বোরো উৎপাদনে সরকারের সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ by আলতাব হোসেন

লতি মৌসুমে বোরো উৎপাদনে সরকারের সামনে এখন অনেক চ্যালেঞ্জ। সারাদেশে বোরো বীজের তীব্র সংকট চলছে। কৃষকরা বিএডিসির বীজের জন্য হন্যে হয়ে ছুটলেও পাচ্ছেন না। তবে বাড়তি দামে কালোবাজারে কিছু বীজ মিলছে। বীজের পাশাপাশি বিদ্যুৎ সংকট নিয়েও আতঙ্কে আছেন কৃষক। এ ছাড়া মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে দেখা দিয়েছে সার ও ডিজেলের কয়েক দফায় মূল্যবৃদ্ধি। এক হিসাবে দেখা গেছে, জ্বালানি তেল ও ইউরিয়া সারের দাম


বাড়ানোর কারণে আসন্ন বোরো মৌসুমে কৃষকের ওপর অতিরিক্ত আড়াই হাজার কোটি টাকা খরচের চাপ পড়বে।
সারাদেশে এখন বোরোর বীজতলা তৈরি হচ্ছে। আমন কাটা শেষে বোরো রোপণ হবে। ডিসেম্বর থেকে মার্চ হচ্ছে বোরো মৌসুমের মূল সময়। তবে কৃষকরা বলছেন, সার ও ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে মৌসুমের শুরুতেই তাদের বড় পুঁজির প্রয়োজন। সরকার ডিজেল খাতে ভর্তুকি না দিলে তাদের পক্ষে মাঠে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়বে। চলতি আমন মৌসুমেও কৃষক ধানের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না। কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাবে প্রতি মণ ধান উৎপাদনে কৃষকের উৎপাদন খরচ পড়েছে পৌনে ৭শ' টাকা। অথচ বাজারে ধান বিক্রি হচ্ছে ৫শ' থেকে ৬শ' টাকা মণ। এবার পাটেরও ভালো দাম পাননি কৃষকরা। দেশের প্রধান ফসল বোরোতে ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত না হলে কৃষকরা বোরো উৎপাদনে আগ্রহ দেখাবেন না বলে মনে করছেন কৃষি বিশেষজ্ঞরা। সরকার বোরো মৌসুমে প্রায় ৪৮ লাখ হেক্টর জমিতে এক কোটি ৯২ লাখ টন ধান উৎপাদনের টার্গেট নিয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারের গুদামে এখন খাদ্যের মজুদ সন্তোষজনক থাকলেও বোরো উৎপাদন ভালো না হলে বেকায়দায় পড়তে হবে। কারণ চলতি মৌসুমে চাল রফতানিকারক দেশ থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামে ভয়াবহ বন্যার কারণে উৎপাদন বিপর্যস্ত হয়েছে। এসব দেশই অন্য দেশ থেকে চাল আমদানির চেষ্টা করছে। আন্তর্জাতিক বাজারে ৫শ' ডলারের নিচে থাকা চালের দাম ইতিমধ্যে প্রায় ৬শ' ডলার ছুঁয়েছে।
বীজ সংকট : চলতি বছর প্রায় এক লাখ ১০ হাজার টন বোরো বীজের প্রয়োজন। বিএডিসি সরবরাহ করবে ৬৫ হাজার টন। এখন বীজ রোপণের পুরো মৌসুম চলছে। তবে কৃষকরা বিএডিসির বীজ পাচ্ছেন না বলে সারাদেশেই অভিযোগ উঠেছে। বিএডিসির ১০ কেজির ধান বীজের প্যাকেটের অতিরিক্ত দাম নেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। বিএডিসি ১০ কেজির প্যাকেট ৩৮০ টাকা নির্ধারণ করে দিলেও তা কালোবাজারে বিক্রি হচ্ছে ৫শ' টাকার বেশি দামে। বীজ উইংয়ের মহাপরিচালক আনোয়ার ফারুক সমকালকে বলেন, সারাদেশে এবার পর্যাপ্ত বীজ সরবরাহ করা হয়েছে। বিএডিসির ৪ হাজার ডিলার বীজ বিক্রি করছেন। চলতি মৌসুমে প্রায় ১১ হাজার টন হাইব্রিড বীজ বিক্রি হবে বলেও তিনি জানান। বাকি বীজ কৃষক পর্যায়ে মজুদ আছে বলে জানান তিনি।
