ওয়ানডে স্ট্যাটাস-নবযুগে বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট by সঞ্জয় সাহা পিয়াল

মরা করব জয়...। আমরা করব জয় একদিন...'। যে গানটি চার বছর ধরে মন্ত্রের মতো গেয়ে যাচ্ছেন সালমারা, সে গানটির কথাগুলোও জীবনের সঙ্গে সত্য করে মিলিয়ে নিলেন। মায়ের বকুনি খেয়ে মাঠে যাওয়া, বাবার চোখ এড়িয়ে ক্রিকেট ব্যাট হাতে ধরা এবং ছেলেদের দলে বলেকয়ে খেলতে নামার দিনগুলো শেষ হয়েছে সালমাদের। গতকাল যুক্তরাষ্ট্রকে ৯ উইকেটে হারানো বাংলাদেশ নারী দলকে ওয়ানডে এবং টি২০ খেলার স্বীকৃতি দিয়েছে


আইসিসি। ২০১৬-পরবর্তী বিশ্বকাপ বাছাইয়ের আগ পর্যন্ত এ মহার্ঘ্য সম্মান মাথায় নিয়েই খেলতে নামবেন ঘরের মেয়েরা। প্রতি বছর অন্তত তিনটি ওয়ানডে এবং টি২০ খেলার সুযোগ পাবেন বাংলাদেশের মেয়েরা, যার প্রথমটিতেই শনিবার আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে খেলতে নামছেন সালমারা।
বিশ্বকাপ বাছাইয়ে পঞ্চম ও ষষ্ঠ স্থান নির্ধারণী এ ম্যাচটিকে ওয়ানডে স্ট্যাটাসের স্বীকৃতি দিচ্ছে আইসিসি।
গতকালের জয় দিয়েই শখের ক্রিকেট থেকে পেশাদার ক্রিকেটের নবযুগে পা রাখলেন তারা। তাই ২৪ নভেম্বর, ২০১১ তারিখটা আর সবার কাছে সাধারণ একটা বৃহস্পতিবার মনে হলেও সালমা-শুকতারাদের কাছে দিনটি ঐতিহাসিক। 'আমরা হয়তো আমাদের দেশকে বিশ্বকাপে নিয়ে যেতে পারিনি, তবে ওয়ানডে মর্যাদা পাইয়ে দিয়েছি। এখান থেকেই আরও একটা শুরু হলো। হয়তো একদিন এ দলে আমরা কেউ খেলব না। তখনও আমাদের কথা মনে করবে সবাই।' লাল-সবুজের পতাকা মাথায় উজ্জ্বল মুখের আড়ালেও সালমার চোখ ভিজে গিয়েছিল। 'আমরা কী পাইছি রে...?' 'ওয়ানডে স্ট্যাটাস...' চেনা উত্তরটাই বারবার শুনছিলেন সালমা। আজ থেকে কুড়ি বছর পর হয়তো প্রমীলা ক্রিকেটে আজকের অর্জনকে ধুসর মনে হতে পারে। তবে বাংলাদেশ ক্রিকেটে নারী জাগরণের পথিকৃৎ হয়ে থাকবেন কুবরা, শুকতারা, সালমা, জাহানারারা। ঠিক ১৯৯৭ সালে আকরাম খানরা দেশের জন্য যা অর্জন করেছিলেন, সালমারাও কাল সে স্বীকৃতি আদায় করলেন পরের প্রজন্মের মেয়েদের জন্য। গতকাল বিকেএসপি মাঠে তা বারবার বুঝিয়ে দিয়েছেন সালমারা। সকালে টস হেরে ফিল্ডিংয়ে নেমেই দাপটের সঙ্গে বোলিং করতে থাকেন পান্না-জাহানারারা। প্রতিপক্ষের প্রথম উইকেট ফেলে দিতে মাত্র ৪ ওভার সময় নিয়েছিল বাংলাদেশ। মিডিয়াম পেসার জাহানারার বলে ৪ রানে থাকা ওপেনার শাহরিয়া এলবিডবি্লউ হয়ে ফিরে যান প্যাভিলিয়নে। দ্বিতীয় উইকেট জুটিতেই ২৫ রান করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। ১৩ রানে থাকা শিবানীকে