বুদ্ধদেব বসু-তাঁর প্রাসঙ্গিকতা by কাজল বন্দ্যোপাধ্যায়

বুদ্ধদেব বসুর জন্মদিন আরও একবার এসে গেল। তাঁর শততম জন্মদিনে আমরা ঢাকা বিশ্ব্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে কোনো কর্মসূচি, কিচ্ছুটি করিনি। অথচ প্রাপ্ত নম্বরের দিক থেকে দেখলে তিনি এখন অব্দি এ-বিভাগের উজ্জ্বলতম ছাত্র। সে যাক। বুদ্ধদেবের এবারের জন্মদিন উপলক্ষে ক'টি ভাবনায় যাওয়া যাক।বুদ্ধদেব বসু প্রসঙ্গে আধুনিকতার ধারণাটি বেশি প্রাসঙ্গিক। পশ্চিম-ঘেঁষা আধুনিকতা।


তাঁর রচনা এবং কর্মকাণ্ড এই ধারণাকেই আমলে নিয়ে আসে। এর অনেক সীমাবদ্ধতা, পিছুটান, ব্যর্থতা রয়েছে। কিন্তু ঔপনিবেশিক পটভূমির প্রাচ্য-এলাকায় এরও কিছু ইতিবাচক ভূমিকা ছিল। ঢাকার কবি-লেখকরা কলকাতায় বুদ্ধদেব বসু এবং তাঁর সঙ্গীদের রচনা ও কর্মকাণ্ডকে আগ্রহের সঙ্গে, প্রশংসার সঙ্গে লক্ষ্য করেছেন; লেনদেন হয়েছে। ঢাকায় আমরা সবটা হয়তো খুশি হতে পারিনি। অনেক গণ্ডিবদ্ধতা লক্ষ্য করেছি। তারপরও আমাদের প্রধান আধুনিক কবিরা কলকাতার তিরিশের কবিদের রচনারীতি, ভাবনাজগৎ ইত্যাদিকে মূল্যবান ভেবেছেন। পাকিস্তান-পরিস্থিতির চাপ এবং তাকে অতিক্রম করার আকাঙ্ক্ষা তাদের ছিল। তাই যা কিছু বিরোধ-ব্যবধান, তারপরও সংযোগ ঘটেছে। আমাদের নিজস্ব/স্থানীয় আধুনিকতা, আধুনিক সাহিত্য গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার স্রোতটিতে এই আধুনিক সাহিত্যের খুব বড় অবদান ছিল। এর লেখক-কবিরাই একই সঙ্গে বাংলাদেশ সৃষ্টির ক্ষেত্র তৈরি করেছেন। পাকিস্তানের ইসলামী জাতীয়তাবাদের ধারার সাহিত্যকর্মের বাইরে এসেছিলেন লেখক-কবি-নাট্যকার, পাঠক-দর্শকশ্রোতা। আধুনিকতার অবস্থানে দাঁড়িয়েই পূর্ব-পাকিস্তানের মানুষের সত্য সব অভিজ্ঞতাকে_ বঞ্চনা, বৈষম্য, নিপীড়ন-নিষ্পেষণকে_ ধারণ করেছেন তাঁরা কবিতায়, গল্পে, ছড়ায়। কোনো ধর্মীয় বিশ্বাসের বাধা বোধ করেননি। এখানেই আধুনিকতার সহায়তা পেয়েছে বাংলাদেশের আন্দোলন-সংগ্রাম।
বুদ্ধদেব বসুর নাম সম্প্রতি আমাকে একাধিকবার উল্লেখ করতে হয়েছে তাঁর 'ছায়াচ্ছন্ন হে আফ্রিকা' কবিতাটির জন্যে। আমার দীর্ঘ আফ্রিকা-আগ্রহ ও অনুসন্ধানের কোনো পর্যায়ে তাঁর যুগের অন্য কোনো কবি-লেখককে আমি জানি না যিনি আফ্রিকা মহাদেশকে নিয়ে এমন তীব্র ও আক্রমণাত্মক ভাষায় লিখেছেন। আক্রমণ কাকে? 'শুভ্র সভ্যতা'কে। 'স্থূলোদর লোলজিহ্ব লোভ/রক্তস্ফীত বাণিজ্যের বীজ'কে।