ইউরিয়ায় অতিরিক্ত দেড় হাজার কোটি টাকা : সরকার চলতি বছরের জুন মাসে ইউরিয়ার দাম কেজিতে আট টাকা বাড়িয়ে ১২ টাকা থেকে ২০ টাকা করেছে। এরপর সেপ্টেম্বর মাসে ডিজেলের দাম পাঁচ টাকা এবং সর্বশেষ ১০ নভেম্বর দ্বিতীয় দফায় আবারও পাঁচ টাকা বৃদ্ধি করে। এর ফলে গত বোরো মৌসুমের তুলনায় সেচকাজে ব্যবহৃত প্রতি লিটার ডিজেলে ১০ টাকা খরচ বেশি হবে। ফলে আসন্ন বোরো মৌসুমে ডিজেলচালিত সেচযন্ত্রগুলো চালাতে অতিরিক্ত টাকা গুনতে হবে। সরকারি ও বেসরকারি হিসাবে এ অতিরিক্ত খরচের জন্য কেজিপ্রতি ধান উৎপাদন ব্যয় প্রায় দেড় টাকা বেড়ে যাবে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্য মতে, দেশে প্রতি বছর প্রায় ২৮ লাখ ৩১ হাজার টন ইউরিয়া সার ব্যবহৃত হয়। এর মধ্যে বোরো মৌসুমে লাগে ১৮ লাখ টন। ইউরিয়া প্রতি কেজি আট টাকা বৃদ্ধি পাওয়ায় সাড়ে ১৪শ' কোটি টাকা অতিরিক্ত ব্যয় করতে হবে। এ ব্যাপারে ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক ও কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. মাহবুব হোসেন সমকালকে বলেন, জ্বালানি তেল ও ইউরিয়া সারের মূল্যবৃদ্ধির ফলে উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাবে।
ডিজেলে অতিরিক্ত ব্যয় হবে ১১শ' কোটি টাকা : বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) ক্ষুদ্র সেচ বিভাগের প্রধান প্রকৌশলী আকতার হোসেন খান জানান, ২০১০-১১ অর্থবছরে দেশে সেচের জন্য ১৫২ কোটি ৯০ লাখ লিটার ডিজেল ব্যবহার করা হয়েছে। এছাড়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের (ডিএই) হিসাবে শুধু বোরো মৌসুমে ১১০ কোটি লিটার ডিজেল ব্যবহৃত হয়। এ হিসাবে শুধু সেচ বাবদ কৃষকদের অতিরিক্ত ১১০০ কোটি টাকা খরচ বাড়বে।
বিদ্যুৎ নিয়ে দুশ্চিন্তা : বিদ্যুৎ বিভাগের হিসাবেই বোরো মৌসুমে সেচ পাম্প চালাতে গড়ে প্রয়োজন হয় অতিরিক্ত এক হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। বোরো মৌসুমে সারাদেশে বিদ্যুৎ পরিস্থিতির চরম অবনতির আশঙ্কা করেছে খোদ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড। তাদের ধারণা, চাহিদার বিপরীতে উৎপাদন কমে যাওয়ায় সেচ মৌসুমের পিক পিরিয়ড ডিসেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত বিদ্যুৎ সংকট থাকতে পারে। সেচকাজে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য বিদ্যুৎ বিভাগ ইতিমধ্যে কয়েকটি সভা করেছে। সেচকাজে অঞ্চলভিত্তিক বিদ্যুতের চাহিদা নিরূপণ করার কাজও শুরু করে দিয়েছে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি।
ডিজেল ভর্তুকি : গত বছর বোরো মৌসুমে সেচকাজে কৃষকদের ডিজেল ভর্তুকি দেওয়া হয়নি। তার আগের বছর ডিজেল ব্যবহারে ৭৪৮ কোটি ৭১ লাখ টাকা ভর্তুকি দেয় কৃষি মন্ত্রণালয়। ৮৩ লাখ ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষককে জনপ্রতি ৮০০ টাকা এবং ৭ লাখ ৮৯ হাজার মাঝারি পর্যায়ের কৃষককে জনপ্রতি এক হাজার টাকা হারে ভর্তুকি দেওয়া হয়। সরকারের কাছে এবারের বোরো মৌসুমেও ডিজেলে ভর্তুকির দাবি জানিয়েছেন কৃষকরা।
কৃষি সচিব সিকেকিউ মোস্তাক আহমদ সমকালকে বলেন, ডিজেল ভর্তুকির বিষয়টি নিয়ে এখনও আলোচনা হয়নি। কৃষকবান্ধব এ সরকার কৃষকের স্বার্থে যে কোনো ভালো সিদ্ধান্ত নিতে প্রস্তুত। কৃষক যেন তার উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য পান তার দিকে বিশেষ দৃষ্টি রাখছে সরকার।
এদিকে ডিজেল মজুদ বাড়াতে বিপিসিকে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে নির্দেশ দিয়েছে সরকার। সারাদেশে ডিসেম্বরের শেষ থেকে মার্চ মাসের জন্য প্রায় ৬ লাখ টন ডিজেল মজুদ করার পরিকল্পনা নিয়ে এগুচ্ছে বিপিসি। এর মধ্যে কেবল উত্তরাঞ্চলে ডিজেল দেওয়া হবে চার লাখ টন।

No comments

Powered by Blogger.