বিশ্বায়নের খেসারত!-ভারত by পার্থ চট্টোপাধ্যায়

দুর্গাপূজা থেকে দেওয়ালি_ প্রায় এই এক মাস সময় হলো ভারতের হাওয়া বদলের মাস। ছুটির মাস। কলকাতায় মহাকরণ সাত দিন ছুটি। ভারতের অন্যত্র দুর্গাপূজায় ছুটি একদিন হলেও দেওয়ালি এলে আর রক্ষা নেই। সাত দিন ধরে অফিস খালি। ট্রেনে তিন মাস আগে থাকতে সব টিকিট বুক হয়ে গেছে। পূজা-দেওয়ালি আর বড়দিনের সময়ের প্লেনের টিকিট নেই। হোটেলে জায়গা নেই। এবার পূজা আর দেওয়ালিতে এক লাখ ভারতীয় শুধু সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়া বেড়াতে গেছেন।


কলকাতার বহুজাতিক এক ভারতীয় কোম্পানির জেনারেল ম্যানেজার অরিন্দম শীল স্ত্রী ও পুত্রকে নিয়ে দুই লাখ টাকার প্যাকেজ ট্যুরে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বেড়াতে গিয়েছিলেন। ফিরে এসে অফিসে গিয়ে চিঠি পেলেন, কোম্পানির অবস্থা খারাপ। অরিন্দম গত ৪ বছর ধরে কোম্পানিকে যে আন্তরিক সেবা দিয়েছেন সে জন্য কোম্পানি তাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছে। কিন্তু পরের মাস থেকে তার আর আসার দরকার নেই। অতএব, বছরে পনের লাখ টাকা বেতনের বারো বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন টপ এক্সিকিউটিভ অরিন্দম এখন বেকার। তার একমাত্র ছেলের স্কুলে মাসে ১০ হাজার টাকা বেতন। গাড়ি, ড্রাইভারের পেছনে আরও বিশ হাজার টাকা চলে যায়। ষাট লাখ টাকা দিয়ে যে ফ্ল্যাট কিনেছেন, ব্যাংকের লোন শোধ করতে হয় মাসে ষাট হাজার করে। দু'দুটি ক্লাবের মেম্বার, সেখানে খরচ মাসে হাজার দশেক। অরিন্দম যে কোম্পানিতে চাকরি করতেন লোকে তার নাম শুনে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াবে_ ভারতের সবচেয়ে বিশ্বস্ত কোম্পানি; যারা পৃথিবীজুড়ে ব্যবসা করছে।
আরেকজনের কথা বলি, কলকাতার পাশে এক গ্রামের মাধ্যমিক পাস করা ৩০ বছর বয়সী গৌর মণ্ডল। একটি ভারতীয় বীমা সংস্থার চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী। বেতন পাঁচ হাজার টাকা। বাড়িতে বউ আর শিশুকন্যা। মা লোকের বাড়িতে কাজ করে। আলাদা থাকে। গৌর মণ্ডলের পাঁচ হাজার টাকায় সংসার চলে না। তাও তো এতদিন একটা চাকরি ছিল। কিন্তু পূজার পরই চিঠি পেয়েছে, কোম্পানির অবস্থা ভালো নয়। তাই কিছু কর্মী ছাঁটাই করতে হচ্ছে। ছাঁটাই তালিকায় অনেক কর্মীর মধ্যে গৌর মণ্ডল একজন। বউ আর শিশুকন্যা নিয়ে গৌর এখন রাস্তায়।
