চৈতন্যের মুক্ত বাতায়ন-বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে ভারতের ভূমিকা by যতীন সরকার

পাকিস্তানের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদপুষ্ট হয়েই যে বাংলাদেশের প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীগুলো দেশটিতে নিজেদের আধিপত্য বিস্তারে ধীরে ধীরে সক্ষম হয়ে ওঠে_এ বিষয়টি একান্তই স্পষ্ট। আবার মনে না রাখাই চলবে না যে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের পৃষ্ঠপোষকতাই ছিল পাকিস্তানের শক্তির মূল উৎস। এ রকম পৃষ্ঠপোষকতা না পেলে তৎকালীন সোভিয়েত নেতৃত্বাধীন সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর দৃঢ় সমর্থনপ্রাপ্ত ভারতের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর বিন্দুমাত্র সাহসও পাকিস্তান পেত না।


অন্যদিকে আমাদের মুক্তিসংগ্রামে ভারতের সর্বাত্মক সহযোগিতার কথা তো কোনোমতেই অস্বীকার করা চলে না। তবু এই সহযোগিতার বিষয়টিকে নিতান্ত সরলভাবে দেখা মোটেই সংগত নয়। এ বিষয়ে কতক প্রশ্নের মুখোমুখি আমাদের দাঁড়াতেই হবে; যেমন_ভারত আমাদের সংগ্রামে কেন সহযোগিতা করেছে? ভারতের সব মানুষ কি একই শ্রেণী বা গোষ্ঠীর অন্তর্গত? তা যদি না হয়, তাহলে বিভিন্ন শ্রেণী-গোষ্ঠী বা অঞ্চলের সব মানুষই আমাদের সমর্থন করেছে কি? যারা সমর্থন করেছে বা যারা করেনি, তাদের সবার সমর্থন বা অসমর্থনের প্রকৃতি কি একই রকমের ছিল?
অন্তত এ কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর অন্বেষণ না করলেই নয়। এ রকম অন্বেষণের জন্য আমাদের একান্ত বস্তুনিষ্ঠ ও মোহমুক্ত হতে হবে। কোনোমতেই বিষয়টির প্রতি একপেশে দৃষ্টিতে তাকালে চলবে না। একপেশে দৃষ্টিতে তাকাই বলেই আমরা কেউ কেউ ভারতের প্রতি প্রেমে একেবারে গদগদ হয়ে পড়ি এবং কেউ কেউ হয়ে পড়ি অন্ধ ভারতবিরোধী। এ রকম একদেশদর্শী প্রেম বা বিরোধিতা অবশ্যই পরিতাজ্য।
প্রথমেই বলে নেওয়া প্রয়োজন যে ভারত নামক একটি বিশাল রাষ্ট্রের মানুষগুলো বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠী ও শ্রেণীতে বিভক্ত। এদের সবার দৃষ্টিভঙ্গি ও স্বার্থচেতনা কোনোমতেই অভিন্ন হতে পারে না। মোটা দাগে বিচার করলে বলতে হয়, শাসক ও শাসিতর স্বার্থ স্বভাবতই পরস্পরবিরোধী। তবে প্রতিবেশী বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের প্রতি ভারতের বিভিন্ন গোষ্ঠীর চেতনাও ছিল নানামুখী। সাম্প্রদায়িকতাবাদীদের চেতনা যে রকম ছিল, অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন মানুষের নিশ্চয়ই সে রকম ছিল না। তাই তাদের সমর্থনের প্রকৃতিতেও ছিল ভিন্নতা।
ভারতের বামপন্থীদের কেউই সম্ভবত আমাদের মুক্তিসংগ্রামের প্রত্যক্ষ বিরোধিতা করেনি। তবে উগ্র বামদের কোনো কোনো গোষ্ঠীতে নেতিবাচকতা ছিল খুবই প্রবল। আমাদের মুক্তিসংগ্রামীদের ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর প্রতি সমর্থনকে মোটেই ভালো চোখে দেখত না ওরা। ওদের স্লোগান ছিল_'ইয়াহিয়া-ইন্দিরা এক হ্যায়, ভুলো মৎ ভুলো মৎ।' ওই স্লোগানের খুবই জুতসই জবাব দিয়েছিলেন ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিআই) অন্যতম নেতা বিশ্বনাথ মুখোপাধ্যায়। তিনি বলেছিলেন, 'এ রকম কথা তো তোমরা ইন্দিরার নেতৃত্বাধীন ভারতে বসে বলছ। যাও না পাকিস্তানে, সেখানে গিয়ে এমন কথা বললেই টের পাবে ইন্দিরা-ইয়াহিয়া এক না দুই!'
