'কবিতা'র জন্য :বুদ্ধদেব বসুর সম্পাদকীয়

বীন্দ্রপরবর্তী তিরিশি আধুনিক কবিতার অন্যতম প্রধান কবি বুদ্ধদেব বসু। 'প্রগতি' থেকে 'কবিতা'_ অতি তরুণ বয়স থেকে প্রৌঢ়ত্বের দ্বারপ্রান্ত পর্যন্ত তিনি নিষ্ঠার সঙ্গে সম্পাদনা করেছেন কবিতাপত্র। তার রচিত সম্পাদকীয় নিছক গদ্যমাত্র নয়; এতে ধরা আছে অবিনশ্বর এই কবির অনুভূতিমালাও...


আশ্বিন ১৩৫৯
বর্ষ ১৭, সংখ্যা ১
সম্পাদকীয়
আমাদের তরুণ বয়সে, যখন রবিদ্রোহিতার প্রয়োজনীয় ধাপটি আমরা পার হচ্ছিলাম, তখন যে-দু-জন কবিতে আমরা তখনকার মতো গত্যন্তর খুঁজে পেয়েছিলাম, তাঁদের একজন যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত, আর অন্যজন 'বিস্মরণী'র মোহিতলাল। এর আগে অবশ্য 'স্বপন-পসারী' ছিলো, কিন্তু, নামেই প্রকাশ, সত্যেন্দ্র দত্তে আন্না-ধ'রে-যাওয়া স্ফুটমান কবিদের পক্ষে ও-বই কোনো কাজে লাগেনি, 'বিস্মরণী'তেই নতুন কবি বেরিয়ে এলেন। আমরা, 'কল্লোলে'র অর্বাচীন দল, সেই কড়া পাকের জমকালো কবিতায় মুগ্ধ হয়েছিলুম, মোহিতলালকে বরণ করেছিলুম তান্ত্রিক ব'লে, নির্ভীক দেহসাধক ব'লে। 'দেহে তোর প্রাণ আছে?_ এই উদাত্ত প্রশ্নের উত্তরে আমরা প্রবলভাবে জবাব দিয়েছিলুম_ 'হ্যাঁ!' রাধা ও ম্যাডোনাকে একাকার দেখেছিলুম তাঁর সঙ্গে-সঙ্গে, মুদিতাক্ষী যশোধরা আর মদিরাক্ষী বসন্তসেনাকে সমান ভালোবেসেছিলুম। তাঁর এ-সব কবিতার সুরের মিল ছিলো 'কল্লোল', 'কালি কলমে'র সঙ্গে_ যে দুটি পত্রিকার নিয়মিত এবং সম্মানিত লেখক ছিলেন তিনি_ অথচ তিনি 'কল্লোলে'র সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না, এমনকি সেই বাঁধন ছেঁড়া আন্দোলনের সমর্থকও ছিলেন না। তাঁর দুর্ভাগ্যবশত, তিনি 'প্রবাসী'র পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছিলেন, এবং সেই বনেদি মঞ্চের উচ্চাসন থেকে যে রকমভাবে সাহিত্যের যাচাই করতে লাগলেন তাতে তাঁর অভ্যাসের সঙ্গে উপদেশের বিস্তর গরমিল ধরা পড়লো। মনে আছে একবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পঠিত একটি প্রবন্ধে তরুণতরদের সাহিত্যিক ক্রিয়াকলাপের প্রতি ইঙ্গিত ক'রে তিনি এই সম্পূর্ণ অসাহিত্যিক ও অবান্তর মন্তব্য করেছিলেন যে 'কোনো-কোনো সাপের রং-ও সবুজ।' আমরা, তাঁর