দর্শনার্থী-মূল : আর কে নারায়ণ, অনুবাদ : জাফর আলম

ন্ত্রী মহোদয় জাঁকালো প্রাতরাশে বিশ্বাসী। যথারীতি সুষম প্রাতরাশের পর মানুষের মন, দেহ ও আত্মার মাঝে নিখুঁত সাদৃশ্য গড়ে ওঠে এবং ব্যক্তিগত, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক যেকোনো সমস্যা মোকাবিলারশক্তিঅর্জনকরে।সৌভাগ্যবশত তাঁর স্ত্রী তাঁর নির্বাচনী এলাকায় পৈতৃক বাড়িতে থাকতে পছন্দ করেন। কারণ সেখানে থাকলে তিনি ইচ্ছামতো নিঃসংকোচে রান্নার তদারকি ও নির্দেশ দিতে পারেন। বেগম সাহেবা অনধিকারচর্চায় অভ্যস্ত, স্বামীর রক্তের


কোলেস্টেরলের সীমারেখা নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য অত্যন্ত সচেতন।বেদনাদায়ক হলো, স্ত্রীরা কখনো বুঝতে চেষ্টা করেন না যে উপবাস করা প্রকৃতিবিরোধী এবং কোমরে চর্বি জমলে মেয়েদের কোনো ক্ষতি হয় না। তদুপরি মন্ত্রীর সরকারি দাপ্তরিক কাজকর্মে হস্তক্ষেপ করা উচিত নয়।
'সুস্থ দেহে সুস্থ মন' শিরোনামে একটি যুক্তিপূর্ণ প্রবাদ রয়েছে, যা সুপরিকল্পিত ও পূর্ণাঙ্গ প্রাতরাশ ছাড়া সম্ভব নয়। দিনের অন্য সব আহার গুরুত্বপূর্ণ বটে, কিন্তু প্রাতরাশের কাছে সেগুলো গৌণ। প্রাতরাশের প্রতি তাঁর মনোযোগ যাতে ব্যাহত না হয়, তাই তিনি সকালের নাশতায় কাউকে দাওয়াত দেন না। অনেকের নজর ভালো নয়, অ্যারারুটের তরল খাবারও ওরা হজম করতে পারে না; অথচ কেউ আনন্দের সঙ্গে পেট পুরে প্রাতরাশ সারলে সেদিকে কুনজর ফেলে।
সকালের নাশতা টেবিলে সাজানোর আগে একচিমটি লবণ ও গোলমরিচের গুঁড়ো মিশিয়ে এক গ্লাস কমলার রস টেবিলে সরবরাহ করা হয়। তারপর চারটি ইডলি, দুটি বেদা (দক্ষিণ ভারতীয় পিঠা) খান। ইডলির পর আলু পরোটা, দুই টুকরো সিদ্ধ (অবশ্য বিদেশ থেকে আমদানি করা) আলু মধু ও দুধের সঙ্গে আহার করলেন। তারপর বাদাম-কিশমিশসহ একটি আটার রুটি। পেঁয়াজ ও ক্যাপসিকাম মিশিয়ে তৈরি একটি ডিমের ওমলেট, কয়েক টুকরো পাকা পেঁপে আর কাবুলি আঙ্গুর খেলেন। সব শেষে এক কাপ সুস্বাদু চা, যা সকালের নাশতায় খাওয়া সব কিছু পাকস্থলীতে হজমে সাহায্য করে। অবশেষে নাশতা সেরে পান চিবোতে চিবোতে হলঘরে প্রবেশ করেন এবং মন্ত্রী মহোদয় আরামের সঙ্গে সোফায় বসে পড়েন। এবার তিনি দৈনন্দিন কাজকর্ম শুরু করতে আর যেকোনো সমস্যা মোকাবিলা প্রস্তুত।
তাঁর পিএ এসে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ নষ্ট করলেন; বললেন, 'একজন দর্শনার্থী এসেছে।'
'ভদ্রলোক কে? তাঁর কি দেখা করার সময়সূচি নির্ধারিত আছে?' মন্ত্রী মহোদয় জানতে চান। 'যা হোক, পাঠিয়ে দাও' বলে তিনি নির্দেশ দিলেন। মন্ত্রী ভাবলেন, তাঁর কাজ হলো অভিযোগ গ্রহণ করা। লোকটির কি কোনো অভিযোগ আছে? জনগণের অভিযোগ মনোযোগসহকারে শোনা এবং জনকল্যাণকর যেকোনো সমস্যা সমাধান ও মোকাবিলা করাই তাঁর কাজ।
মন্ত্রী মহোদয়ের সোফার পাশে একটি হাতলবিহীন কাঠের চেয়ারে দর্শনার্থী লোকটি বসেছিলেন। লোকটির মুখ গোমড়া, হাতে তাঁর মন্ত্রীর জন্য টাইপ করা স্মারকলিপির বান্ডেল।
মন্ত্রী মহোদয় জানতে চান, 'এটা কী?'
'একবার পড়ে দেখুন, তাহলে জানতে পারবেন।' দর্শনার্থীর উত্তর।
মন্ত্রী রেগে বললেন, 'তুমি কি আমাকে নির্দেশ দিচ্ছ?' মন্ত্রী একান্ত সহকারীকে নির্দেশ দেন, 'স্মারকলিপিটি তুমি গ্রহণ করো, আর পড়ে দেখো এতে কী আছে?' দর্শনার্থী কিন্তু দরখাস্ত হাতছাড়া করেননি। বললেন, 'আমরা এই স্মারকলিপি ব্যক্তিগত সহকারীর (পিএ) জন্য লিখিনি। আমরা আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে এই স্মারকলিপি লিখেছি। আপনি আমার ভিজিটিং কার্ড দেখুন, আমি একটি সংস্থার সভাপতি...।'