বুদ্ধদেব বসু সম্পর্কে যে পশ্চিমঘেঁষা এবং ক্ষয়িষ্ণু আধুনিকতার ধারণারই খুব বেশি আলোচনা-প্রচার, এমন কবিতা তাকে খণ্ডন করে। নরেশ গুহ সম্পাদিত বুদ্ধদেব বসুর শ্রেষ্ঠ কবিতায় দেখছি 'ছায়াচ্ছন্ন হে আফ্রিকা' কবিতার অব্যবহিত আগে স্থান পেয়েছে তার 'রবীন্দ্রনাথের প্রতি' কবিতাটি_ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে, ১৯৪২ সালে রচিত। কিন্তু সেখানেও রবীন্দ্রনাথের প্রতিও, উষ্ণ সম্ভাষণ তাঁর রবীন্দ্রনাথের 'অক্ষয় মন্ত্র'-এর কারণে_ ফ্যাসিবাদের হাতে দগ্ধ-দীর্ণ পৃথিবীতে রবীন্দ্রনাথও যেহেতু বলেছেন, 'জীবনের জয় হবে'। বুদ্ধদেব বসু সম্পর্কিত আলোচনায় এই ফ্যাসিবাদ বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ব রাখে; কারণ, এরই চাপে বিদায় নিয়েছিল বুদ্ধদেবের অরাজনৈতিক অবস্থান। ইতিহাসের ওই সন্ধিক্ষণে মানবতাকে রক্ষার অগি্নপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে বুদ্ধদেব বসু যে সাময়িক রাজনৈতিক সাংগঠনিক অবস্থান নিয়েছিলেন, তাঁর আধুনিকতাকে বোঝার জন্যে তা অত্যন্ত জরুরি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ফ্যাসিবাদীদের ভূমিকার যে বিশ্লেষণ_ বুদ্ধদেব বসু উপস্থিত করেন, কল্লোল যুগের আধুনিক কবিরা নয়-নয় করেও তাতে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। পশ্চিমী সভ্যতারই নানা অংশে পশ্চিম সম্পর্কে প্রশ্ন ছিল, উন্মোচন ছিল। সে সময়টায় পরাধীন ভারতেও মার্ক্সবাদী তত্ত্বের জ্ঞান ছড়িয়ে পড়তে থাকে, বামপন্থী রাজনৈতিক দল ও তার অঙ্গসংগঠন, গণসংগঠন গড়ে ওঠে। রবীন্দ্রনাথ এবং নজরুলের রচনায় তার ছাপ পড়ে। কল্লোল যুগের কবিরা চাইলেও বামপন্থী ধারণা ও চেতনাজগতের সম্পূর্ণ বাইরে থাকতে পারতেন না। ধর্ম-সাম্প্রদায়িকতার মনোভাব ছড়িয়ে পড়ায় পাকিস্তান-ভারত বিভক্তির মধ্য দিয়ে যখন ব্রিটিশ শাসকরা বিদায় নিল, বামপন্থা, ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ ইত্যাদির জন্যে তখনই তৈরি হলো প্রকৃত এবং বৃহৎ দুর্দিন। ইসলামী প্রজাতন্ত্র পাকিস্তানে দ্রুতই কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ হয়েছিল; অপেক্ষাকৃত স্বতন্ত্র চিন্তার বুর্জোয়া নেতা হক-সোহরাওয়ার্দী পর্যন্ত ভারতের চর সাব্যস্ত হন। অথচ, ইউরোপ-আমেরিকার কাছাকাছি পরিবেশেই ভারতে বুর্জোয়া এবং বামপন্থী দলগুলো পার্লামেন্টারি গণতান্ত্রিক রজানীতিতে অংশ নিতে পেরেছে। বাংলাদেশের সম্ভাবনাময় অভ্যুদয়েও ভারতের বৃহৎ ভূমিকা একটি অপরিহার্য পূর্বশর্ত প্রমাণিত হয়েছে। এই ভারত বুর্জোয়া ভারতই। যার পেছনে সোভিয়েত ইউনিয়নের সমর্থনও ছিল বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের জন্যে সিদ্ধান্তমূলক উপাদান। এক অতিসেয়ানা সঙ্কীর্ণতা থেকেই কেউ-কেউ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়টাতেই পশ্চিমবঙ্গের প্রতি দিলি্লর আচরণ সম্পর্কে প্রশ্ন তোলার 'বিপ্লবী' কৌশল গ্রহণ করেছিল_ যাতে বাংলাদেশের সংগ্রামও ভণ্ডুল হয়ে যায়।
