সাধারণ মানুষ দ্রুতই নির্ধারক হয়ে ওঠে-নাসিক নির্বাচন by রফিউর রাবি্ব

নারায়ণগঞ্জকে সিটি করপোরেশন ঘোষণার পরপরই বিভিন্ন মহল থেকে প্রশাসক নিয়োগ না করে নির্বাচন দাবি করা হয় এবং নির্বাচন কমিশন এর আয়োজন করে। এ জনপদ সম্পর্কে যে নেতিবাচক ধারণা রয়েছে, আমরা চেয়েছি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মধ্য দিয়ে তার অবসান ঘটাতে। এক সময়ে প্রাচ্যের ডাণ্ডি বলা হতো নারায়ণগঞ্জকে। আশির দশকে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প, বিশেষ করে হোসিয়ারি শিল্পের ব্যাপক বিস্তার ঘটে এবং বলা যায়, নারায়ণগঞ্জ


নতুন করে অর্থনৈতিক গুরুত্ব ফিরে পায়। লাখ লাখ শ্রমিক গার্মেন্টে কাজ করছে এবং তাদের মধ্যে রয়েছে বিপুলসংখ্যক নারী। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, নতুন ধরনের শিল্পের বিকাশের হাত ধরে এসেছে সহিংসতা। ১৯৮৬ সালের সাধারণ নির্বাচনে তা প্রকট রূপ ধারণ করে। সামরিক শাসক এইচএম এরশাদের দল জাতীয় পার্টির প্রার্থীকে জয়ী করানোর জন্য নির্লজ্জভাবে প্রায় সব ভোটকেন্দ্র দখল করে নেওয়া হয় এবং তাতে আওয়ামী লীগের কিছু কর্মীকেও দেখা যায় সক্রিয়। এ প্রক্রিয়াতেই রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মঞ্চে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক 'তারকা সন্ত্রাসীর' আবির্ভাব ঘটে। তারা ধরাকে সরা জ্ঞান করতে থাকে, সমাজ হয়ে ওঠে অশান্ত। এক সময় তাদের কেউ কেউ অপারেশন ক্লিনহার্টের শিকার হয়, কেউ বলি হয় ক্রশফায়ারের। কেউবা হয় দেশান্তরী। কিন্তু সন্ত্রাসের বদনাম আর যায় না।
এ অবস্থায় নারায়ণগঞ্জবাসী হতাশায় নিমজ্জিত হতে থাকে। শুভশক্তির উপস্থি্থতি একেবারে ছিল না, তা নয়। কিন্তু তাদের কণ্ঠ ছিল ক্ষীণ। ১৯৯১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পরও পরিস্থিতির তেমন পরিবর্তন ঘটেনি। বিএনপির আশ্রয়েও নতুন নতুন সন্ত্রাসীর সৃষ্টি হতে থাকে। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর নারায়ণগঞ্জ শহরে শামীম ওসমান অসীম ক্ষমতাবান ব্যক্তিতে পরিণত হন। শুধু জেলা সদর নয়, গোটা জেলাতেই তার প্রভাব ছিল ব্যাপক। কিন্তু এ ক্ষমতা তিনি ইতিবাচক কাজে ব্যবহার করতে পারেননি। আমাদের এই জেলাটির সুনাম যে বিসর্জন হয়েছে সে জন্য তাকে বহুলাংশে দায়ী করা হয় এবং তা অমূলক নয়। ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াতে ইসলামী জোট ক্ষমতায় এলে তিনি দেশত্যাগ করার সুযোগে বিএনপির কিছু নেতার আশ্রয়ে আরেক দল সন্ত্রাসী মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে সরকার গঠন করলে দেশ ছেড়ে যাওয়া অনেকেই ফেরত আসে। শামীম ওসমানও কানাডা থেকে ফিরে তার হারানো অবস্থান ফিরে পেতে তৎপর হয়ে ওঠেন। ভূমিদস্যু-চাঁদাবাজরা সক্রিয় হতে থাকে। এ অবস্থায় সব শ্রেণী-পেশার মানুষ অসহায় বোধ করতে থাকে। সেলিনা হায়াৎ আইভী সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে প্রার্থী হওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন এমন প্রেক্ষাপটেই। তিনি আট বছর পৌরসভার চেয়ারম্যান ও মেয়র ছিলেন। নিজের নিষ্কলঙ্ক ও স্বচ্ছ ভাবমূর্তি তিনি তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছিলেন। জেলার আইন-শৃঙ্খলা সংক্রান্ত প্রতিটি সভায় তিনি সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সোচ্চার থেকেছেন এবং এ জন্য তার নিজের দল আওয়ামী লীগেরও যারা দায়ী তাদেরও ছেড়ে কথা বলেননি। তিনি অন্যায়ের বিরুদ্ধে আপসহীন এবং তাকে কেউ থামিয়ে দিতে পারে না_ জনমনে এমন আস্থা দৃঢ় হতে থাকে। আট বছর দায়িত্ব পালনকালে তিনি বেশ কিছু উন্নয়নমূলক কাজ করেন। সড়ক ও ড্রেনের কাজের সংস্কার হয়। ১৯৮৪ সালে নির্মিত শহীদ মিনারের পূর্ণাঙ্গ রূপ দেন। তিনি সরকার থেকে খুব বেশি অর্থ পাননি। পৌরসভার আয়ও সীমিত। কিন্তু যেহেতু দুর্নীতি ছিল না, তাই স্বল্প অর্থেও করা গেছে অনেক কাজ। দাতাদের কাছ থেকে তিনি কিছু অর্থ সংগ্রহ করেছেন। শহীদ মিনারে আমজনতাকে ডেকে তিনি তার সম্পর্কে অভিমত ও অভিযোগ শুনেছেন। দেশের সর্বত্রই জনপ্রতিনিধিরা নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে পারেন। সরকারের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের ব্যয়ে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার জন্যও তা প্রয়োজন।
নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার পর বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব দ্রুতই তৈমুর আলম খন্দকারের প্রতি সমর্থন জানায়। আওয়ামী লীগের সমর্থন থাকবে সেলিনা হায়াৎ আইভীর প্রতি, এটাই ছিল স্বাভাবিক প্রত্যাশা। তার আট বছরের কাজের ইতিবাচক মূল্যায়নে করা হলে অন্য কোনো সিদ্ধান্তে আসা যায় না। কিন্তু বাস্তবে ঘটেছে বিপরীত। তারা প্রথমে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগেছে, পরে অনেকে প্রকাশ্যে তৎপর হয়েছে শামীম ওসমানের পক্ষে। শুধুু নারায়ণগঞ্জে নয়, সারাদেশেই বিতর্কিত এক ব্যক্তির পক্ষে ঢাকা থেকে দলে দলে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা এসেছে। এই দলে বিতর্কিত ব্যক্তিরাও ছিলেন। তাদের কেউ কেউ বলেছেন, সেলিনা হায়াৎ আইভীর সঙ্গে কিছু মধ্যবিত্ত ও বস্তিবাসী এবং সাংস্কৃতিক কর্মী ছাড়া কেউ নেই। তার অর্থ নেই। বিএনপির প্রার্থীকে মোকাবেলা করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। তারা যখন সন্ত্রাস করবে, কালো টাকা ছড়াবে তার মোকাবেলা করার উপযুক্ত লোক হচ্ছেন শামীম ওসমান।
