পাহাড়ের কোলে-অদেখা সাজেকের পথে দীঘিনালা by বিপ্রদাশ বড়ুয়া

দী, ঝরনা, গাছ ও পাহাড়-পর্বতের মহিমা দেখতে চললাম খাগড়াছড়ি, দীঘিনালা, বাঘাইহাট পেরিয়ে সাজেক পাহাড় ও এর উপত্যকায়। কার্তিকের ফুরফুরে কুয়াশা দিনেও থাকে গ্রামের গায়ে আবরক হয়ে। এর সঙ্গে ভেজালের মতো কলকারখানার ধোঁয়া। ঢাকা থেকে ষোলোই অক্টোবরের (২০১১) সকাল আটটা পনেরোর খাগড়াছড়ির বাসে প্রথম মেঘনা ঘাটে পৌঁছলাম। কুয়াশার সঙ্গে মিশে আছে দুঃস্থ রাজনীতির মতো সিমেন্ট কারখানার গুঁড়োর আস্ফালন।


জানালা দিয়ে ঢুকে পড়ছে বিষাক্ত ধোঁয়ার দুর্গন্ধ। নস্যির মতো ধুলোবালি ও নির্মল হাওয়া ঢুকছে।
বিখ্যাত নিমসার বাজারের তরকারির খাঁচা ও বস্তা থেকে কেমিক্যালের গন্ধ পাচ্ছি না তো! এই যাত্রায় আমার সহচর কালের কণ্ঠের ফটোশিকারি শেখ হাসানকে নিমসারের বিপুল সবজির কৌমার্য আছে কি না জানতে চাইলাম। ফল, তরকারি, মাছ, পানীয়, রুটি-বিস্কুট কারো সতীত্ব নেই আমাদের দেশে। পার্বত্য চট্টগ্রামের ফলমূলে হয়তো এখনো আছে। অরণ্যের নেই। পাহাড়ের নেই। ঝরনা, হ্রদ, পুকুর, ব্যবসায়ী কারো নেই। 'নেই' আছে শুধু।
করেরহাট ফেলেই পথে পথে কলার ছড়ার স্তূপ। ব্যবসায়ীরা কিনে নিয়ে স্তূপ করে রেখেছেন ঢাকায় নিয়ে যাওয়ার জন্য। কাঁঠালি ও চিনিচাঁপার ভূস্বর্গ পার্বত্য চট্টগ্রাম। কিন্তু বেশির ভাগ অপুষ্ট। আর দশ-কুড়ি দিন থাকলে সোমত্ত হয়ে উঠত। গরিব পাহাড়িদের সে সময় দেওয়ার সামর্থ্য নেই। খোলা ট্রাকে তুলছে। গরু যেমন ঠেসে ট্রাকে তোলে তেমনি ফলমূলও। ট্রাকের দেয়ালের গায়ে নরম আবরণ দেওয়ার বালাই নেই। এতে পণ্যের মান খুব ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ক্বচিৎ দু-চার খাঁচা বা বস্তায় আদা। কোরবানির
ঈদের জন্য তোলা। জুমের কাঁচা সবজি এখন নেই। ধানি লঙ্কাও কম, শুকনো আছে। ধানও উঠে গেছে। রামগড়ে ঢোকার মুখে ব্র্যাকের চা বাগান। চার কোণা কাপড়ে গিঁট দিয়ে থলের মতো করে কাঁধে ঝুলিয়ে নিয়ে তাতে চায়ের দুটি পাতা একটি কুঁড়ি তুলে নিচ্ছে। সেই আদিবাসী রমণীরা। এক পাশে চা পাতার স্তূপের কাছে শিশুসন্তানও খেলছে। একেবারে দুগ্ধপোষ্য।
বাঁয়ে ফেনী নদী। একান্তই বাংলাদেশের নদী। উজানের এ অংশ খাগড়াছড়ি জেলা ও ভারতের ত্রিপুরার সীমানা হয়ে ফেনী জেলায় ঢুকেছে। ঘোলা পানি, অর্থাৎ গত রাতে বৃষ্টি হয়েছিল। ছড়ায়ও ঘোলা পানির স্রোত। বালু-চকচক বুক ছড়ার। ঘোলা জলের ওড়না সরে বিবৃত হয়ে আছে। এখানে গর্ত করে শীতকালে খাবার পানি সংগ্রহ করে পাহাড়িরা। আমি খেয়ে তেষ্টা দূর করেছি একাত্তরে এই পথে রামগড়ে আসার সময়।
