠিকই কিন্তু শিল্পকলার কোনো বিভাগেই আমি সরাসরি জড়িত ছিলাম না। আমার নাট্যকর্মের শুরু বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরে। ছায়ানটে গিয়ে গানের অথবা বাদ্যযন্ত্রের ক্লাসগুলো থেকে ভেসে আসা সুর ক্রমে আমার হৃদয়ে প্রবেশ করে। আমি রবীন্দ্রসঙ্গীত, নজরুলগীতি এবং ভারতীয় ধ্রুপদী সঙ্গীতের প্রতি বিশেষ আকর্ষণ বোধ করতে থাকি। সেই যে একবার সুরের জাদু ঢুকল আমার অন্তরে, আজ অবধি তা অক্ষয় রয়ে গেছে। আজকের কোনে লঘুসঙ্গীতই আমাকে আর উদ্বেলিত করে না।
ছায়ানটের সংস্পর্শে আসার পর বোধ করি আমার সবচেয়ে বড় পাওয়া, ওয়াহিদ ভাই, ওয়াহিদুল হকের সানি্নধ্য এবং সন্্জীদা খাতুনের স্নেহ। সন্্জীদা খাতুনকে আমরা মিনু আপা বলে ডাকতাম, এখনও ডাকি। ছায়ানট ঘরানার একটা বিশেষ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হলো সংস্কৃতির শুদ্ধ পথ থেকে কোনোক্রমেই বিচ্যুত না হওয়া। এই দর্শন আমাকে সংস্কৃতির জগতে অনেক পথ অতিক্রম করতে সাহায্য করেছে এবং আমার চিন্তা-চেতনাকে ঋদ্ধ করেছে। ঋদ্ধ করেছে সৎ এবং সুন্দরের পথে পথচলায়।
ওয়াহিদ ভাই, ওয়াহিদুল হকের সঙ্গে আমার পরিচয়ের দিনক্ষণ এখন আর মনে নেই। বেনু তখন ছায়ানটের সঙ্গে একেবারে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আমি সদ্যই বিশ্ববিদ্যালয় পেরিয়ে কোনো একটি পেশায় লগ্ন হওয়ার চেষ্টা করছি। অখণ্ড অবসর। বেনু ওর বাড়ির চিলেকোঠায় থাকত। সেখানে অনেক রাত অবধি ও গলা সাধত। মাঝে মধ্যে কোনো বিশেষ রাগে আলাপ অথবা ত্রিতালে গান ধরত। এ সময় শখের বসে ঠেকা কাজ চালানোর জন্য তবলায় চাটি মারতাম। বেনুর সঙ্গে ছায়ানটে গিয়েই ওয়াহিদ ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয়। আমার সঙ্গে ওর বয়সের ব্যবধান অনেক বছরের। কিন্তু ঝটিতি তিনি আমাকে তার বন্ধু বানিয়ে নিলেন। সেই শুরু। তারপর প্রায় ভূতে পাওয়া মানুষের মতোই এখন, তখন তার কাছে চলে এসেছি কী এক অদ্ভুত আকর্ষণে। সেই সময়েই বাংলা সংস্কৃতি কী সেটা উপলব্ধি করা, ওই সংস্কৃতির প্রতি সম্পূর্ণ আনুগত্য এবং আত্মসমর্পণ এই প্রক্রিয়াটি ঘটেছিল ওয়াহিদ ভাইয়ের সানি্নধ্য পাওয়ার কারণেই। ওই সময়ই উপলব্ধি করেছিলাম একটা সংস্কৃতিতে জন্মগ্রহণই যথেষ্ট নয়। সেই সংস্কৃতিকে জানতে হবে, বুঝতে হবে এবং নিজের মধ্যে ধারণ করতে হবে। আমি সমাজতত্ত্বের ছাত্র। কিন্তু সমাজে প্রচলিত প্রতিটি সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সম্বন্ধে সমাজতাত্তি্বক বিশেষণ একেবারে নির্মোহভাবে করতে শিখেছি ওয়াহিদ ভাইয়েরই কাছে। মাঝে মধ্যে অবাক বিস্ময়ে ভাবতাম, 'আচ্ছা, একজন মানুষের পক্ষে এত কিছু বিষয়ে জানা কীভাবে সম্ভব?' ওয়াহিদ ভাই চলে যাওয়ার পরে তার ছায়ানটের এক ছাত্র কোনো এক ইংরেজি পত্রিকায় লিখেছেন যে, ওয়াহিদ ভাইয়ের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা ছিল না বরং একধরনের ভয় মেশানো শ্রদ্ধা নিয়ে তার কাছে গান শিখত তরুণটি। একদিন সে ক্লাসে ঢুকে দেখল যে ওয়াহিদ ভাই তার তরুণ ছাত্রছাত্রীদের কোয়ান্টাম মেকানিক্স বোঝাচ্ছেন। তার এহেন জ্ঞানের পরিধি দেখে তরুণটি