রক্তদান ও মরণোত্তর চক্ষুদান দিবস-মানবসেবায় এগিয়ে আসুন

৯৭৮ সালের ২ নভেম্বর ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রছাত্রীদের নতুন গড়া একটি সংগঠন 'সন্ধানী' আয়োজন করেছিল স্বেচ্ছায় রক্তদান কর্মসূচির। সেখানে স্বেচ্ছায় রক্তদানকারী ২৭ জনের মধ্যে একজন শিক্ষক ছাড়া আর সবাই ছিলেন কলেজেরই ছাত্রছাত্রী। ধীরে ধীরে স্বেচ্ছায় রক্তদানের ধারণাটি বিস্তৃতি লাভ করে। সন্ধানীর পাশাপাশি রেড ক্রিসেন্ট, অরকা, কোয়ান্টাম, বাঁধনসহ অনেক সংগঠন স্বেচ্ছায় রক্তদান বিষয়ে মানুষকে উদ্বুদ্ধকরণ ও রক্ত সংগ্রহ,


সরবরাহ প্রভৃতি কর্মসূচিতে এগিয়ে আসে। ফলে স্বেচ্ছায় রক্তদান এখন আর অসাধারণ কোনো ঘটনা নয়। আত্মীয়-পরিজনদের প্রয়োজনে রক্তদানও এখন স্বাভাবিক ঘটনা। তবু এখনো বাংলাদেশের বার্ষিক রক্ত চাহিদার পুরোটা স্বেচ্ছায় রক্তদাতাদের মাধ্যমে পূরণ হচ্ছে না। এখনো পেশাদার রক্তদাতারা আছে, চলছে রক্ত বেচাকেনা, অবৈধভাবে গড়ে ওঠা ব্লাড ব্যাংকগুলোর অনৈতিক কর্মকাণ্ডের খবর প্রায়ই আমরা দেখছি পত্রপত্রিকায়। পেশাদার রক্তদাতারা টাকার বিনিময়ে রক্ত দেয়। আমাদের দেশে পেশাদার রক্তদাতাদের বেশির ভাগই মাদকাসক্ত বা অন্যান্য রোগে আক্রান্ত। মূলত নেশার টাকা জোগাড়ের জন্যই তারা রক্ত বিক্রি করে। তারা ভোগে রক্তবাহিত নানা রোগে। পেশাদারদের রক্ত বিক্রির মাধ্যম হিসেবে অলি-গলিতে গড়ে ওঠা ব্লাড ব্যাংকগুলোও যথাযথ পরীক্ষা ছাড়াই রোগীদের সরবরাহ করছে তাদের রক্ত। এই রক্ত গ্রহণ করায় রোগী সাময়িক সুস্থ হলেও দীর্ঘমেয়াদে রক্তবাহিত জটিল কোনো রোগ যেমন_এইডস, হেপাটাইটিস-বি ও সি, সিফিলিস, ম্যালেরিয়া, কালাজ্বর, ফাইলেরিয়া ইত্যাদিতে আক্রান্ত হতে পারেন। দেখা গেছে, পেশাদার রক্তদাতাদের বেশির ভাগই পুষ্টিহীনতায় ভোগে এবং রক্তের অন্যতম উপাদান হিমোগ্লোবিন তাদের দেহে কম থাকে। ফলে এক ব্যাগ রক্তে যতটুকু হিমোগ্লোবিন রোগীর পাওয়ার কথা, তা সে পায় না। রক্তের প্রয়োজন, এমন মুমূর্ষু রোগীদের নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালন নিশ্চিত করতে এগিয়ে আসতে হবে সচেতন নীরোগ মানুষদেরই। ১৮ থেকে ৬০ বছর বয়সী যেকোনো সুস্থ, নীরোগ মানুষ (পুরুষের ক্ষেত্রে ওজন কমপক্ষে ৪৮ কেজি, মেয়েদের ক্ষেত্রে ৪৫ কেজি)_যাদের রক্তে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ ১২ গ্রাম/ডেসিলিটার বা তার বেশি, সিস্টোলিক রক্তচাপ ১০০ থেকে ১৬০ মিমি পারদচাপ, ডায়াস্টোলিক রক্তচাপ ৬০ থেকে ৯০ মিমি পারদচাপ, নাড়ির গতি ৬০ থেকে ১০০-এর মধ্যে, শরীরের তাপমাত্রা স্বাভাবিক_তারা প্রতি চার মাস পর পর এক ব্যাগ রক্ত (৩৫০-৪৫০ মিলিলিটার) দিতে পারে। এতে তেমন শারীরিক ক্ষতির কোনো সম্ভাবনা নেই। স্যাটেলাইট চ্যানেলের কল্যাণে রক্তদান সম্পর্কিত বিদেশি একটি বিজ্ঞাপন হয়তো অনেকেই দেখে থাকবেন। সেখানে দেখা যায়, রক্তদান করেছে_এ অজুহাতে একজন ক্রীড়াবিদ অনুশীলনে অনুপস্থিত থাকার মওকা খুঁজছেন। কিন্তু রক্তদান সম্পর্কে ওয়াকিবহাল কোচ ক্রীড়াবিদের এ বাহানায় পাত্তা না দিয়ে দ্রুত তাকে অনুশীলনে হাজির হতে বলেন। বিজ্ঞাপনের সারকথা হচ্ছে_রক্তদান করলে শরীর দুর্বল হয়ে যায় না বা দৈনন্দিন স্বাভাবিক কাজের ক্ষমতা হারায় না। কারো কারো ধারণা, রক্তদানের সময় খুবই ব্যথা পাওয়া যায়। দক্ষ হাতে রক্ত সংগ্রহ করা হলে শিরায় সুচ ঢোকানোর সময় একটু ব্যথা ছাড়া আর ব্যথা হয় না। রক্তদানের জন্য বিশেষ কোনো প্রস্তুতিরও দরকার পড়ে না। স্বাভাবিক খাওয়াদাওয়াই যথেষ্ট। তবে রক্তদানের আগে-পরে একটু বেশি পরিমাণে পানি পান করা উচিত। রক্তের বিকল্প কেবল রক্ত। বছরজুড়ে সব স্থানেই রোগীর নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালন নিশ্চিতকল্পে দেশের সর্বত্রই সক্ষম, নীরোগ মানুষদের স্বেচ্ছায় রক্তদানে এগিয়ে আসতে হবে। সব পরিসঞ্চালিত রক্তই স্বেচ্ছায় রক্তদানের মাধ্যমে সংগৃহীত হবে_২ নভেম্বর 'জাতীয় স্বেচ্ছায় রক্তদান ও মরণোত্তর চক্ষুদান দিবস' উপলক্ষে এটাই প্রত্যাশা।
ডা. মুনতাসীর মারুফ

No comments

Powered by Blogger.