এই হচ্ছে এখনকার ভারতের অর্থনৈতিক ছবি। নতুন চাকরি নেই। বাড়ি বাড়ি ঘুরে বিক্রি বা মলের বড় বড় শোরুমে আট ঘণ্টা-দশ ঘণ্টা ঠায় দাঁড়িয়ে কিছু বেচা অথবা বিপিওতে বারো ঘণ্টা বসে কাজ করার চাকরি ছাড়া আর কোনো চাকরি নেই বাজারে। বড় বড় হেড হান্টাররা যারা এতদিন শিক্ষিত-অভিজ্ঞ তরুণ-তরুণীদের জন্য মোটা বেতনের চাকরি জোগাড় করে ফুলে-ফেঁপে উঠেছিলেন, তারা ঝাঁপ বন্ধ করার মুখে। শুধু কল সেন্টারের চাকরি দিয়ে কোনোক্রমে টিকে আছেন। কিন্তু কল সেন্টারের চাকরিই-বা আর কতদিন? পশ্চিমবঙ্গেই এত প্রার্থী যে কলকাতার কল সেন্টারগুলো এখন অভিজ্ঞ প্রার্থীদেরও মাসে হাজারের বেশি দিচ্ছে না। সারাদেশে কয়েক লাখ প্রাইভেট ইঞ্জিনিয়ারিং আর এমবিএ পড়ানোর কলেজ রয়েছে। কয়েক লাখ টাকা খরচ করে সেখান থেকে পড়ে গ্র্যাজুয়েট ইঞ্জিনিয়ার ও এমবিএরা দশ-বারো হাজার টাকার চাকরি পেয়ে কৃতার্থ মনে করছেন। তাও সেসব চাকরি কর্নাটকে না হয় মহারাষ্ট্রে।
ভারতের অর্থনীতিবিদ প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং ও কয়েকবার শ্রেষ্ঠ অর্থমন্ত্রীর পুরস্কার পাওয়া অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায় এতদিন বলে আসছিলেন, বিশ্বমন্দা ভারতকে তেমন কাবু করতে পারবে না। আমাদের জিডিপি কিছুতেই শতকরা আট ভাগের নিচে নামবে না। গত লোকসভা ভোটের মুখে ভারত সরকার এক লাফে কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারী আর অধ্যাপকদের বেতন অবিশ্বাস্যভাবে বাড়িয়ে দিয়েছিল। একজন জয়েন্ট সেক্রেটারি সব মিলিয়ে লাখ টাকা মাসিক বেতন পান। রাজ্য সরকারের একজন সুইপার সব মিলিয়ে আট থেকে দশ হাজার। কেন্দ্রীয় সরকারের একজন আরদালি পাচ্ছেন মাসে বিশ হাজার। ক'বছর আগে একজন অধ্যাপক সারাজীবন কাজ করে আটাশ হাজার টাকায় রিটায়ার করতেন, এখন একজন লেকচারার ত্রিশ থেকে তেত্রিশ হাজারে চাকরিতে ঢুকছেন।
সরকারি বেতন হারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে করপোরেট কর্তাদের বেতন ছিল লাগামছাড়া। ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট থেকে পাস করা একজন তরুণকে ক্যাম্পাস থেকে রিত্রুক্রট করা হয় মাসে দুই লাখ থেকে পঞ্চাশ লাখ বেতনে। একেকজন চার-পাঁচটি করে চাকরি পেয়ে আসছিলেন এতদিন। যিনি সবচেয়ে বেশি বেতন দেবেন, সদ্য পাস করা ছাত্রটি সেখানে যোগ দেবেন।
কিন্তু একমাত্র আইআইএম বা আইআইটি ছাড়া ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে রিত্রুক্রট করতে আসা হেড হান্টারদের সংখ্যা এখন কমে গেছে।
