ক্যান্সার-চিকিৎসা চাই দেহ ও মনে by ইলা চন্দ

ক্যান্সার যেভাবে বাংলাদেশে বেড়ে চলছে তাতে সরকারি ও বেসরকারি সব হাসপাতালে উন্নত চিকিৎসা সুবিধার সুব্যবস্থা করা প্রয়োজন। প্রয়োজন বিত্তবানদের ডোনেশন দেওয়া। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, টাটা হাসপাতালের এটি বড় ব্যয়ভার বিত্তবানরা বহন করেন\একটি দৈনিকে 'ক্যান্সার হাসপাতাল রোগী বেশি সেবা কম' শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। হাসপাতালের বারান্দায় যন্ত্রণাকাতর হোসনেয়ারা বেগম নামে এক রোগীর অনুরোধ 'যদি


চিকিৎসাসেবা না পান, তাকে যেন একটা গাড়িতে তুলে দেওয়া হয়'। রাজধানীর জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও হাসপাতালে প্রতিদিন গড়ে ৩০০ রোগী আসেন রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসাসেবা নিতে। অনেকে জানিয়েছেন, রোগ ধরা পড়ার পর এক থেকে দেড় মাস সময় লেগেছে চিকিৎসা শুরু হতে। যার থেরাপি দরকার আজ তিনি পাচ্ছেন দেড়-দুই মাস পর। প্রতিবেদনটি পড়ার পর মনে হয় রোগীদের জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দিই, চিকিৎসার সুব্যবস্থা করি। আমি একজন ক্যান্সার সারভাইবার। ব্রেস্ট ক্যান্সার হয়েছিল ২০০৭ সালে। ভারতের টাটা মেমোরিয়াল হাসপাতালে ছয় মাস চিকিৎসার পর আমি সুস্থ। চিকিৎসা নেওয়ার সময় দেখেছি বাংলাদেশ থেকে অনেক রোগী আসেন। যার একটু সাধ্য আছে এই হাসপাতালে চলে আসেন। এটি ক্যান্সার নিয়ে সার্বিক গবেষণারও অত্যাধুনিক কেন্দ্র। চিকিৎসা খরচ তুলনামূলক অনেক হাসপাতালের চেয়ে কম। অভাবে বিনা চিকিৎসায় সেখান থেকে কেউ ফেরত আসেন না। যার সামর্থ্য নেই তিনি যথোপযুক্ত কাগজপত্র দেখিয়ে চিকিৎসা পান। ক্যান্সার শনাক্তের পর আমার কী চিকিৎসা এখনই প্রয়োজন সে সম্পর্কে আমাকে ও আমার সঙ্গে থাকা পরিজনকে ভালোভাবে বোঝানো হয়েছে। ভয় পেয়ে দেশে থাকা আমার মেয়েকে একবার দেখানোর ব্যবস্থা করার জন্য সবাইকে অনুরোধ করেছি। কিন্তু হাসপাতালে কাউন্সেলিংয়ের পর পারলাম এখানকার চিকিৎসায় অর্থাৎ অস্ত্রোপচার, কেমোথেরাপি ও রেডিওথেরাপির পর ভালো হয়ে যাব তখন নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখেছি। জানতে পেরেছি ধৈর্য ধরে চিকিৎসা শেষ করতে হবে। আমার অস্ত্রোপচারের পর টাটার ডাক্তাররা বলেছিলেন প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী দেশে গিয়ে বাকি চিকিৎসা নিতে। কিন্তু আমি প্রতিদিন ৮০০ টাকা রুম ভাড়া নিয়ে ওখানেই থেকে গেছি। কারণ, দেশে চিকিৎসাসেবা সম্পর্কিত অভিজ্ঞতাজনিত ভীতি। আমার ক্যান্সার শনাক্তের বেশ কিছুদিন আগে গাইনি চিকিৎসার জন্য বাংলাদেশের একটি