হেমন্ত আমাকেই দেখেছিল by ফজল শাহাবুদ্দিন

সলে হেমন্তকে অর্থাৎ হেমন্ত ঋতুকে_ আমি প্রথম দেখিনি। হেমন্তকাল তার অবিশ্বাস্য যত ঐশ্বর্য নিয়ে আমাকেই প্রথম দেখেছিল। হেমন্তের সেইসব দিন তারিখ সন কিছুই এখন আর মনে নেই। শুধু মনে আজ হেমন্ত, পৃথিবীতে আমার উদ্বোধনের ঋতু হয়ে আছে। মনে আছে কান্তারের কোনো এক কার্তিকে কিংবা হতে পারে অগ্রহায়ণে আমি নিজকে প্রথম আবিষ্কার করেছিলাম আবিষ্ট এক হেমন্তের আর ছায়ায় আর বিষণ্নতা ও বাতাস আর কুয়াশার মতোন কিছু


আচ্ছন্নতায়। আর সব কিছুর নিচে আমি যেন দাঁড়িয়ে আছি একাকি, ক্রমাগত এক ঘোরের মতো ধরিত্রীর কাছে আনত। আমি এখন জানি সেই কাল_ সেই সময়টা ছিল হেমন্তকাল। অগ্রহায়ণের প্রথম দিন- শূন্য ভারাক্রান্ত আর সোনালি ধানের মতো পরিপূর্ণ এক তৃপ্তির হাওয়ায় আন্দোলিত।
আমার নানী বলতেন_ 'সেই আগুণ মাস'। সেই অগ্রহায়ণ, সেই বিপুল বিষণ্নতা আরো পরে আমাদের পল্লবে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন জীবননান্দ দাশ আর বুদ্ধদেব বসু।
জীবনানন্দের কবিতা পড়ে রূপলাবণ্যে ভরপুর বাংলাদেশের প্রকৃতিকে আমরা নতুন করে আবিষ্কার করি, নিবিড় পর্যবেক্ষণে মুগ্ধ হই। সে এক অদ্ভুত আচ্ছন্নতা।
আমরা বললাম হেমন্তকে আর কান্তারের কার্তিককে আমরা ভালোবাসি।
আমি, শামসুর রাহমান আর শহীদ কাদরী_ কেবলি হাঁটতে থাকলাম ঢাকার পথে পথে- বাতাসে বাতাসে আকাশে আকাশে। সারা দিন সারা রাত। তবে আরেকবার পড়ে নিই জীবনানন্দ দাশের দুই কবিতা_

ক. হেমন্ত

আজ রাতে মনে হয়
সব কর্মক্লান্তি অবশেষে কোনো এক অর্থ শুষে গেছে।
আমাদের সব পাপ_ যদি জীব কোনো পাপ ক'রে থাকে পরস্পর
কিংবা দূর নক্ষত্রের গুল্ম, গ্যাস, জীবানুর কাছে_
গিয়েছে ক্ষয়িত হয়ে।
বৃত্ত যেন শুদ্ধতায় নিরুত্তর কেন্দ্রে ফিরে এল
এই শান্ত অঘ্রাণের রাতে।

যত দূর চোখ যায় বিকোষিত প্রান্তরের কুয়াশার ব্যাস
শাদা চাদরের মতো কুয়াশার নিচে শুয়ে।
হরিতকী অরণ্যের থেকে চুপে সঞ্চারিত হয়ে
নিশীথের ছায়া যেন মেধাবীর পিঠে।

সুষুপ্ত হরিণ_ লোষ্ট্র ; মৃত আজ ; ব্যাঘ্র মৃত ; মৃত্যুর ভিতরে অমায়িক।
জলের উপর দিয়ে চলে যায় তারা ; তবু জল
স্পর্শ করে নাকো সিংহদুয়ারের মতো জেগে ওঠে ইন্দ্রধনু
তাহাদের যেতে দেয়; অদ্ভুত বধির চোখে তবু তারা
অভ্যর্থনাএর নাকো আজ আর আলোর বর্বর জননীকে।

বাংলার শষ্যহীন ক্ষেতের শিয়রে
মৃত, বড়ো গোল চাঁদ ;
গভীর অঘ্রাণ এসে দাঁড়ায়েছে।
অনন্য যোদ্ধার মতো এসেছে সে কত বার
দিনের ওপারে সন্ধ্যা_ ঋতুর ভিতরে প্লাবী হেমন্তকে
দৃষ্ট প্রত্যঙ্গের মতো এই স্ফীত পৃথিবীতে
ছুরির ফলার মতো টেনে নিয়ে।
বেবিলন থেকে বিলম্বিত এসপ্লানেডে
বিদীর্ণ চীনের থেকে এই শীর্ণ এককড়িপুরে
মানুষের অরুন্তুদ চেষ্টার ভিতরে।

খ. অঘ্রাণ
আমি এই অঘ্রাণেরে ভালোবাসি_ বিকেলের এই রঙ_ রঙের শূন্যতা
রোদের নরম রোম_ ঢালু মাট_ বিবর্ণ বাদামি পাখি_ হলুদ বিচালি
পাতা কুড়াবার দিন ঘাসে ঘাসে_ কুড়ূনির মুখে নাই কোনো কথা,