বঙ্গীয় সাহিত্য-পরিষদের সাহিত্য-সাধক চরিতমালা প্রকল্পের জন্য সুবীর রায় চৌধুরীর লেখা বুদ্ধদেব বসু জীবনীগ্রন্থ থেকে জানা যায় ঢাকায় থাকাকালেই এবং মাত্র আইএ পাস করার পরই কীভাবে বুদ্ধদেব বসু, অজিত কুমার দত্তকে সঙ্গে নিয়ে প্রগতি নামের একটি সাহিত্যপত্র সম্পাদনা ও প্রকাশ করেন। এর আগে এটি হাতে-লিখে বের করা হচ্ছিল। দু'বছরের কিছু বেশি সময় চলার পর অবশ্য প্রগতির প্রকাশ বন্ধ হয়ে যায়। ওই সময়ে কলকাতা থেকে কল্লোল প্রকাশিত হচ্ছিল; সুবীর রায় চৌধুরী লিখেছেন, "বুদ্ধদেব বসু 'প্রগতি'কে 'কল্লোল'-এরই একটি অংশ মনে করিতেন।" তিনি এও যোগ করেছেন, "আমাদের মনে হয় বুদ্ধদেবের প্রগতি-র বন্ধু এবং কল্লোলীয় বন্ধুদের মধ্যে পার্থক্য আছে।' প্রগতি সাহিত্যপত্রটি সম্পর্কে এখানে আমার লেখার কারণ অন্য কিছু নয়_ প্রগতি ধরনের ধারণার সঙ্গে বুদ্ধদেবের বহুপূর্ব সংযোগকে নির্দেশ করা।
আমরা দেখতে পাই জীবনীকার স্বয়ং সুবীর রায় চৌধুরীও একটি সংযোগ লক্ষ্য করেন এবং বুদ্ধদেব বসুর জীবনের এই পর্ব সম্পর্কিত অংশের শিরোনাম দেন প্রগতি থেকে 'প্রগতির লেখক সঙ্ঘ'। একটি চিঠিপত্রের সঙ্কলনের কয়েকটি চিঠির কতিপয় অংশকে সম্বল করে যারা বুদ্ধদেব বসু সম্পর্কে মন্তব্য করতে কিংবা উপসংহার টানতে চান, তাদের উচিত ছিল তার জীবনের বৃহৎ পরিধি এবং বিচিত্র উপকরণ সম্পর্কে খোঁজ-খবর নেয়া। তিনি যে স্বীকৃত এবং শ্রদ্ধেয় সব মার্কসবাদীদের সঙ্গেও কাজ করেছেন, নৈকট্য রেখেছেন। দেখতে পাচ্ছি যে কবিতা পত্রিকায় যাঁদের লেখা ছাপা হয়েছে শুধু তাঁদের মধ্যে নয়, কবিতা ভবন থেকে কবিতার বই যাঁদের বেরিয়েছিল, তাঁদের ১৪ জনের মধ্যে নয়-নয় করেও পাঁচজনই ডাকসেঁটে মার্কসবাদী : বিষ্ণু দে, মণীন্দ্র রায়, মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়, সমর সেন এবং সুভাষ মুখোপাধ্যায়।
প্রগতি লেখক সঙ্ঘের দ্বিতীয় নিখিল-ভারত সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৩৮ সালের ২৪ ও ২৫ ডিসেম্বর, কলকাতার ভবানীপুরে, আশুতোষ হলে। বুদ্ধদেব বসু সেখানে অন্যতম সভাপতি ছিলেন। অন্য সভাপতিরা ছিলেন সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, মুলকরাজ আনন্দ এবং পণ্ডিত সুদর্শন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর উদ্বোধনী ভাষণ দিয়েছিলেন; উপস্থিতদের অন্যতম ছিলেন 'প্রমথ চৌধুরী, নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়, শাহেদ সোহরাওয়ার্দী, সাজ্জাদ জহীর, প্রবোধ কুমার সান্যাল, প্রেমেন্দ্র মিত্র, আবদুল আলীম, সত্যেন্দ্রনাথ মজুমদার, সুরেন্দ্রনাথ গোস্বামী প্রমুখ'। জীবনীকার সুবীর রায় চৌধুরী উল্লেখযোগ্য তথ্য জানাচ্ছেন এরূপও যে, প্রগতি লেখক সঙ্ঘের দ্বিতীয় নিখিল-ভারত সম্মেলনে প্রদত্ত রবীন্দ্রনাথের উদ্বোধনী ভাষণটি ছিল 'প্রধানত সদ্য প্রয়াত কামাল আতাতুর্ক-এর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন।' আরও উল্লেখযোগ্য যে এ সম্মেলনেই অন্যতম সভাপতি হিসেবে প্রদত্ত ইংরেজি ভাষণে বুদ্ধদেব বসুর একটি আলোড়ন সৃষ্টিকারী বাক্য ছিল : ্তুঞযব ধমব ড়ভ জধনরহফৎধহধঃয রং ড়াবৎ.্থ [শারদীয় দেশ :১৩৮১ : ২০]
যাই হোক, জীবনের এই বিশেষ পর্বে বামপন্থীদের সঙ্গে বুদ্ধদেব বসুর সম্পর্ক ও সংযোগ বিষয়ে নিম্নের বিবরণটি সংক্ষিপ্ত কিন্তু সম্পূর্ণ :
'প্রগতি লেখক সঙ্ঘে'র পরিণতি 'ফ্যাসিস্টবিরোধী লেখক সঙ্ঘে'র প্রতিষ্ঠার পর ইহার নামকরণ হয় 'ফ্যাসিস্টবিরোধী লেখক ও শিল্পী সঙ্ঘ' এবং সর্বশেষে পুনরায় 'প্রগতি লেখক সঙ্ঘ' [১৯৪৫]। ঢাকায় একজন লেখক সোমেন চন্দ-র [৮ মার্চ, ১৯৪২] হত্যাকে উপলক্ষ করিয়া 'ফ্যাসিস্টবিরোধী লেখক সঙ্ঘে'র আবির্ভাব। বুদ্ধদেব বসুর সঙ্গে 'ফ্যাসিস্টবিরোধী লেখক ও শিল্পী সঙ্ঘ' পর্যন্ত যোগাযোগ ছিল। এই সংগঠন হইতে তাঁহার দুইটি পুস্তিকা প্রকাশিত হয় : 'সভ্যতা ও ফ্যাসিজম', [১৯৪২, মূল্য দুই আনা] এবং 'সোভিয়েত রাশিয়ার শিল্প ও সংস্কৃতি।' প্রতিভা বসুও লেখেন 'ফ্যাসিজম ও নারী' [মূল্য ছয় পয়সা]
প্রগতিবাদীদের সঙ্গে বুদ্ধদেব বসুর সম্পর্কে টানাপড়েন ছিল। সেটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যখন জানা যায় যে, ১৯৪৫ সালে নিজের লেখা বইপত্রের তালিকা করতে গিয়ে বুদ্ধদেব আর ওপরের উদ্ধৃতিতে উলি্লখিত পুস্তিকা দুটোকে অন্তর্ভুক্ত করেননি। তার জীবনীকার আরও জানাচ্ছেন যে 'প্রগতি' লেখকগণ সম্পাদিত বিভিন্ন সংস্করণে প্রকাশিত 'বুদ্ধদেব বসুর' কবিতার অধিকাংশই অগ্রন্থিত। কিন্তু জীবনীকার তা সত্ত্বেও মন্তব্য করেছেন : কিন্তু বুদ্ধদেব বসুর সাহিত্যকর্মকে সামগ্রিকভব বিচার করিতে হইলে, এই পর্বের ঐতিহাসিক গুরুত্ব অস্বীকার করা যায় না।' [চক্রবর্তী :৩৯৫]
এরপর আমি বুদ্ধদেব বসুর একটি দুষ্প্রাপ্য রচনা নিয়ে খানিক আলোচনা করে শেষ করবো। ফ্যাসিবাদবিরোধী লেখক ও শিল্পী সঙ্ঘ থেকে প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর পুস্তিকা 'সভ্যতা ও ফ্যাসিজম'। ক্ষয়িষ্ণু আধুনিকতার কবি বলা হয় যে বুদ্ধদেব বসুকে, এ পুস্তিকার এক পর্যায়ে তিনিই গত শতাব্দীর তিরিশের দশকে যে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দেয়, সে সম্পর্কে লিখেছেন, 'নিজের জীবনে উপলব্ধি করলুম কী তুচ্ছ, কী অকিঞ্চিৎকর সাহিত্যিকের মূল্য, সুজলা