এ কী হলো ব্র্যান্ড ইন্ডিয়ার? ২০১২ সালের আগে এ কোন অশনিসংকেত? কেউ বলছেন, মুদ্রাস্ফীতির জন্য দায়ী রিজার্ভ ব্যাংক। তারা সুদের হার বাড়িয়ে রেখেছে বাজারে যাতে বেশি টাকা না এসে পড়ে তা নিয়ন্ত্রণের জন্য। কিন্তু তার ফলে লগি্নকারকরা হাত-পা গুটিয়ে বসে আছেন। তারা মোটা সুদে টাকা ধার নিতে ইতস্তত করছেন। ভারতীয় ব্যাংকগুলোতে এখন আমানতকারীরা সুদ পাচ্ছে ৯ শতাংশ হারে। সিনিয়র সিটিজেনরা আগে ১ শতাংশ বেশি পেতেন। এখন তাদের সুদ কমিয়ে মাত্র আধা শতাংশ বেশি দেওয়া হচ্ছে। ব্যাংক ঋণগ্রহীতাদের কাছ থেকে সুদ নিচ্ছে ১১-১২ শতাংশ হারে। গৃহ ঋণের সুদের হার একসময় ৭-৮ শতাংশ ছিল। তাতে সারা ভারতে কোটি কোটি আবাসন তৈরি হতে থাকে। এ শিল্পকে কেন্দ্র করে আবার লাখ লাখ লোকের কর্মসংস্থান হচ্ছে। তেমনি এক শ্রেণীর মাফিয়ারাজও তৈরি হয়েছে। চলছে কোটি কোটি কালো টাকার লেনদেন। অর্থনীতি ফুলে-ফেঁপে উঠলেও সরকারের হাতে বৈধ টাকা আসছে না। পৌরসভাগুলোর হাতে উন্নয়নের টাকা নেই। অবৈধ অনুমতিদানের ফলে লাভবান হচ্ছে শুধু ব্যক্তি। বিদেশ থেকে, বিশ্বব্যাংক থেকে যে কোটি কোটি টাকা উন্নয়নের জন্য ব্যয় হচ্ছে তার বেশিরভাগ যাচ্ছে কিছু রাজনীতিবিদ ঠিকাদার আর মাফিয়ার হাতে। ফলে একদিকে রাজ্য সরকারগুলো দেউলিয়া। কেন্দ্রীয় সরকারের এখন বড় আয় রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানিগুলোর শেয়ার খোলাবাজারে বিক্রি, আর খনিজসম্পদ তথা কাঁচা আকরিক লোহা বিদেশে বিক্রি করে। সবকিছুতেই অবৈধ লেনদেন চলছে। কর্নাটকে অবৈধ খনি থেকে আকরিক লোহা বিক্রি করে কোটি টাকা সরানোর ঘটনা ধরা পড়েছে। ওই ঘটনায় জড়িত কর্নাটকের সাবেক বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী ইয়েদুরাপ্পা ও তার সাগরেদরা জেলে। টু-জি স্পেকট্রাম নিলামে বিক্রি না করে ঘুষ নিয়ে পছন্দের কোম্পানিগুলোকে পাইয়ে দেওয়ার ফলে সরকারের ১ লাখ ৭৬ হাজার কোটি টাকা লোকসান হয়েছে। এই টু-জি স্ক্যাম নিয়ে কেন্দ্রের দু'জন মন্ত্রী এ রাজা ও নয়ানিধি মারান ও একজন এমপিসহ কয়েকজন বড় অফিসার জেলে। এমনকি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চিদাম্বরম এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকতে পারেন_ এই অভিযোগ সুপ্রিম কোর্ট তুলেছেন জনতা পার্টির নেতা সুব্রহ্মণ্যম স্বামী। ভারতের এই সাম্প্রতিক দুরবস্থার জন্য অনেকে যেমন বিশ্বায়নকে দায়ী করেছেন, আবার অনেকে দায়ী করেছেন এক শ্রেণীর ব্যবসায়ীর দুর্বার লোভকে। তারা যে কোনো শর্তে বিশ্বায়নের ফুলে-ফেঁপে ওঠা অর্থনীতিকে নিজেদের লোভের জন্য গরিব মানুষের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়েছে।
