অভিন্ন নদী এবং পানিপ্রবাহ by আখলাক হুসেইন খান

ম্প্রতি সুনামগঞ্জের 'হাওর অধিকার অভিযাত্রা', মৌলভীবাজারে 'হাওর কনভেনশন' ও কিশোরগঞ্জে 'হাওর উৎসব-২০১১' অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। দলীয় হলেও 'আমরা সীমান্তবাসী' এর ব্যানারে সিলেট থেকে জাফলং অভিমুখী লংমার্চে জনজোয়ারও ছিল উল্লেখযোগ্য। এসব কর্মসূচিতে বিপুলসংখ্যক সীমান্ত এবং হাওরবাসীর অংশগ্রহণ প্রমাণ করে, নদী ও হাওর রক্ষায় তারা সচেতন ও সোচ্চার হয়ে উঠেছে। তাদের দাবি ও স্লোগান_'নদী বাঁচলে হাওর বাঁচবে,


হাওর বাঁচলে কৃষি-কৃষক ও জলা বাঁচবে, খাদ্যনিরাপত্তা ও প্রাকৃতিক মৎস্য উৎপাদন নিশ্চিত হবে এবং পরিবেশ-প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষিত থাকবে।' নদী হলো হাওরের প্রাণ। আর এর পানিপ্রবাহের ওপর নির্ভর কৃষি-কৃষকের ভাগ্য ও প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণের উপায়। পানিসম্পদই হাওর ও কৃষি সভ্যতার শক্তি। এ পানিই এখন হাওরবাসীকে জীবন-মরণের মাঝে দাঁড় করিয়েছে। এ পরিস্থিতিতে পানির উৎস নদী নিয়ে এ অঞ্চলের মানুষের যত চিন্তাভাবনা ও উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। স্থানীয় পর্যায়ে নদী ও জলমহালে এবং উজানে উৎস নদীতে বাঁধ আগ্রাসনের কবলে নদী ভরাটসহ খরা-বন্যা-জলাবদ্ধতা অনিবার্য হয়ে উঠেছে। বোরো চাষাবাদ মৌসুমে পানির খবর জানার জন্য কৃষকরা চেয়ে থাকে উজানের অভিন্ন নদী আর আকাশের দিকে। উত্তর ও পূর্ব আকাশের মেঘ দেখেই তারা আন্দাজ করে খরা ও বন্যার পদধ্বনি এবং আগমন বার্তা।
ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে ৫৪টি অভিন্ন নদীর মধ্যে উত্তর-পূর্বাঞ্চলে রয়েছে ২২টি। এই ২২টি নদীতেই ভারত একতরফাভাবে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে বলে বিভিন্ন সূত্রের মাধ্যমে খবর রয়েছে। কিভাবে কতুটুক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে? কোন কোন নদীতে বাঁধ গড়ে তুলেছে এবং কী পরিমাণ পানি প্রত্যাহার করছে? এসব তথ্যের ব্যাপারে এ অঞ্চলের মানুষ একেবারেই অন্ধকারে। বিভিন্ন মিডিয়ার মাধ্যমে বিশেষজ্ঞদের ভাষ্য থেকে জানা যায়, ভারতের পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলো ১৮টি নদীতে ইতিমধ্যে বাঁধ গড়ে তুলেছে। সুরমা-কুশিয়ারার উৎস নদী বরাকে টিপাই ড্যাম হচ্ছে ১৯তম এবং সিলেটের সারি নদীর উৎসমুখে মেঘালয়ের মাণ্ডু নদীতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য নির্মাণাধীন ড্যাম হচ্ছে ২০তম। অত্রাঞ্চলের অনেকেই বলেন, টিপাই ও মাণ্ডু নিয়ে মিডিয়া সোচ্চার হওয়ায় ভালো-মন্দ জানা যাচ্ছে। কিন্তু বাকি নদীগুলোর বাঁধ ও পানি প্রত্যাহারের খবর অজানাই রয়ে