ছায়ানটের সুবর্ণজয়ন্তী by কামাল লোহানী

ছায়ানটকে অভিনন্দন সুবর্ণজয়ন্তীতে। আজ সত্যিই এক আনন্দ-উল্লাসের দিন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে পূর্ববঙ্গের সাহিত্য-সংস্কৃতি থেকে মুছে ফেলার জন্য স্বৈরাচারী স্বেচ্ছাচার যে চক্রান্ত এঁটেছিল, তারই বিরুদ্ধে প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলনের এক মূর্ত প্রতীক হিসেবে এ সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কবিগুরুর জন্মশতবর্ষ পালনে সামরিক শাসনের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে সেদিন আমরা জোটবদ্ধ হয়েছিলাম তার মধ্যে রবীন্দ্র শতবর্ষ উদযাপন পর্ষদ (ঢাকা পূর্ব) নামে


সংগঠনটি গড়ে উঠেছিল হেমন্তের এক সকালে, ওইটিই 'ছায়ানট' হয়ে অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে স্বদেশি সংস্কৃতি লালন করতে এগিয়ে চলে। সুদীর্ঘ পঞ্চাশ বছরে এই সংগঠন জাতীয় প্রতিষ্ঠানের রূপ ধারণ করেছে। সংস্কৃতি অঙ্গনে আজ 'ছায়ানট' এক বিশুদ্ধতার প্রতীক এবং বঙ্গসংস্কৃতির উপাদানগুলোকে অবলম্বন করে দেশীয় সীমানার বাইরেও যশস্বিতার সুনাম অর্জন করেছে।
ছায়ানটের প্রথম কমিটির সভানেত্রী ছিলেন শুভ্র-সুন্দরের প্রতীক বেগম সুফিয়া কামাল এবং সম্পাদক ফরিদা হাসান। এই কমিটিতে আরও ছিলেন তারা হলেন মোখলেসুর রহমান (সিধু ভাই), সায়েনা এম আহমদ, মিসেস মোশাররফ উদ্দিন, হোসনে আরা (মাক্ষীবু), শামসুন নাহার রহমান (রোজবু), সন্জীদা খাতুন, ওয়াহিদুল হক, মীজানুর রহমান ছানা, সাইফউদ্দিন মানিক। এছাড়া সংগঠনের বাইরে থেকে শিল্পী ইমদাদ হোসেন, দেবদাস চক্রবর্তী, নিতুন কুণ্ডু, মোহাঃ ইদরিস ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন।
রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে ১৯৬১ সালে ঢাকা শহরে যে তিনটি কমিটি হয়েছিল তার মধ্যে সাংবাদিকদের নিয়ে কমিটিতে আমি ছিলাম একজন সংগঠক। '৬২-তে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে ছাত্র আন্দোলনে গ্রেফতার হয়ে জেল থেকে ছাড়া পেয়েছিলাম সাড়ে তিন মাস পরে। ওয়াহিদুল ভাইয়ের কাছে প্রেসক্লাবে একদিন জানতে চাইলাম, 'ছয়ানট' কেমন চলছে। জবাবে বললেন, এখন তেমন কার্যক্রম নেই। তুমি যদি আস তবে আবার চালু করতে পারি। তখন আমি 'ছায়ানট'-এর সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করি। ছায়ানট সঙ্গীত বিদ্যানিকেতন প্রতিষ্ঠা হয়েছিল পরের বছরই। যে স্কুল করতে বাংলা একাডেমী, ইংলিশ প্রিপারেটরি স্কুল, ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুল_ নানা জায়গায় যাযাবরের মতো ঘুরেছে, বিদ্যানিকেতন নিয়ে আজ সেই ছায়ানট এক বিশাল ও বহুমুখী ভবনের উত্তরাধিকার লাভ করেছে কেবলই মানুষের সাহায্য-সহযোগিতা এবং ভালোবাসার কারণে। ছায়ানট এই ৫০ বছরের বিশুদ্ধ পথ চলতে চলতে যে সব প্রগতিমনস্ক এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের সংগ্রাম করেছে, তার মধ্যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাবিরোধী প্রতিরোধ মিছিল, সহায়ক শিবির, উদ্ধার তৎপরতা চালিয়েছিল, আজ পর্যন্ত কোনো সাংস্কৃতিক সংগঠন বা প্রতিষ্ঠান করতে পারেনি। একই চৈতন্যে শাণিত সংগঠন হিসেবে তাই পহেলা বৈশাখ বর্ষবরণ অনুষ্ঠান শুরু করেছিল ইংলিশ প্রিপারেটরি স্কুল মাঠে। এই অনুষ্ঠানটি কয়েক বছর পরই চলে আসে রমনার বটমূলে। কী যে বিশাল ও গুরুত্বপূর্ণ আয়োজন এই বর্ষবরণ, তা প্রগতিশীল সংস্কৃতি ও রুচিশীল মানুষ মাত্রই উপলব্ধি করেন। আজ 'পহেলা বৈশাখ' নাগরিক জীবনেও 'জাতীয় উৎসব'। ছায়ানটই প্রথম শিলাইদহে গিয়ে দু'দিনব্যাপী অনুষ্ঠান আয়োজন করেছিল রবীন্দ্র জয়ন্তী পালনে, আইয়ুবের সামরিক রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে। কুমারখালী থেকে লঞ্চ ভাড়া করে কাছারিবাড়ী প্রাঙ্গণে গিয়েছিলাম সন্জীদা আপার নেতৃত্ব্বে গান গাইতে গাইতে। সেই শোভাযাত্রায় অগ্রণী ছিলেন বেগম সুফিয়া কামালসহ বহু খ্যাতনামা শিল্পী সাহিত্যিক শিক্ষাবিদ সাংবাদিক। সে এক অসাধারণ অনুভূতি! আবার ১৯৬৩ সালে প্রবল ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে বিধ্বস্ত দক্ষিণ বাংলার সমুদ্রোপকূল। ছায়ানট বেরিয়েছিল ঢাকার রাজপথে 'ভিক্ষা দাও গো পুরবাসী' গান নিয়ে। বাংলার সংস্কৃতি ক্ষেত্রে 'ছায়ানট' যেমন মাইলফলক, তেমনি এই প্রতিষ্ঠানের কাজের মধ্যে অনেকগুলো মাইলফলক চিহ্নিত হয়ে আছে। এর মধ্যে আইয়ুব আমলে ১৯৬৭ সালে আমাদের জীবন ও সংস্কৃতি থেকে রবীন্দ্রনাথকে মুছে ফেলার চক্রান্তের বিরুদ্ধে যারা গর্জে উঠেছিল ছয়ানট তাদের অন্যতম। ছায়ানটে ১৯৬২ থেকে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত থাকার পর 'ক্রান্তি শিল্পীগোষ্ঠী' নাম একটি রাজনৈতিক আদর্শে বিশ্বাসী সংগঠন গড়ে তুলি। পরে সবাই মিলে প্রতিরোধ সংগ্রাম গড়ে তুলি এবং কবিগুরুকে একান্তভাবে আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রধান পুরুষ বলে ধারণ করেছিলাম। ছায়ানট আমাদের সেই যুদ্ধেরও সহযোদ্ধা।

কামাল লোহানী : ছায়ানটের সাবেক সম্পাদক

No comments

Powered by Blogger.