মন্ত্রী মহোদয় আবার পিএর দিকে ঘুরে তাকান আর দর্শনার্থীর ভিজিটিং কার্ড নিয়ে এসে তাঁর হাতে দিতে নির্দেশ দেন। পিএ যখন লোকটির ভিজিটিং কার্ড আনতে গেলেন, তখন দর্শনার্থী লোকটি মন্ত্রীর মুখোমুখি হয়ে আবার স্মারকলিপিটি মন্ত্রীর হাতে অর্পণের চেষ্টা করে বললেন, 'পড়ে দেখুন, তাহলে আমাদের সমস্যা বুঝতে পারবেন।'
'কী সমস্যা?'
'স্মারকলিপিতে বিস্তারিত বিবরণ আছে। পড়লে বুঝতে পারবেন।' দর্শনার্থীর উত্তর।
'এটা তো দেখি অনেক দীর্ঘ স্মারকলিপি। তুমি কি আশা করো, আমি স্মারকলিপি পড়ে দেখব?' মন্ত্রী মহোদয় বললেন।
'হ্যাঁ, অবশ্যই প্রতিটি লাইন পড়া উচিত।' দর্শনার্থীর আবদার।
'আমার আরো গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে।' মন্ত্রী বললেন।
'আবার কিসের গুরুত্বপূর্ণ কাজ? আপনি জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে এই আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছেন এবং জনগণের ট্যাঙ্ েআপনাকে ভরণ-পোষণ করা হয়।' দর্শনার্থী কর্কশ কণ্ঠে বললেন।
'আমি ব্যস্ত। সংক্ষেপে আপনি কী চাইতে এসেছেন বলুন।' মন্ত্রী মহোদয় বিনয়ের সঙ্গে বললেন।
লোকটি স্মারকলিপির বান্ডেলটি ছোট্ট চায়ের টেবিল থেকে হাতে তুলে নেন আর বিড়বিড় করতে করতে বাইরে চলে যান। মন্ত্রী অসহায়ভাবে দর্শনার্থীর নিগর্মন দেখেন আর পিএকে জিজ্ঞেস করেন, "লোকটি চলে যাওয়ার সময় কী শব্দ উচ্চারণ করেছে? এমন শব্দ অর্থাৎ 'বোকা'।"
"আপনি আমাকে ক্ষমা করবেন, আমি তাকে 'অসভ্য বোকা' বলতে শুনেছি।" পিএর উত্তর।
'তার এত সাহস! তাকে ডেকে আনুন। তাকে এভাবে চলে যেতে দেওয়া যায় না।' মন্ত্রী মহোদয় ক্ষোভের সঙ্গে বললেন।
'বিনা কারণে তাকে তো ডেকে আনা যায় না, স্যার।' পিএ বললেন।
'তাড়াতাড়ি যান; বলবেন, আমি চায়ের আমন্ত্রণ জানিয়েছি।' এরপর মন্ত্রী সাহেব বাবুর্চিকে ডেকে চায়ের অর্ডার দিলেন।
দর্শনার্থী আবার ফিরে এসে মন্ত্রী মহোদয়ের সামনে বসে চা পান করলেন।
চা পান শেষ হলে দর্শনার্থীকে মন্ত্রী মহোদয় জিজ্ঞেস করেন, 'আপনি আমাকে বোকা বলেছেন?'
'না, তা বলিনি। আমি শুধু হাবা বলেছি।' দর্শনার্থীর উত্তর।
'আপনার এ কথা বলার কারণ কী?' মন্ত্রী মহোদয় জানতে চান।
দর্শনার্থী বললেন, 'আমি আপনাকে এ কথা বলার আটচলি্লশটি কারণ দেখাতে পারি।'
'আপনি আমাকে কারণগুলো লিখিতভাবে জানান। অন্যথায় আমি এ ব্যাপারে আপনার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হব।' মন্ত্রী কড়া স্বরে বললেন।
'সেটা লিখলে আরেকটি অধ্যায় হবে। ঠিক আছে, আমি সেটা রেজিস্টার্ড ডাকে পাঠিয়ে দেব।' এ কথা বলার পর দর্শনার্থী হঠাৎ উঠে দাঁড়ান আর দ্রুত স্থান ত্যাগ করেন।
এবারও মন্ত্রী মহোদয় দর্শনার্থী লোকটির চলে যাওয়ার দৃশ্যটি অসহায়ভাবে তাকিয়ে দেখতে থাকেন এবং কর্কশ স্বরে বললেন, 'লোকটিকে এখনই বরখাস্ত করা উচিত।'
পিএ বললেন, 'স্যার, আমরা তাকে বরখাস্ত করতে পারি না। কারণ সে সরকারি কর্মচারী নয়।'
'তাহলে আমরা কী করতে পারি?' মন্ত্রী জিজ্ঞাসু নেত্রে পিএর দিকে তাকান।
পিএ প্রস্তাব দিলেন, 'আমরা তাকে প্রথমে কোনো সরকারি পদে নিয়োগ করতে পারি, তারপর তাকে বরখাস্তের কথা চিন্তাভাবনা...।'
'ভালো পন্থা বটে, তাহলে কিভাবে?' মন্ত্রী মহোদয় জানতে চান।
'আমার কাছে তার ভিজিটিং কার্ড আছে। সে একটি সংস্থার সভাপতি। মান্যবর মন্ত্রী মহোদয় তাকে সভাপতি হিসেবে নিয়োগদান এবং বরখাস্ত করার ক্ষমতা রাখেন।' পিএ তাকে আশ্বস্ত করলেন।
'উত্তম পরিকল্পনা। জাতীয়করণের প্রস্তাবের খসড়া তৈরি করুন এবং সরকারি গেজেটে প্রকাশের জন্য প্রেসে পাঠিয়ে দিন। প্রেসের গেজেট সংকলকের সঙ্গে ফোনে আমাকে যোগ করিয়ে দিন, আমি তার সঙ্গে কথা বলব।' মন্ত্রী নির্দেশ দিলেন।
পিএ মাথা ঝুঁকিয়ে বললেন, 'ইয়েস স্যার।'