প্রকৃতই সেলিনা হায়াতের অর্থ ছিল না। তিনি সীমিতসংখ্যক পোস্টার ছাপাতে পেরেছেন অনেক মানুষের সহায়তা নিয়ে। এর একটি অংশ ছিঁড়েছে তার দলের লোকেরাই। শহরের কর্মীরা তাকেই মেয়র পদে চেয়েছে, কিন্তু শামীম ওসমানের ভয়ে তাদের বেশিরভাগ প্রকাশ্যে সক্রিয় হতে পারেনি। কিন্তু বিস্ময়করভাবে দ্রুতই সাধারণ মানুষ নির্ধারক হয়ে ওঠে। তারা চেয়েছে নারায়ণগঞ্জকে দুই যুগের বন্দিদশা থেকে মুক্ত করতে। তারা সংবাদপত্র ও টেলিভিশন সাংবাদিকদের কাছে নিজেদের অভিমত ব্যক্ত করেছে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে থাকার ঘোষণা দিয়েছে। নির্বাচন কমিশন সেনাবাহিনী মোতায়েনের অনুরোধ জানালেও সরকার তা না রাখায় এক সময়ে সন্দেহ সৃষ্টি হয় যে, শামীম ওসমানকেই হয়তো জয়ী করার চেষ্টা করা হবে। কিন্তু নির্বাচনের দিন সকালে দলে দলে নারী-পুরুষ ভোটকেন্দ্রে হাজির হতেই স্পষ্ট হয়ে যায়, সন্ত্রাস-জুলুমের বিরুদ্ধে সবাই দৃঢ়পণ।
নারায়ণগঞ্জ নির্বাচনের অভিজ্ঞতার কী মূল্যায়ন দেশের রাজনৈতিক দলগুলো করবে, সেটা স্পষ্ট নয়। এদিনকার অভিজ্ঞতা এ ক্ষেত্রে তিক্তই বলা চলে। তবে নারায়ণগঞ্জ থেকে একটি বার্তা স্পষ্ট যে, খারাপদের জনগণ প্রত্যাখ্যান করেছে। এদের গেলাতে গেলে তা বুমেরাং হয়ে যেতে পারে।
ভোটের কাজ করতে গিয়ে অনেক অভিজ্ঞতা হয়েছে। আমরা অনেক কেন্দ্রে পোলিং এজেন্ট দিতে পারিনি। আবার অনেক কেন্দ্রে আগেভাগে এজেন্টদের নাম প্রকাশ করা যায়নি। যাদের নাম শামীম ওসমানের শিবির জেনেছে তাদের ভয়ভীতি দেখানো হয়েছে। কিন্তু তারপরও দেখা গেছে, পোলিং এজেন্ট দিতে না পারা কেন্দ্রেও সেলিনা হায়াৎ আইভী জয়ী হয়েছেন। যেসব কেন্দ্র দখল হয়ে যাওয়ার শঙ্কা ছিল, সেখানেও তিনি বেশি ভোট পেয়েছেন। নির্বাচনী প্রচারের সময় তার প্রতি হিন্দু ধর্মাবলম্বী ভোটারদের সমর্থন ছিল লক্ষ্য করার মতো। পৌরসভায় দায়িত্ব পালনকালে তিনি রামকৃষ্ণ মিশনের জমি অবৈধ দখল থেকে মুক্ত করে দিয়েছেন। কয়েকটি মন্দিরের জমি ফিরে পেয়েছেন ভক্তরা। ভুয়া দলিল করেও পার পাওয়া যায়নি কেবল তার দৃঢ়তার কারণে।
কিছু এলাকার অধিবাসীরা নির্বাচনী প্রচারে না যেতে সেলিনা হায়াৎ আইভীকে অনুরোধ করে ফোন করতেন। তারা জানাতেন, আমাদের যা বলার বলব ব্যালট বাক্সে। আপনারা এলে আমাদের সমস্যা হবে। এমন কেন্দ্রও ছিল যেখানে নির্বাচনের আগে বিরানির প্যাকেট দিয়ে বড় জনসভা করার পরও শামীম ওসমান ভোট পেয়েছেন ৩০০, কিন্তু দোয়াত-কলমে ভোট পড়েছে আড়াই হাজার।
নারায়ণগঞ্জবাসীকে অভিনন্দন।

রফিউর রাবি্ব : সম্মিলিত নাগরিক পরিষদের সদস্য সচিব, নারায়ণগঞ্জ
 

No comments

Powered by Blogger.