আমৃত্যু বিদ্রোহী by মফিজ ইমাম মিলন

বীর মুক্তিযোদ্ধা নাসির উদ্দিন আহমেদ মুসা আমাদের মধ্যে তিন বছর ধরে নেই। ৫৮ বছর বয়সে অকালেই চলে গেলেন। দুরারোগ্য ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে শীর্ণকায় বিবর্ণ হয়েছিল দেহটি। বড় ভাই চিত্রকর শিল্পী মুনশী মহিউদ্দিনও ১৯৯৭ সালের ২৪ ডিসেম্বর ক্যান্সারে ভুগে মারা যান। মা হাজেরা বেগম '৯১ সালের অক্টোবরে, আর বাবা মুনশী কবিরউদ্দিন পৃথিবী ছেড়েছেন অনেক আগেই। নাসির মুসা সবকিছুতেই সাড়া দিতে চাইতেন। কারণে-অকারণে বিতর্কে
জড়িয়ে পড়তেন এ কারণেই। তরঙ্গের চূড়ায় চূড়ায় নৃত্য করার বাসনা তার মধ্যে সুপ্ত ছিল। রাজনীতিক, শিক্ষাবিদ, আইনবিদ, কবি, সাহিত্যিক_ সর্বোপরি ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। তার মধ্যে একটা বাউল মন বাস করত, সেটাই তাকে উতলা রাখত সর্বক্ষণ। ১৯৪৯ সালের ১ জুলাই ভাঙ্গা থানার সদরদী মাতুলালয়ে নাসির মুসার জন্ম। ১৯৬৬ সালে ফরিদপুর হাইস্কুল থেকে এসএসসি, ১৯৬৮ সালে রাজেন্দ্র কলেজ থেকে এইচএসসি এবং ১৯৭২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়েছিলেন। ১৯৬৯-এর গণআন্দোলনে ছাত্রদের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন নাসির মুসা। রাজেন্দ্র কলেজের ছাত্র সংসদের ভিপি ছিলেন। সে সময় ফরিদপুর ছাত্রলীগের সভাপতির দায়িত্বও পালন করেন। এ সময়ে কারাবরণ করেন। কবিতা লিখেও একবার জেল খেটেছেন। ফরিদপুর রাজনৈতিক সহিংসতা ও দুর্বৃত্তায়নের প্রথম ঘটনা সুফী মার্ডার। ১৯৬৯ সালের ১৬ মার্চ। কবি ফর্রুখ আহমদের ভাতিজা সুফীকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের সঙ্গে তারা জড়িত ছিল। এর বিরুদ্ধে যারা রুখে দাঁড়ালেন, গণজোয়ার তৈরি করলেন, নাসির মুসা তাদের অন্যতম।
বাংলা একাডেমীর চাকরি দিয়ে কর্মজীবন শুরু। কিছুদিন পর আবার ফরিদপুর। ইয়াছিন কলেজ ছেড়ে ভাঙ্গা কেএম কলেজে অধ্যাপনা শুরু করেন। মধুখালী আইনুদ্দিন কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ '৭৬ সাল পর্যন্ত। তারপর সদরপুর কলেজে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত। ১৯৯২ সালে শুরু করেন ফরিদপুর সিটি কলেজ প্রতিষ্ঠার কাজ। ফরিদপুর পৌরসভার ২নং ওয়ার্ডের কমিশনার ছিলেন ১৯৭৭ থেকে ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত। ১৯৮৩ থেকে '৯২ সাল পর্যন্ত ওকালতি করেছেন। জেলা বারের সেক্রেটারির দায়িত্ব পালন করেছেন ১৯৯১ থেকে '৯২ সাল পর্যন্ত। শেরেবাংলা সাধারণ পাঠাগারেরও সম্পাদক ছিলেন।
নাসির মুসা আওয়ামী লীগেও বিদ্রোহী ছিলেন। যা কিছু মনে করতেন প্রতিবাদ করতেন। আবার কোনো কোনো সময় মনে হয়েছে, সৃষ্টিশীল সাহিত্যকর্ম ও রচনাশৈলীর মধ্য দিয়ে সমাজের কোনো একটা আসন ধরে রাখার আকুতিও তার মধ্যে ছিল।
২০০১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস উপলক্ষে কবি জসীমউদ্দীন হলে আলোচনা সভা। বিএনপির মন্ত্রী-এমপি এবং প্রশাসনের কর্মকর্তায় হল কানায় কানায় ঠাসা। নাসির মুসা জাতির জনকের ছবি হাতে মঞ্চে উঠে এসে ঘোষণা করলেন_ 'যে মঞ্চে বঙ্গবন্ধুর ছবি নেই, সেখানে বিজয় দিবসের আলোচনা হতে দেব না।' শেষ পর্যন্ত প্রশাসন বাধ্য হলো মঞ্চে বঙ্গবন্ধুর ছবিটি টাঙাতে। সে অনুষ্ঠানে উপস্থিত অনেক নেতা-মুরবি্ব নাসির মুসাকে সমর্থন না করে 'দ্যাক দ্যাক পাগলের কাণ্ড' বলে মুচকি হেসেছিলেন। নাসির মুসার সঙ্গে শেষ দেখা হলো ডায়াবেটিক হাসপাতালের কেবিনে। বুকে বুক মেশাতে গিয়ে মনে হলো, শুধু হাড্ডি ক'খানা রয়েছে। জীর্ণশীর্ণ রুগ্ণ নাসির মুসার চোখ দুটিকে জ্বলজ্বল করতে দেখেছিলাম শুধু।
আজ মৃত্যুবার্ষিকীতে তার প্রতি
জানাই শ্রদ্ধার্ঘ্য।

No comments

Powered by Blogger.