কুড়িয়ে পাওয়া সংলাপ-উন্মাদ বকিবে উন্মাদের মতো by রণজিৎ বিশ্বাস

পনার আজকের 'কুড়িয়ে পাওয়া সংলাপ' পড়িনি। ইচ্ছে হয়নি। মনোটোনাস!: পড়তেই হবে, কোনো কথা তো নেই!: তা নেই, তবে আপনার লেখা আমি কষ্ট করে হলেও পড়ি।: কষ্ট করে কেন পড়তে হবে! বাজারে তো লেখার অভাব নেই!: তার পরও আপনারটা পড়ি কৌতুকের বশে ও আবিষ্কারের আনন্দে।: কিসের কৌতুক? কিসের আনন্দ? আমি কি পাগল নাকি!: পাগল আপনি হতে যাবেন কেন!


আরো উচ্চ পর্যায়ে আপনার গ্র্যাজুয়েশন হয়েছে। আপনি উন্মাদ। একজন মান্যবর ও মহামহিম উন্মাদ। অবশ্য, আপনার উন্মাদনা স্বঘোষিত। আপনি অনেক দিন ধরে বলেই বেড়াচ্ছেন_একটি বিষয়ে আপনি উন্মাদনা দেখিয়েই যাবেন এবং আপনি তা দেখাবেন 'মরতে দম তক'। যতক্ষণ কণ্ঠের গোড়ায় প্রাণ আছে, আপনি মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ, মানবতা, উদারতা, সততা, সুশিক্ষা, সুরুচি, অসাম্প্রদায়িকতাসহ সকল প্রকার শুভবুদ্ধি ও সুন্দরের পক্ষে চিৎকারে চিৎকারে গলা ফাটাবেন, মুখে রক্ত তুলবেন এবং আত্মশক্তি উজাড় করবেন এবং তার বিরুদ্ধে যারা সরাসরি ও ছদ্মবেশে দাঁড়ায় বিভিন্ন 'রেসিপি'তে তাদের নিপাত কামনা করবেন, তাদের ধ্বংস কামনায় দু-চার গ্রাস ভাতের দলা সব সময় বেশি গিলবেন। বলেছেন কি বলেননি?
: বলেছি, বারবার বলেছি, হয়তো আজও বলব, আবার বলব। বারবার বলব। উন্মাদের মতো বলব।
: আপনার পিঠে সে জন্যই আমি উন্মাদের লেবেল লাগিয়েছি এবং লাগিয়ে সম্ভবত ভুল করিনি!
: সে বিচার পরে, এখন বলুন_দিনের শুরুতে হামলার উদ্দেশ্য কী!
: আপনি যে এক কথা বারবার বলেন; বারবার যে ওদের অমন নির্দয়ভাবে গালাগাল করেন, মায়া হয় না আপনার! ভয় জাগে না আপনার! কোথাও না কোথাও একবার থামতে ইচ্ছে করে না আপনার?!
: গালাগাল শব্দটা ভালো নয়। তা করার শিক্ষা আমি আমার গুরুজন কিংবা শিক্ষকদের কাছে পাইনি। আমি যা করার চেষ্টা করি, তার নাম হতে পারে যুক্তিনির্ভর সমালোচনা। যারা গালাগালের উপযুক্ত, তারা তাকে নিজেদের উপযুক্ততা ও প্রাপ্যতার ছাঁচে ঢালাই করে নিতে পারেন। তবু আমি পরিষ্কার করে নিতে চাই_আপনি কাদের মিন করছেন? কাদের ব্যাপারে আমার মায়া হওয়া না হওয়ার প্রশ্ন তুলছেন?