ভক্তের দল, তখন এতে অবাক হয়েছিলুম, কিন্তু ক্রমশ যখন সত্যসুন্দর দাস স্বাক্ষরিত তাঁর সাহিত্যবিষয়ক প্রবন্ধাবলী বেরোতে লাগলো তখন অন্য এক মোহিতলালকে দেখতে পেয়ে চমক ভাঙলো আমাদের। আজকের দিনে এ-কথাটা সকলেই জানেন যে মোহিতলালের সমালোচনা মুক্তিবিরোধী, অতীতের আমেজে ভরা, বাংলার উনিশ শতকের জের টেনে চলাই তার লক্ষ্য_ সে-সমালোচনার সমর্থক হ'তে পারেন শুধু তাঁরাই, যাঁরা পশ্চাদপসরণের পক্ষপাতী। তার উপর মোহিতলাল এ-কথা বিশ্বাস করতে সীমাহীনরূপে অক্ষম ছিলেন যে পদ্মতীরপ্রসূত কোনো ব্যক্তির হাত দিয়ে বাংলা ভাষায় পাঠযোগ্য কোনো রচনা বেরোতে পারে_ এ অচিকিৎস্য প্রাদেশিকতার ফলেও তাঁর সমালোচনার ক্ষতি হয়েছে। কিন্তু তবু এ কথা সত্য যে তাঁর সাহিত্যপ্রেমে ভেজাল ছিলো না; এবং তিনি যা বিশ্বাস করতেন সেইটেকে খুব জোরের সঙ্গে প্রকাশ করার গুণটিও তাঁর ছিলো। আর তাঁর সমালোচনার মূল্য বিষয়ে আমরা যে যতই সন্দেহ প্রকাশ করি না, কাব্যের ক্ষেত্রে তাঁর স্থায়িত্ব অবধারিত; তাঁর জীবৎকালে, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত থেকে গোলাম কুদ্দুস পর্যন্ত, অনেক কবির উপরেই তিনি প্রভাব বিস্তার করেছিলেন; তাঁর দৃঢ়গঠিত যত্ন-বিন্যস্ত কবিতাবলীর উত্তরকালের হাতেও উপেক্ষিত হবার আশঙ্কা নেই। সংস্কৃত শব্দের ধ্বনিকল্লোলে, স্তবকসজ্জায়, বড়ো তালের দীর্ঘায়িত পংক্তিরচনায়, কাব্যের একটি পরিচ্ছন্ন গম্ভীর রূপ তিনি রেখে গেছেন, এবং 'মৃত্যু ও নচিকেতা'র মতো উৎকৃষ্ট মাইকেলি অমিত্রাক্ষর মাইকেলের পর বাংলা ভাষায় আর-কেউ লেখেননি। তাঁর কাব্যের একটি সংকলনগ্রন্থ এ-সময়ে প্রকাশিত হ'লে ভালো হয়, তাহ'লে বর্তমান যুগের পাঠকদের সঙ্গে পরিচয়ের পথ প্রশস্ত হ'তে পারে।
* * *
কবিতা নিয়ে সম্প্রতি যে-অভিনব আন্দোলন চলেছে সেটি আলোচনার অযোগ্য নয়। শনিবারের বিকেলে, আপিশ-ছুটির ভিড়ের মধ্যে, কলকাতার ফুটপাতে হঠাৎ রোল উঠলো, 'কবিতা পড়ূন! কবিতা পড়ূন! কবিতা না-পড়লে বাঙালি বাঁচবে না।'