গেছে। মেঘালয়, আসাম, ত্রিপুরা, মণিপুর ও মিজোরাম প্রদেশের পাহাড়ি ঝরনা, খাল-নালার জলবিভাজিকর থেকে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ২২টি অভিন্ন নদীর উৎপত্তি। ওইসব নদীসহ হাওরাঞ্চলের শাখা ও উপনদী রয়েছে প্রায় ৮৩টি। এর পানিপ্রবাহের ওপরই নির্ভর কৃষি ও প্রাকৃতিক মৎস্য উৎপাদন। এ ছাড়া ১০টি নদীতে খনিজ সম্পদ পাথর ও বালি কোয়ারির সৃষ্টি সীমান্ত জেলা সিলেট, হবিগঞ্জ ও সুনামগঞ্জে। সুরমা, কুশিয়ারা, জাদুকাটা, সোমেশ্বরী, মনু, ধলাই, পিয়াইন, খোয়াই ও সোনাই নদীসহ সব কয়টি অভিন্ন নদীই বিপন্ন। ভাটির দেশের চিন্তা না করে বাঁধ দিয়ে একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহার করে নেওয়ায় বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ওই নদীগুলো পানিপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হওয়ায় পলি সঞ্চারিত হয়ে ভরাট হয়ে গেছে। শুকনো মৌসুমের খরায় কয়েকটি নদী ছাড়া সব কয়টিতেই ধু-ধু বালি ওড়ে। ভেঙে পড়েছে সেচব্যবস্থা এবং আবাদ হওয়া আট লক্ষাধিক হেক্টর বোরো জমির প্রায় ৪০-৪৫ ভাগ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
বর্ষায় ২২ হাজার ২২ বর্গকিলোমিটার এলাকায় পানির বিস্তৃতি ঘটত, কিন্তু বাঁধের প্রতিবন্ধকতায় দুই দশক ধরে পানির বিস্তার হাওরাঞ্চলের চার-পাঁচ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকায় এসে ঠেকেছে এবং উচ্চতায় ১০-১২ ফুটের স্থলে পাঁচ-ছয় ফুট ও অপেক্ষাকৃত উঁচু হাওরে পানি উঠছেই না। এতে বোনা আমনের জমি ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছে। এই জলি ধান পানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ১০-১২ ফুট লম্বা হয়ে পানির ওপরে ভেসে 'বোড়' বেঁধে অসংখ্য কুশি গজিয়ে ধানছড়া দেয়। কেদারপ্রতি চার-পাঁচ মণ ধান উৎপাদন হয়। পানি না হওয়ায় কুশি গজাতে পারছে না। ফলে কেদারে (২৮ শতক) এক-দুই মণ ধান উৎপাদন হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে স্বল্প সময়ে প্রচুর বৃষ্টিপাত ও টানা বর্ষণ হলে উজানে বন্যা দেখা দিলে ভারত সব কয়টি স্লুইসগেট খুলে পানি ছেড়ে দেয় এবং কোনো এলাকা থেকে কত কিউসেক পানি ছাড়ে সরকারিভাবে জনগণকে তা অবহিত করে, যা সে দেশের মিডিয়ায়ও ফলাও করে প্রচার করা হয়। আর এদিকে ভাটিতে বিশেষ করে হাওর অঞ্চলে দেখা দেয় বন্যা। বন্যার পানির প্রথম ধাক্কায়ই আবাদি পাঁচ লক্ষাধিক হেক্টর বোনা, রোপা আমন ও আউশ জমি তলিয়ে যায়। ভাঙনের কবলে পড়ে হাওরে দ্বীপের মতো ভেসে থাকা গ্রামগুলো। এতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। এ ছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বর্ষাকালীন খরা দেখা দেয়। এতে তাপমাত্রা ২৯-৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত ওঠে। জলায় পানি কম থাকায় অধিক তাপমাত্রায় পানিতে অঙ্েিজন কমে যায়। এতে মাছের প্রজনন ক্ষমতা কমে যায়। প্রজননক্ষম মাছ অল্পতে ক্লান্ত হয়ে পড়ে। ডিমের খোসা পাতলা হয়ে শরীরের ডিম গলে শরীরে মিশে যায় বলে বিশেষজ্ঞদের ব্যাখ্যা থেকে জানা যায়। গেল বছর বর্ষায় লাগাতার খরা ও অধিক তাপমাত্রায় হাওরে মাছের প্রজনন প্রায় ৫০-৬০ শতাংশ কমে যায়। ফলে এ বছর হাওরে প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদিত মাছ খুবই কম ধরা পড়ছে। জেলেদের ভাষ্যমতে, অন্যান্য বছরের তুলনায় অর্ধেক মাছ ধরা পড়ছে। ফি বছরও হাওরে স্বাভাবিক বর্ষার পানির চেয়ে অর্ধেকের কিছু বেশি পানি হয়েছে। ফলে যা হওয়ার তা-ই হয়েছে। কৃষি, মাছ ও জলজ উদ্ভিদ চরম ক্ষতির মুখে পড়েছে।
তথ্য জানার দাবির প্রতি আমরাও একমত। নদী-হাওর ও পানিভিত্তিক জীবন-জীবিকার প্রয়োজনেই পানিপ্রবাহের তথ্য জানা অত্যাবশ্যকীয়। পানি সংরক্ষণ ও ব্যবহারে এখনো কৃষকদের নিজস্ব উদ্ভাবিত কৌশল বেশ কার্যকর। এ ছাড়া খরা ও বন্যা মোকাবিলার পূর্বপ্রস্তুতি তারা দলবদ্ধভাবে স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে নিয়ে থাকে। বৃষ্টিপাতের মাত্রা ও উজানের পানিপ্রবাহের কোনো তথ্য তাদের কাছে না থাকায় ফসল রক্ষায় এক অনিশ্চয়তার মধ্যে প্রতিটি হাওরে হাজার হাজার কৃষককে দিন ও রাতের পর রাত অবস্থান করে বাঁধ পাহারা দিতে হয়। তার পরও পানির প্রবল ধাক্কার মুখে বাঁধ ভেঙে তাদের চোখের সামনে ফসলের মাঠ ভেসে যায়। অবাধ তথ্যপ্রবাহের যুগে এবং অধুনা প্রণীত তথ্য অধিকার আইনে তথ্য জানা বা জানানো নিশ্চিত হয়েছে যেহেতু, আমরাও আশা করব, নিরক্ষর ও সাধারণ মানুষের জন্য জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো সরকার তথ্যভিত্তিক করে ফেলবে এবং অভিন্ন নদীর হাল অবস্থা ও এর পানিপ্রবাহের প্রতিবন্ধকতাসহ সব ধরনের তথ্য প্রদানে বিশেষ ব্যবস্থার মাধ্যমে কৃষক তথা উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মানুষকে অবহিত রেখে তাদের তথ্য জানার অধিকার নিশ্চিত করবে। শোনা যাচ্ছে, বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে অভিন্ন নদীর পানি ব্যবহারে ভাটির দেশের অধিকার রক্ষায় বাংলাদেশ, ভারত, ভুটান ও নেপাল যৌথভাবে একটি মহাপরিকল্পনা নিতে যাচ্ছে। পানির ন্যায্য হিস্যাবঞ্চিত উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মৃত ও অর্ধমৃত নদীর পারে ধ্বংসের প্রান্তে দাঁড়ানো হাওরবাসী এই মহাপরিকল্পনার দিকে তাকিয়ে আছে এবং এর ওপরই নির্ভর করবে হাওর ও নদ-নদীর বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ।
লেখক : হাওর গবেষক

No comments

Powered by Blogger.