[ভারতের আন্তর্জাতিক ইংরেজি ভাষার লেখক আর কে নারায়ণ। জন্ম ১৯০৬ সালে, চেন্নাইয়ে (তৎকালীন মাদ্রাজ)। ১৯৩৫ সালে তাঁর প্রথম উপন্যাস 'সোয়ামি অ্যান্ড ফ্রেন্ডস' প্রকাশিত হয়। তাঁর রচিত গল্প-উপন্যাস বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে। ১৯৫৮ সালে তিনি 'গাইড' উপন্যাসের জন্য ভারতীয় সাহিত্য একাডেমী পুরস্কার লাভ করেন। সাহিত্যে অবদান রাখার জন্য তাঁকে ১৯৬৪ সালে 'পদ্মভূষণ' উপাধিতে ভূষিত করা হয়। ১৯৬৯ সালে তিনি ভারতীয় রাজ্যসভার সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০১ সালে অমর এই কথাশিল্পী চেন্নাইয়ে পরলোকগমন করেন। 'ভিজিটর' (দর্শনার্থী) গল্পটি লেখকের 'সল্ট অ্যান্ড স ডাস্ট' গ্রন্থ থেকে নেওয়া হয়েছে। তাঁর কৌতুকপূর্ণ ছোটগল্পগুলো সূক্ষ্মরসে ভরপুর।]

No comments

Powered by Blogger.