বিখ্যাত হাসপাতালে গিয়েছিলাম। তখন ব্রেস্টে মাঝে মাঝে একটা জায়গায় চাকার মতো অনুভূত হতো। এক বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের সহযোগী পরীক্ষা করে বললেন, 'সমস্যা নেই'। পরে আমি বুঝেছি তখন যদি ডায়াগনোসিস ঠিকমতো হতো, মেমোগ্রাম টেস্ট করা হতো, হয়তো আজ আমাকে এ পর্যায়ে আসতে হতো না। টাটার চিকিৎসার পাশাপাশি ডাক্তার ও নার্সরা বলতেন কী খেতে হবে। কারণ কেমোথেরাপি ও রেডিওথেরাপিতে রক্তের অনেক উপাদান, বিশেষত লাল ও সাদা রক্ত কণিকা কমে যায়। বেশি করে উপযুক্ত খাদ্য খেয়ে এই রক্তের উপাদানের লেভেল ঠিক রাখতে হয়। নতুবা পরবর্তী নির্ধারিত সময় কেমো নেওয়া যায় না, যার কারণে চিকিৎসার ব্যাঘাত হয়। ক্যান্সার সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা বা অভিজ্ঞতা ছিল না। কিন্তু টাটা হাসপাতালে গিয়ে আমি আমার অবস্থা, অন্যদের অবস্থা পারস্পরিক আলোচনায় জানতে পেরেছি অল্প সময়ের মধ্যে। আজ যখন দেখি ক্যান্সার আক্রান্ত রোগী চিকিৎসা পাচ্ছে না তখন খুব খারাপ লাগে। যদি হাসপাতালের বারান্দায় প্রতীক্ষায় থাকতে হয় কখন চিকিৎসা শুরু হবে_ এই চিন্তায়, তাতে ক্যান্সার রোগীর আরও অসুস্থ হয়ে পড়ার শঙ্কা বাড়ে। এখন সব ক্যান্সার মরণব্যাধি নয়। প্রাথমিকভাবে ধরা পড়লে এবং উপযুক্ত চিকিৎসা হলে বাঁচার সম্ভাবনা। তবে চিকিৎসা, বিশেষত কেমোথেরাপি নেওয়া কষ্টকর। শরীরে প্রচণ্ড ব্যথা হয়, ডায়রিয়াসহ বিভিন্ন উপসর্গ শুরু হয়। প্রয়োজন হয় মানসিক চিকিৎসা।
ক্যান্সার যেভাবে বাংলাদেশে বেড়ে চলছে তাতে সরকারি ও বেসরকারি সব হাসপাতালে উন্নত চিকিৎসা সুবিধার সুব্যবস্থা করা প্রয়োজন। প্রয়োজন বিত্তবানদের ডোনেশন দেওয়া। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, টাটা হাসপাতালের এটি বড় ব্যয়ভার বিত্তবানরা বহন করেন। শুধু তাই নয়, প্রায়ই তারা রোগীদের উন্নত মানের খাদ্য ও বস্ত্রসামগ্রী প্রদান করে থাকেন। প্রয়োজন ভেজালমুক্ত খাবারের নিশ্চয়তা, ভালো পরিবেশের ব্যবস্থা, সচেতনতা বৃদ্ধি। যেমন_ নিয়মিত ডাক্তার দেখানো, শরীরের অস্বাভাবিক কোনো পরিবর্তন ঘটলে সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তারের কাছে যাওয়া এবং মেয়েদের মেমোগ্রাম টেস্টসহ নিজ উদ্যোগে স্তনে টিউমার পরীক্ষার পদ্ধতি শেখা। ক্যান্সার একবার হলে বেঁচে গেলেও জীবনে অনেক বড় ধাক্কা খেতে হয়, অনেক নিয়ম-কানুন ও অভ্যাসের পরিবর্তন করতে হয়, সব সময় থাকতে হয় সতর্ক। কারণ ক্যান্সার একবার ভালো হয়ে গেলেও যে কোনো সময় আবার হতে পারে।

ইলা চন্দ : ক্যান্সার সারভাইবার ilachanda2008@hotmail.com

No comments

Powered by Blogger.