_ আর অমনি কিছু ভিড় জ'মে উঠলো চারদিকে, আর একদল যুবক কবিতা আবৃত্তি ক'রে শোনাতে লাগলেন_ যদি-বা তাতে হঠাৎ কারো মনের কোনো বন্ধ জানলা খুলে যায়। এই রকম দুটি পথ-চলতি সভার আমরা খবর পেয়েছি এ-পর্যন্ত, একটি এসপ্লানেড, অন্যটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে, এবং ভবিষ্যতে শহরের অন্যান্য অঞ্চলেও এর পুনরাবৃত্তি হবার সম্ভাবনা আছে ব'লে শুনেছি। এ-নিয়ে কাগজে-কাগজে কিছু ঠাট্টা বেরিয়েছে,_ সংবাদপত্রাদির কাছে তা ছাড়া কিছু আশা করাই যায় না; আর যাঁরা কবিতা ভালোবাসেন তাঁরা কেউ কেউ আপত্তি করেছেন এই ব'লে যে এতে কবিতার জাত নামিয়ে দেয়া হ'লো। আমি জানি না কবিতার জাত কিসে যায়, ফুটপাতে নেমে এলে, না কি দোতলা-তেতলা স্কুল-কলেজে ক্লাশ-পড়ানো পাশ-করানো যন্ত্রের ছিবড়ে হ'য়ে বেরিয়ে এলে; অন্তত, দেশের মধ্যে যখন তরুণ রক্তের উৎসাহ অধিকাংশই ধাবিত হচ্ছে সিনেমা এবং 'লারেলাপ্পা'-প্রমুখ শুঁড়িখানার উপযোগী সংগীতের দিকে, তখন একদল যুবকের এই কাব্যোন্মাদনার খবরে উৎফুল্ল হবো না এত বড়ো আভিজাত্যবিলাসী আমি নই। তাছাড়া এ-রকম আন্দোলন যে কোনো কাজেই লাগবে না তা-ই কী ক'রে বলা যায়; কবিতা নামক একটা পদার্থের যে অস্তিত্ব আছে সে-বিষয়ে যদি প্রকৃতিস্থ এবং পদস্থ ভদ্রলোকেরা যৎকিঞ্চিৎ সচেতন হ'য়ে ওঠেন, তা-ই বা মন্দ লাভ কী। অবশ্য এই আন্দোলন চালিয়ে যেতে হ'লে শেষ পর্যন্ত মাইক্রোফোনে পেঁৗছতে হবে; কবিতার সঙ্গে আধুনিক মানুষের প্রধান ব্যবধান সৃষ্টি করেছে মুদ্রাযন্ত্র; কবিতা কানে শুনতে হয়, এবং বর্তমানে কানে শোনাবার প্রকৃষ্ট উপায় হচ্ছে রেডিও আর গ্রামোফোনের রেকর্ড। আমি নিজে রেডিও-যন্ত্রটাকে একেবারেই ভালোবাসি না_ ওর ফলে গান গাওয়া আর গান শোনায় কোনো স্বতঃস্ফূর্তি আর নেই_ কিন্তু যে-নীতি অনুসারে রোমে গেলে রোমান বলতে হয়, কি মোগলের হাতে পড়লে খানা না-খেয়ে উপায় থাকে না, সেই নীতি অনুসারেই রেডিওটাকে বর্জন না-করে তাকে ব্যবহার করাই বিধেয়। কলকাতার রেডিওতে সাহিত্যের একটা বিভাগ আছে ব'লে শুনেছি, সেখানে নাকি পদ্য-পাঠও হ'য়ে থাকে মাঝে-মাঝে_ সেটা কেন জ্যান্ত কবিতার বাহন হবে না এই মর্মে একটা দাবি উত্থাপন করা যেতে পারে। এবং_ আমরা যখন সকল বিষয়েই পশ্চিমী দেশের নকল করছি [স্বাধীনতার পর এটা আরো বেড়ে গেছে], এমনকি বাঙালি মহিলারাও শাড়িটাকে ঘাঘরার কায়দায় কামুফ্লাজ করছেন, তখন ইংলন্ড-আমেরিকার অনুকরণে বাংলা কবিতারই বা রেকর্ড হবে না কেন?