ফটিকছড়ি থেকেই পাহাড়ের শুরু, তার আগে টিলা। রামগড় থেকে খাগড়াছড়ি পর্যন্ত বাগান করা বনে সেগুনই প্রধান। তারপর গামারি। এদের বয়স তারুণ্যে ভরা, এই তিরিশ ধরুন। মাঝে মাঝে নিঃসঙ্গ নাতি-তরুণ চাপালিশ এক পায়ে খাড়া। ডালপালা মাথার ওপর। পা থেকে আবক্ষ ডালহীন। আঁকাবাঁকা, উঁচুনিচু ও বিপজ্জনক বাঁক। পাহাড়ের ঢালে হলুদ, মাঝেমধ্যে আদা। আনারস দেখা যায় না। মাঝেমধ্যে এক-দেড় বছরের বাঁশ। নিবিড় বাঁশবাগান ও স্বাভাবিক অরণ্য কোথাও নেই। দু-তিন জায়গায় চাঁপা বন, এগুলো কাঠের জন্য বন বিভাগের রোয়া। হে প্রিয় পাঠিকা ও পাঠক, আমি নিশ্চিত যে সঙ্গে সঙ্গে আপনার মনে পড়েছে, 'মাখব গায়ে ফুলের রেণু চাঁপার বনে লুটি' গানের কলি। ফুল না থাকলেও গন্ধ এসে হানা দেয় মনে। পার্বত্য চট্টগ্রামে এত ঘুরেছি, কোথাও এক শ বছুরে বৃক্ষের গভীর অরণ্য পাইনি। তাদের গা থেকে অজগরের মতো পুষ্ট লতা ঝুলে থাকতে দেখিনি। বাঘ-হরিণ দেখেছি মাত্র দুই বার। ১৯৭২ সালে চন্দ্রঘোনার বড়ইছড়িতে রাস্তা পার হওয়া নির্ভয় বাঘ। বছর পাঁচেক আগে বোট থেকে দেখেছি কর্ণফুলীতে পানি খেতে আসা হরিণ-বানর। হাতির পাল্লায় পড়েছিলাম একবার, ১৯৬৫ সালের ওয়াগ্গা চা বাগানে।
১৮৬০ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামকে 'অ্যাক্ট ২২ অপ্ ১৮৬০' বিধান মতে চট্টগ্রাম জেলা থেকে ছিন্ন করা হয়। এর খাজনা ব্রিটিশ সরকার নিত চাকমা রাজা থেকে। প্রথমে চন্দ্রঘোনা ও পরে রাঙামাটি হয় রাজধানী। ১৮৮১ সালের পহেলা সেপ্টেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম চাকমা সার্কেল, বোমাং সার্কেল ও মং সার্কেলের সীমা নির্ধারিত হয়। রাজারা স্ব-স্ব সার্কেলের ইংরেজ গভর্নমেন্টের কর্মচারী ছাড়া অন্য প্রজাদের শাসন করতে পারতেন। রামগড় মং রাজার এলাকা। বাস ছুটছে। চারদিকে ধু-ধু পাহাড়, কিছু হাটবাজার ও বাঙালি জনপদ। মাঝেমধ্যে সামরিক এলাকা। রাস্তার পাশে স্কুল, স্কুলের পোশাকে ছাত্রছাত্রী। কচু ও আদার ভার কাঁধে চাষী। বৈদ্যুতিক তারে দুটি প্রেমকাতর ঘুঘু। নিঃসঙ্গ কিশোর গো-শালিক, সে এ বছর জন্ম নিয়েছে, এখনো সঙ্গী নির্বাচন করতে পারেনি! একা ত্রিপুরী মেয়েটি লাকড়ির বিশাল বোঝা নিয়ে