এতে দেশের ৭৩ শতাংশ লোকের অবস্থা ফিরেছিল বটে, কিন্তু ত্রিশ শতাংশ দিনে মাথাপিছু বত্রিশ টাকার বেশি রোজগার করতে পারেননি। কিন্তু সম্পদের অসম বণ্টন হলেও দেশজুড়ে একটা সমৃদ্ধির হাওয়া বইছিল ও ২৫ শতাংশ মানুষের জীবনযাত্রা উন্নত দেশের সমতুল্য হয়ে উঠেছিল।
সম্প্রতি তরুণ পেশাদার ভারতীয়দের সমৃদ্ধ জীবনযাত্রা নিয়ে হিন্দুস্তান টাইমস সমীক্ষা পরিচালনা করেছে। তাতে দেখা গেছে, ৬৪ শতাংশ পেশাদার ভারতীয়র টেলিভিশন, ল্যাপটপ, ওয়াশিং মেশিন, আইপড, এলসিডি ইত্যাদি রয়েছে।
১৯৯০ সালের পর থেকে ভারতীয়দের মধ্যে আর্থিক সমৃদ্ধি আসতে শুরু করে। বেসরকারি শিল্পে রমরমা, ব্যবসায়ীদের হাতে কালো টাকা, রাজনৈতিক নেতাগিরি ও মাফিয়াগিরির ফলে ৭০ ভাগ লোকের হাতেই পয়সা আসে। কালো টাকার অবাধ লেনদেনের ফলে সবক'টি বড় শহরে ব্যবসায়ীরা লাল হয়ে ওঠেন। অন্যদিকে বিশ্বের ক্ষুধার্ত ৮৮টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান এখন ৬। বিশ্বে পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত কম ওজনের শিশুর ৪২ শতাংশ ভারতে বাস করে। ভারতে কালো টাকার পরিমাণ কী রকম এর একটি বিবরণ সিপিএমের মুখপত্র গণশক্তি ১৫ সেপ্টেম্বর প্রকাশ করেছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, সম্প্রতি গ্রেফতার হওয়া হাসান আলী ৩৬০০ কোটি কালো টাকার মালিক। লিকস্টেনস্টাইন নামের বিদেশি ব্যাংকে ২৬ জন ভারতীয়র কোটি কোটি কালো টাকা আছে। বিচারপতি সন্তোষ হেগড়ের রিপোর্ট অনুযায়ী, শুধু কর্নাটক থেকে ৩৫ লাখ টন আকরিক লোহা বেআইনিভাবে বিদেশে রফতানি হয়ে গেছে। অনেকে মনে করছেন, ভারতের এই শোচনীয় আর্থিক অবস্থার কারণ সরকারের হাতে উন্নয়নের টাকা নেই। দেশের অর্থনীতি অসাধু ব্যবসায়ী আর কালোবাজারিদের হাতে। গত কয়েক বছরে অনেক মন্ত্রীর আর্থিক সম্পদ কয়েকগুণ বেড়েছে। কয়েক লাখ সরকারি পদ খালি আছে। এর মধ্যে ভারতীয় রেলেই লাখ লাখ পদ খালি। বিভিন্ন রাজ্য সরকার দেউলিয়া। পশ্চিমবঙ্গেই নতুন তৃণমূল সরকারের ঘাড়ে সাবেক সরকারের দুই লাখ কোটি টাকার দেনা। তারপরও তৃণমূল নেত্রী নতুন নতুন প্রকল্প ঘোষণা করে চলেছেন। দুই লাখ বেকারকে চাকরি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তিনি এ জন্য দিলি্লর সাহায্য প্রার্থী। এ জন্য অন্যান্য রাজ্য দিলি্লকে হুশিয়ারি দিয়ে রেখেছে, অন্য রাজ্যকে বঞ্চিত করে পশ্চিমবঙ্গকে সাহায্য করা চলবে না।
দেশজুড়ে বিদ্যুৎ সংকট, নিত্যব্যবহার্য জিনিসপত্রের লাগামছাড়া দাম আর কয়েক কোটি বেকার মানুষ_ এই সমৃদ্ধি আর কতদিন টেকে তা-ই এখন দেখার।

ড. পার্থ চট্টোপাধ্যায় : ভারতীয় সাংবাদিক
 

No comments

Powered by Blogger.