: ওই তাদের কথা, যারা মুক্তিযুদ্ধের সবচেয়ে বড় বেনিফিশিয়ারি হওয়ার পরও তার আদর্শের সঙ্গে বেইমানি করে, যারা জাতির পিতা মানে না, তাঁর সপরিবার হত্যায় হাত লাগায়, মাথা খাটায় ও শরীর ঘামায়, হত্যাকারীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয়, তাদের সসম্মান পুনর্বাসন করে, দেশের প্রতিনিধিত্বের জন্য বিদেশে পাঠায়, মন্ত্রিত্ব দেয়, সংসদে বসায়; যারা মানবতার শত্রু ও যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচানোর জন্য রাস্তায় শুয়ে পড়ে ও বাড়ি না ফেরার পণ করে_আমি তাদের কথা বলছি। যারা অসৎ, অসাধু, অশিক্ষিত, রুচিশূন্য, মৌলবাদী, সাম্প্রদায়িক, লুটেরা, ভেদবুদ্ধিঠাসা, যারা ধর্মপরিচয়, জন্মপরিচয় আদর্শপরিচয়, বিশ্বাসপরিচয় ও উপাস্যপরিচয়ের জন্য মানবসন্তানের মানহানি করে ও ন্যায্য প্রাপ্য থেকে তাদের 'মাহ্রুম' করে_তাদের কথা বলছি আমি! সেই মানুষগুলোকে আপনি বুঝি চেনেন না?! খুব বিরক্ত করেন আপনি!
: আপনার শেষ কথাটি নিয়েই আমি যুক্তির রাশ ধরতে চাইব। মানুষ বলতে আপনি কী বোঝেন, আপনিই জানেন। আমি শুধু খুব সংক্ষেপে এটুকুই বলি_মানুষের যা যা প্রাপ্য, তা ওদের প্রাপ্য নয়। যত দিন মানুষের মনে মানবতার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ থাকবে, তত দিন ওদের বিনাশ কামনা প্রাসঙ্গিক থাকবে, তত দিন হৃদিমধ্যে জ্বলমান থাকবে ওদের ভস্মাতিভস্ম করার আগুন। দ্বিতীয়, ক্লান্তি কেন আসে না; দীর্ঘদিন আপসহীনতায় কাজটি করার পরও থেমে কেন পড়ি না; বিশ্রাম কেন নিই না। আপনিই বলুন, বিশ্রাম নেওয়ার সময় কি এখনো এসেছে? থেমে পড়লেই কি ওদের শকুনিছায়া পবিত্র এ দেশের পবিত্র হরিৎ থেকে সরে যাবে!
তৃতীয়, ভয় কেন জাগে না। এ ব্যাপারে প্রথম কথা_ভয়কে ভয় পাওয়ার জায়গায় আর অবশিষ্ট রাখিনি আমি। এ মুহূর্তে আমি যদি থেমেও পড়ি, আপনি কি মনে করেন সুযোগ পেলে ওরা আমাকে ছেড়ে কথা কইবে! অতএব, প্রাণের পণে জঞ্জাল সরানোর চিৎকার করাই ভালো। দ্বিতীয় কথা, আমি একটি বিশ্ববিখ্যাত লোকের অবিস্মরণীয় একটি চিঠি থেকে দু-একটি বাক্য উদ্ধরণ করব। আব্রাহাম লিঙ্কন চিঠিটি লিখেছিলেন তাঁর ছেলেকে স্কুলে পাঠানোর সময়, হেড মাস্টারের কাছে। '...সে যেন আগেভাগেই বুঝতে শেখে, যারা পীড়নকারী তাদেরকেই সহজে কাবু করা যায়। ...তাকে শেখাবেন, ভদ্রলোকের প্রতি ভদ্র আচরণ করতে, কঠোরদের প্রতি কঠোর হতে। ...যারা নির্দয়-নির্মম_তাদের যেন সে ঘৃণা করতে শেখে। ...আমার সন্তানের যেন অধৈর্য হওয়ার সাহস না থাকে, থাকে যেন সাহসী হওয়ার ধৈর্য। তাকে এ শিক্ষাও দেবেন_নিজের প্রতি থাকে যেন তার সুমহান আস্থা, তখনই তার আস্থা থাকবে মানুষের প্রতি।'
লেখক : কথাসাহিত্যিক

No comments

Powered by Blogger.