* * *
ইতিমধ্যে কবিতার পত্রিকা, বা সংকলনও নতুন বেরিয়েছে। একটি নয়, দুটি নয়, পর-পর একেবারে তিনটি। 'শতভিষা', 'কবিতাপত্র', তারপর 'সব শেষের কবিতা'। [এদিকে 'একক' কিছুদিন বন্ধ থাকার পরে আবার বেরোচ্ছে ব'লে শোনা গেলো।] নতুন পত্রিকা বা পুস্তিকা তিনটি আকারে ক্ষুদ্র, কিন্তু পাতা উল্টিয়ে অনেক নতুন নাম চোখে পড়লো, কাব্যের ক্ষেত্রে উদ্যমীদের সংখ্যা মনে হচ্ছে দ্রুত বিবর্ধমান। ভালোই; এঁদের মধ্যে ক-জন বয়ঃসন্ধির ফাঁড়া কেটে গেলে আর কবিতা লিখবেন জানি না, কিন্তু আশা করা যায় এঁরা সকলেই কবিতার অনুরাগী থাকবেন_ বিষয়টাকে ভালোবাসতে শেখারও একটা উপায় হাতে-কলমে কিছু চর্চা করা। অর্থাৎ বাংলা কবিতার পাঠকের সংখ্যা যে বাড়ছে তার একটি নিশ্চিত প্রমাণ এতে পাওয়া গেলো। 'সব শেষের কবিতা' নামটি খুব কু-নির্বাচিত হয়েছে_ কবিতার কি কোনো শেষ আছে? আর 'কবিতা পত্র' নামটিতে আপত্তি করি অন্য কারণে, 'কবিতা' আর 'কবিতা পত্রে' তফাৎ খুব স্পষ্ট নয় ব'লে। ওই নামের পরিবর্তন প্রয়োজন।
* * *
'কবিতা'র এই আশ্বিন সংখ্যা চৈত্র মাসে বেরোলো। চৈত্র সংখ্যার আর সময় হবে না; এর পরেই আষাঢ় সংখ্যা প্রকাশিত হবে_ আশা করছি যথাসময়েই এই আষাঢ় সংখ্যাই সপ্তদশ বছরের প্রথম সংখ্যা, এবং এরপর থেকে পত্রিকা প্রকাশ যাতে নিয়মিত হয়, সে উদ্দেশ্যে বদ্ধপরিকর হ'য়েই আমরা নতুন বছর আরম্ভ করছি। এই সংকল্পসাধনের জন্য আমাদের গ্রাহক এবং পাঠকদের সহযোগিতা আমরা প্রার্থনা করছি। গ্রাহকদের কাছে বিশেষভাবে অনুরোধ জানাই তাঁরা যেন ভিপি-র অপেক্ষায় না থেকে মনি অর্ডারের চাঁদা পাঠিয়ে দেন। যাঁরা স্টলে পত্রিকা কেনেন তাঁদের আমন্ত্রণ জানাই গ্রাহক হ'তে, এবং 'কবিতা'র অনুরাগী পাঠক যেখানে যাঁরা আছেন তাঁদের সকলের কাছে আমাদের নিবেদন এই যে তাঁরা যেন বন্ধুমহলে দু-একজন ক'রে গ্রাহক সংগ্রহের চেষ্টা করেন। সাহিত্য পত্রিকার ঘোর দুর্দিন এখন, ইংলন্ডে 'হরাইজন' চললো না, একমাত্র কবিতা-পত্রিকা 'পোইট্রি লন্ডন'ও সেদিন বন্ধ হ'লো। ইংরেজির মতো প্রবল ভাষায় যখন এই দশা, তখন_ ভাবতে আনন্দই হয়_ যে বাংলা ভাষায় সাহিত্যপত্রের ধারাটি এখনো বন্ধ হয়নি। অন্তত, 'কবিতা'র মতো পত্রিকা যে ষোলো বছর ধ'রে চলতে পারলো, একে বাঙালির দুর্মর সাহিত্যপ্রীতিরই প্রমাণ ছাড়া আর কী বলা যায়। এই প্রীতির উপর নির্ভর ক'রেই আমরা নতুন বছরের যাত্রারম্ভ করলাম। া

No comments

Powered by Blogger.