প্রায় বাক্যহারা হয়ে পড়েছিলেন। তারপর থেকে ওয়াহিদ ভাই হয়ে উঠেছিলেন তার জ্ঞানগুরু। আমার মনে আছে, বেনুর সঙ্গে সংখ্যাতত্ত্বের দুরূহ সব সংজ্ঞা নিয়ে অবলীলায় আড্ডা জমাতে পারতেন তিনি। ১৯৭৮ সালে সারা যাকের ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের ছাত্রী তখন, এমনিতেই আজীবন বিজ্ঞানের ছাত্রী, বিজ্ঞান ছেড়ে সাহিত্যের অঙ্গনে প্রবেশ করে স্বাভাবিক কারণেই একটু অসহায় বোধ করছিল। পাশ্চাত্য দর্শনের ওপরে কিছু একটা জানার জন্য ওয়াহিদ ভাইকে জিজ্ঞেস করেছিল একদিন। ওয়াহিদ ভাই বলেছিলেন জবাবটা পরে দেবেন। এর দু'দিন পরেই তিনি আমাদের বাসায় এসে সারার হাতে একটা বই তুলে দিয়েছিলেন। সাধন কুমার ভট্টাচার্যের লেখা অ্যারিস্টোটলের পোয়েটিক্সের ওপর বিশদ একটি আলোচনা। মলাটের পর প্রথম পৃষ্ঠাটিতেই স্বহস্তে লিখে দিয়েছিলেন, 'সারাকে ওহিদুল_সেদিনের প্রশ্নের জবাব সম্যক জানা না থাকায়।' সেই বইটি অনেক বইয়ের ভিড়ের মধ্য থেকে খুঁজে বের করলাম, যেদিন তিনি চলে গেলেন। তার সুন্দর হাতের লেখা এখনও জ্বলজ্বল করছে।
ওয়াহিদ ভাইয়ের সঙ্গে শেষ দেখা ছায়ানট ভবনের উদ্বোধনের দিন। তার বক্তৃতা শুনে ভাবতে ভাবতে বেরিয়ে এলাম মিলনায়তন থেকে। ওয়াহিদ ভাই একটা সাবধানবাণী উচ্চারণ করেছিলেন ওই বক্তৃতায়। তিনি বলেছিলেন, ছায়ানটের ভবিষ্যৎ কর্ণধাররা যেন ভুলে না যান যে, এই প্রতিষ্ঠানটি ভবনটির চেয়ে অনেক বড়। এই কথাটি এখনও আমার কানে বাজে। অবশ্য ছায়ানটের ব্যাপারেই কেবল বলা সম্ভব যে ছায়ানট স্বমহিমায় উজ্জ্বলভাবে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পরই কেবল নিজস্ব ঘর পেল। তবুও তার শঙ্কার কথা তিনি একেবারে নিঃশঙ্ক চিত্তে বলেছিলেন। এমনই ছিলেন ওয়াহিদ ভাই।
বলতে বসেছিলাম ছায়ানট সম্বন্ধে। ঘুরেফিরে ওয়াহিদ ভাইকে নিয়ে অনেক কথা বলা হয়ে গেল। আজ তিনি নেই বলে হয়তো তার সম্বন্ধে বলার সাহস পেলাম। জীবিত থাকলে এত কথা বলা হতো না। তিনি বিব্রতবোধ করতেন। তবে এ কথা অনস্বীকার্য যে, ওই মাপের সব মানুষ যেমন সন্্জীদা আপা, আহমেদুর রহমান, সাইফুদ্দৌলা, জাহেদুর রহিম এবং তাদের মাথার ওপরে আমাদের সকলের পরম শ্রদ্ধাভাজন বেগম সুফিয়া কামাল না থাকলে এত বড় একটা কর্মযজ্ঞ শুরু করা এবং এখন পর্যন্ত জঙ্গমভাবে চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হতো কি-না কে জানে।
আজ ছায়ানটের সুবর্ণজয়ন্তী উদ্যাপনের দিন ফিরে যেতে ইচ্ছা করে সেই তারুণ্যের দিনগুলোতে। আবার ওইসব আকাশছোঁয়া মানুষগুলোর সামনে বসে নতুন করে শুদ্ধ সংস্কৃতির পথে পথচলা শুরু করতে ইচ্ছা হয় বড়। আজকের তরুণ, যারা ছায়ানটের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কিংবা ছায়ানটের প্রতি অনুগত তাদের প্রতি আবেদন যে, শুদ্ধ সংস্কৃতিকে হাতিয়ার করে অবক্ষয়ী বাংলাদেশকে আবার আলোকোজ্জ্বল মুক্ত দেশ গড়ার শপথ নিতে হবে। তাহলেই যে লাখো মানুষের প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে এই স্বাধীনতা, তা হবে সার্থক।

আলী যাকের :সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব

No comments

Powered by Blogger.