সুফলা বাংলাদেশে তার অন্নবস্ত্রের ব্যবস্থা হয় কি না হয়। কোনো কোনো দিকে হঠাৎ যেন আমার চোখ খুলে গেল, মানুষের জীবনের অর্থনৈতিক ভিত্তি সম্বন্ধে সেই প্রথম সচেতন হলুম।' যে বুদ্ধদেব বসু নিজের স্বাভাবিক ক্ষেত্র হিসেবে রাজনীতিকে কখনো গ্রহণ করেননি, 'সভ্যতা ও ফ্যাসিজম' পুস্তিকায় কিন্তু তিনিই অনেক সত্যতর রাজনৈতিক আলোচনা ও মন্তব্য করেছেন, তাতে তখন আর তাকে খুব বেশি রাজনীতিবিমুখ মনে হয় না। নিজের এবং সদৃশ অনেকের আচরণের একটি বেশ বিশ্বাসযোগ্য ব্যাখ্যাও তিনি দিয়েছেন :
'একদিকে জার্মানি ইটালিতে মনুষ্যত্বের অবমাননা ও সভ্যতার বিনাশ, অন্যদিকে রাশিয়াতে মনুষ্যত্বের পূর্ণ মর্যাদাদান ও সভ্যতার পূর্ণ বিকাশের সাধনা। এই জুড়ি দৃশ্য যখন দেখলুম তখন রাজনীতির বড় রকমের একটা অর্থ মনে ধরা দিল। তখন বুঝলুম রাজনীতি শুধু অ্যাসেমবি্ল হলের বক্তৃতা নয়, মাছ ও পাউরুটির বিতরণ নিয়ে নোংরা কলহ নয়, আমাদের প্রত্যেকের জীবনযাপন, ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখ রাজনীতির ওপর নির্ভরশীল এবং সেই জন্য তার আলোচনায় আমাদের সকলেরই প্রয়োজন। '
এরপরে ভিন্ন একটি মাত্রায় গিয়ে বুদ্ধদেব ফ্যাসিজম সম্পর্কে আলোচনা করেছেন, একে খুবই অর্থবহ ও প্রাসঙ্গিক মাত্রা বলেও মনে হয়। তিনি লিখেছেন, 'ফ্যাসিজম শুধু একটা সামরিক নীতি কিংবা রাজনৈতিক পদ্ধতি নয়, ফ্যাসিজম একটা মনোভাব। মনোভাব মাত্রই অত্যন্ত ব্যাপক, জীবনের সমস্ত ছোটখাটো ব্যাপারে তার পরিচয় পাওয়া যায়। এটা আজকের দিনে অত্যন্ত বিস্মিত হয়ে উপলব্ধি করছি যে কোনো ব্যক্তির যদি রবীন্দ্রনাথের গান কি যামিনী রায়ের ছবি ভালো না লাগে, সেই রুচির কিংবা রুচির অভাবের সঙ্গে জড়িত আছে তার রাজনৈতিক মতামত।...' বুদ্ধদেব বেশ খানিকটা ব্যাখ্যাও করেছেন নিজের এই মতাবস্থানকে, লিখেছেন, 'আমাদের দেশেও আজকের দিনে এমন লোকের অভাব নেই যারা যা কিছু প্রগতিশীল তারই বিরোধী, যা কিছু নতুন সে সম্বন্ধে সন্ধিগ্ধ, যারা স্ত্রী জাতিকে সন্তানবাহী ক্রীতদাসী বানিয়ে রাখবার পক্ষপাতী...চোখ বুজে বলে দেয়া যায় যে এটাই ফ্যাসিস্ট মনোবৃত্তি_ হয়তো সচেতন নয়, অচেতন_ কিন্তু শেষ হিসেব মেলাবার দিনে এদের সমস্ত অচেতন ইচ্ছা বাঁধন-ছেঁড়া ক্ষিপ্ত কুকুরের মত ছুটে বেরিয়ে এসে তাদেরই কামড়াতে যাবে মুক্তির সাধনায় জীবন যাদের উৎসর্গিত।'
জ্ঞান-অর্জন এবং পরিবর্তনের যাবতীয় প্রকল্পকে প্রশ্ন এবং সংশয়ের মধ্যে ফেলে দিয়েছে বর্তমানকালের যে থিয়োরি কিংবা ডিসকোর্স, তার কাছাকাছি একটি পরিবেশ সরে এসেছিল বুঝি ফ্যাসিজমের আওতায়ও। বুদ্ধদেব বসুর বক্তব্যে অন্তত তাই মনে হয়। া

No comments

Powered by Blogger.