যাচ্ছে ঘরে। ১৯৯৭ সালে পার্বত্য শান্তি চুক্তি হওয়ার পরের দিন আগরতলা থেকে পাহাড়ি আদিবাসীদের ঘরে ফেরার সাক্ষী হতে এখানে এসেছিলাম। সঙ্গে ছিল ছড়াগল্পকার রহীম শাহ। ১৯৭১ সালে ৯ মাস শরণার্থীদের দুঃখের কথা মনে আছে? এঁরা নিজ দেশে ফিরছেন এক যুগ পরে। কারো শৈশব শেষ, কারো যৌবন, প্রৌঢ়দের বার্ধক্য, বুড়োদের মৃত্যু। সেই শান্তি চুক্তি এখনো আকাশে ঝুলছে তারা হয়ে। অধরা মাধুরী।
পুলের নিচে স্রোতস্বিনীর ঘোলা জল, কোনোটির স্বচ্ছতোয়া। গত রাতের বৃষ্টির কারণে। পথে পথে বটগাছ। কোনোটিই আমার বয়সী নয়। অনুজ। ঝুরিহীন ও ঝুরিময়। রামগড়ের সামরিক এলাকায় কয়েকটি আশি-নব্বই বছুরে বৃক্ষ মহাশয় আছেন। বাংলা একাডেমীর পঞ্জিকা মতে আজ পহেলা কার্তিক। শিউলি ও ছাতিম ছাড়া প্রধান কোনো ফুল নেই। জুমের ফসল উঠে গেছে। কিছু ঘইস্যা সাদা ফুল নিয়ে ভ্রমর ও প্রজাপতিদের জন্য বিবৃত হয়ে আছে। মৌমাছিরা এখন চাকছাড়া। গায়ের ওপর গায়ে আটকে জড়ো হয়ে আছে। খায়দায় না, উড়ে কোথাও যায় না। ধর্মরাজিক বৌদ্ধ বিহারে ২৯ আগস্ট থেকে বড় এ রকম একটি ঝাঁক মহুয়া গাছে থিতু হয়ে আছে। আমি ওদের চোখের দর্পণে ধরে আছি, পর্যবেক্ষণ করছি। মৌমাছির এই স্বভাব আমার জানা ছিল না।
পৌঁছে এলাম আলুটিলায়। বটবৃক্ষের ডালপালার ফাঁক দিয়ে খাগড়াছড়ি উপত্যকা চিত্রবৎ। আলুটিলার পাশের পাহাড়ের শীর্ষে এক চাঁদনি রাতে ত্রিপুরী বাড়িতে ক্ষণিকের অতিথি হয়েছিলাম। কী সম্মান ও আতিথেয়তাই না উপহার দিল! ওপাশে পাহাড়চূড়োয় বৌদ্ধ প্যাগোড বা ক্যাং। আশপাশে বনের মতো গাছপালা ও জঙ্গল। সৌন্দর্য ও মর্মভেদী অনুভব! উড়ে যাচ্ছে পলকা মেঘ।
খাগড়াছড়ি বা খাঁরাছড়িতে পেঁৗছে বাস থামল। কালের কণ্ঠের সাংবাদিক দাউদ ও সমকালের প্রদীপ অপেক্ষা করে আছে। এক পেয়ালা চা পান না করা পর্যন্ত কোনো কথা বলতে রাজি না আমি। ধাতস্থ হওয়া যাকে বলে। প্রদীপ নাকি দাউদ পালকি বা টমটম ধরল। দীঘিনালার গাড়ি ধরলাম। আরো সোয়া ঘণ্টার পথ। ওখানে চাকমা ভাষার প্রথম ঔপন্যাসিক কে. ভি. দেবাশীষ চাকমা অপেক্ষা করে আছেন। বার চারেক ফোন করেছেন। সূর্য ডুবুডুবু। চেনা পথ। গাড়িচালক দীপক চাকমা আগামীকালের জন্য উইলিস জিপ ভাড়া করে দিলেন। কালের কণ্ঠের দীঘিনালা প্রতিনিধি ও প্রথম আলোর পলাশ বড়ুয়ার সঙ্গে চা। কাল সকালে সুদূর সাজেক যাব। কালকের স্বপ্ন আমার চোখে।

No comments

Powered by Blogger.