ধানের সোনার সাজ ফুরায়েছে_ জীবনেরে জেনেছে সে_ কুয়াশার খালি
তাই তার ঘুম পায়_ ক্ষেত ছেড়ে দিয়ে যাবে এখনি সে_ ক্ষেতের ভিতর
এখনি সে নেই যেন_ ঝ'রে পড়ে অঘ্রাণের এই শেষ বিষণ্ন সোনালি

তুলিটুকু ;_ মুছে যায় ;_ কেউ ছবি আঁকিবে না মাঠে মাঠে যেন তারপর,
আঁকিতে চায়না কেউ_ এখন অঘ্রাণ এসে পৃথিবীর ধরেছে হৃদয়;
একদিন নীল ডিম দেখিনি কি ?_ দুটো পাখি তাদের নীড়ের মৃদু খড়

সেইখানে চুপে চুপে বিছায়েছে ;_ তবু নীড়,_ তবু ডিম,_ ভালেবাসা
সাধ শেষ হয়
তারপর কেউ তাহা চায় নাকো_ জীবন অনেক দেয় _ তবুও জীবন
আমাদের ছুটি দেয় তারপর_ একখানা আধখানা লুকোনো বিষ্ময়

অথবা বিষ্ময় নয়_ শুধু শান্তি_ শুধু হিম কোথায় যে রয়েছে গোপন
অঘ্রাণ খুলেছে তারে_ আমার মনের থেকে কুড়ায়ে করেছে আহরণ।

২.
নবান্ন নিয়ে আমি একটি কবিতা লিখেছিলাম দীর্ঘদিন আগে। আটাত্তর-ঊনসত্তর সালে। আমাদের চারুকলা ইনস্টিটিউটে তখন নবান্ন উৎসব আয়োজন করার একটি কাজ হাতে নেয়া হয়। শিল্পী হাশেম খান, যাকে আমি একান্তভাবে ভালোবাসি পছন্দ করি। একদিন আমাকে বললেন- ফজল ভাই, নবান্নকে নিয়ে একটি কবিতা লিখুন আমার জন্যে।
এবং আমি লিখলাম একটি কবিতা, হাশেম খানের জন্যে। সেই কবিতাটি মনে হয় সেই সময় সেই উৎসবের একটি কাগজে ছাপা হয়েছিল । এখন বুঝতে পারি সেদিন একটি ভালো কাছ করেছিলাম। বাংলা ১৩৭৬ এর সেই নবান্ন, সেই উৎসবের দিনে আমি আনন্দিত হতে পারিনি। আমি লিখেছিলাম_


নবান্ন : ১৩৭৬
এখন ফসল নেই বাংলাদেশে। হাওয়ায় ওঠে না
দুলে রাশি রাশি তৃপ্তির শিখার মতো স্বর্ণরঙ শস্যকণা আর
খামারেতে নেই সেই আকাঙ্ক্ষার সম্পন্ন শরীর
এবং ইদানীং
ক্ষুধার পতাকা এক উড়ছে শুধুই
বিশাল আকাশ জুড়ে আশ্বিনের সুনীল ললাটে;

বাংলাদেশে আসে না অঘ্রাণ
কিংবা পৌষ পার্বণের পালা নাচের মুদ্রার মতো
কাঁপা কাঁপা হয় না অস্থির
ঘরের নিবিড় উষ্ণতায় কালোচোখে
ইচ্ছের আবর্তে
চুলের ঐশ্বর্যে
অথবা দূরের ধানকাটা প্রান্তরের পারে
শীতার্ত হাওয়ায়
এখন ফসল নেই বাংলাদেশে অথচ সবাই
কী ক'রে মেতেছো বলো,
প্রাচীন বিশাল সেই নবান্নের মাতাল উৎসবে।

৩.
বুদ্ধদেব বসু কোলকাতায় দেশ পত্রিকায় একটি প্রবন্ধ
লিখেছিলেন_ বাংলা কবিতা এবং বাংলা প্রকৃতি নিয়ে। সেখানে তিনি বলেছিলেন, আধুনিক বাংলা কবিতায় বর্ষা আর বসন্ত_ একটি শাড়ির দুটি মস্ত পাড়ের মতো। সেখানে বাংলার অন্যান্য ঋতু তেমন প্রবল নয়। বিদ্যাপতি থেকে আজ পর্যন্ত।
সম্ভবত একমাত্র ব্যতিক্রম জীবননান্দ দাশ।
যিনি কার্তিক আর অঘ্রাণের প্রান্তরকে ভীষণভবে শনাক্ত করেছেন বাংলা কবিতার পাঠকদের জন্যে।
আমরা যারা এদেশে কবিতা চর্চা করে থাকি তারা একটি নতুন দেশ যেন আবিষ্কার করলাম।
এবং আমার ভালো লাগছে এই দেখে যে এদেশের বড় বড় সব কাগজই এখন
কার্তিক অগ্রহায়ণ নিয়ে বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করছে।
আমারও একটি কবিতার বই বেরুবে শিগগিরই_ নাম কাণ্ডারের কার্তিক। আমার জানি না কেন মনে হয়, এই হেমন্তকে আমাদের আরো গভীর করে আবিষ্কারের প্রয়োজন আছে।
আমার মনে হয় আমাদের কবিতায় বর্ষা আর বসন্তের যে প্রাধান্য আর দাপট_ তার পাশাপাশি হেমন্ত কে, কার্তিক আর অঘ্রাণকেও আমাদের উপলব্ধির অর্ন্তলোকে
প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন। া

No comments

Powered by Blogger.