শুকতারা রিটার্ন ক্যাচ নেওয়ার পরই ওবামার দেশের মেয়েদের বাঁধ দেওয়ার চেষ্টা করে ওই জুটি ২৮ রান তোলে। তারপর কুবরার স্পিনেই মার্কিন মেয়েদের সব প্রতিরোধ ভেঙে যায়। ৬০ থেকে ৬৪ রানের মধ্যে ৬ উইকেট পড়ে যায়। বিকেএসপির ঘাসের গ্যালারিতে এলোমেলো হয়ে বসে থাকা দর্শকদের মধ্যে থেকে আওয়াজ আসে কুবরার হ্যাটট্রিকের আবেদন নিয়ে। ইনিংসের ২৮.২ এবং ২৮.৩ ওভারে দুটি উইকেট নিয়ে হ্যাটট্রিকের সম্ভাবনা তৈরি করেছিলেন কুবরা। পরের বলে উইকেট পাননি তিনি। তবে এদিন ১০ ওভারে ২০ রানে ৪ উইকেট নিয়ে গোটা আসরের সর্বোচ্চ উইকেট শিকারির সম্মান আদায় করে নেন কুবরা। বাংলাদেশি স্পিনের সামনে মার্কিনিদের কোনো মিসাইলই কাজে আসেনি। ৭৮ রানেই অলআউট হয়ে যায় যুক্তরাষ্ট্র।
তখনই বাংলাদেশ ড্রেসিং রুমের চারপাশে শুভাকাঙ্ক্ষীদের হাত মেলানো শুরু হয়ে যায়। ঢাকা থেকে ঘন ঘন ফোন আসতে থাকে। লাঞ্চের আগে টুকরো কয়েক ওভারেই ওপেনার আয়শা আকতারকে হারিয়ে ১২ রান তুলে বাংলাদেশ। পরে লাঞ্চ সেরে ১৮.৫ ওভারের মধ্যেই ৭৯ রান তুলে খেলা শেষ করে দেন শুকতারা আর ফারজানা। কভার দিয়ে বাউন্ডারি হাঁকিয়ে ঐতিহাসিক ম্যাচের জয়সূচক রানটি করেন শুকতারা। সীমানার কাছে অপেক্ষায় থাকা দলের সবাই পতাকা হাতে দৌড়ে গিয়ে ড্রেসিং রুমে বরণ করে আনেন শুকতারাদের। বিকেএসপির গেট সাধারণ দর্শকদের আটকে দেওয়ায় নারী ক্রিকেটের এ নবযুগে পা রাখার ক্ষণটিতে সাক্ষী হতে পারেননি অনেকে। তবে সালমাদের শুভেচ্ছা জানানোর শুভাকাঙ্ক্ষীর সংখ্যা নেহাৎ কম ছিল না মাঠে। প্রতিপক্ষ দলের কোচ রবিন সিংও শুভেচ্ছা জানাতে এসেছিলেন সালমাদের ড্রেসিং রুমের সামনে। 'বাংলাদেশ প্রস্তুত হয়েই নেমেছিল। তারা এ জয়ের সত্যিকারের দাবিদার।' বাংলাদেশের কোচ মমতা মাবেনও বিজয়ের এ দিনে সালমাদের শুভেচ্ছা জানিয়ে ভবিষ্যতের একটি রূপরেখার পরামর্শ দিয়েছেন। 'বাংলাদেশের ওয়ানডে স্ট্যাটাস পাওয়াটা প্রাপ্য ছিল। বিসিবিকে ধন্যবাদ, তারা মেয়েদের ক্রিকেটকে ছেলেদের মতোই গুরুত্ব দিয়েছে। এ দলটিকে এগিয়ে নিতে হলে বেশি বেশি ঘরোয়া লীগ আয়োজন করতে হবে। আমার বিশ্বাস, বাংলাদেশি মেয়েদের মধ্যে ক্রিকেট প্রতিভা আছে। তাদের এগিয়ে আসতে হবে। সালমারা একটা পথ দেখিয়েছে।'
একটি সম্মানের মুকুট মাথায় নিয়ে দলের সিনিয়র ক্রিকেটার পান্না ঘোষও জানিয়ে দিলেন ২০০৭ সাল থেকে গাওয়া সে গানটি এখনও পুরনো হয়নি_ 'আমরা করব জয় একদিন...। একটা অধ্যায় শেষ হয়েছে, আরেকটা অধ্যায় তো শুরু হলো। মর্যাদা পেয়েছি, এটা ধরে রাখতে হবে আমাদের...।'

No comments

Powered by Blogger.