আমাদের মুক্তিসংগ্রামে সিপিআইয়ের ছিল অসাধারণ ভূমিকা। সে সময়ই ওদের কংগ্রেস (সম্মেলন) চলছিল। সেই কংগ্রেসেই উপস্থিত হয়েছিলেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক আবদুস সালাম অর্থাৎ বারীন দত্ত। তাঁর উপস্থিতির সঙ্গে সঙ্গেই তিনি এমনভাবে অভিনন্দিত হয়েছিলেন যে সেই কংগ্রেসটি যেন সিপিআইয়ের বদলে সিপিবির কংগ্রেসে পরিণত হয়ে যায়। কংগ্রেসের বেশির ভাগ সময়জুড়ে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামেরই আলোচনা চলতে থাকে। কংগ্রেসে উপস্থিত অনেক বিদেশি কমিউনিস্ট পার্টিরই বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম সম্পর্কে অনেক দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল; যেমন_নাইজেরিয়ার কমিউনিস্ট পার্টির কাছে বাংলাদেশের সংগ্রামটি একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী প্রয়াস বলে প্রতিভাত হয়েছিল এবং সে কারণেই অভিমত প্রকাশ করেছিল যে কোনো রাষ্ট্রের কোনো অংশের বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়াকে কোনো কমিউনিস্ট পার্টিই সমর্থন জানাতে পারে না। বায়াফ্রা অঞ্চলটি যখন নাইজেরিয়া রাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে চেয়েছিল, তখন সব দেশের কমিউনিস্ট পার্টিই এর তীব্র বিরোধিতা করেছিল। সে রকমই পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়ে 'বাংলাদেশ' বা অন্য নামে নতুন রাষ্ট্র গড়াকে কোনো কমিউনিস্ট পার্টিরই সমর্থন জানানো উচিত নয়।
সে সময়কার সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টিও যে পুরোপুরি দ্বিধামুক্ত ছিল_তেমন বলা যাবে না। সে পার্টি বাংলাদেশের জনগণের ওপর পাকিস্তান সরকারের অত্যাচারের তীব্র নিন্দা জানিয়ে তা বন্ধ করতে বলেছিল বটে, কিন্তু বাংলাদেশের সংগ্রামকে স্পষ্ট করে 'মুক্তিসংগ্রাম' আখ্যা দেয়নি। বরং এর একটি রাজনৈতিক মীমাংসার ওপরই জোর দিয়েছিল। কিন্তু সিপিআই ও সিপিবি_উভয়েই বাংলাদেশের সংগ্রাম যে বিচ্ছিন্নতাবাদের বদলে প্রকৃতপক্ষে ছিল 'জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম' এবং সে রকম সংগ্রামের পক্ষে সব দেশের কমিউনিস্ট পার্টিরই দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করা অবশ্যকর্তব্য_সে বক্তব্যই জোরালো প্রমাণসহ উপস্থিত করে। এর ফলে সোভিয়েতের পার্টিরও সব দ্বিধাদ্বন্দ্ব দূর হয়ে যায়। এর পরপরই বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের পক্ষে ভারতের সঙ্গে সোভিয়েতের একাত্মতার কথা স্পষ্ট ঘোষিত হয় এবং ভারত নববলে উজ্জীবিত হয়ে ওঠে। এর ফলেই সাম্রাজ্যবাদের সমর্থনপুষ্ট পাকিস্তানের মুক্তিসংগ্রামীদের পক্ষে ভারত প্রকাশ্য ও সক্রিয় অবস্থান গ্রহণ করতে পারে।
তবু একটু আগেই যে ভারতের তৎকালীন শাসকগোষ্ঠীর ভেতরকার বিভিন্ন অংশের মধ্যকার মতভিন্নতার কথা বলেছিলাম, সে কথাটিই আবার স্মরণ করছি। সেই শাসকদের এ রকমই একটি বিশেষ প্রভাবশালী অংশের মনোভাব প্রকাশক দুটি উক্তি সম্প্রতি কালের কণ্ঠে (৬ নভেম্বর ২০১১) প্রকাশ করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এমাজউদ্দীন আহমদ। সেই উক্তি দুটি ভারতের কে সুব্রাহ্মনিয়ামের। উক্তি দুটি হলো_১. 'পাকিস্তানের ভেঙে যাওয়া ভারতীয় স্বার্থের অনুকূল। তাই পূর্ব পাকিস্তান সংকট আমাদের জন্য যে সুযোগ সৃষ্টি করেছে, তা হাতছাড়া করা আমাদের উচিত নয়। এমন সুযোগ আর কোনো দিন আসবে না।' ২. 'বিপ্লববাদী বামপন্থী কোনো নেতৃত্ব যেন বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন হতে না পারে, ভারত আগেভাগেই স্বীয় নিরাপত্তার স্বার্থে সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণ করে তাও নিশ্চিত করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।'
এর পরই এমাজউদ্দীন আহমদ লিখেছেন, 'ভারত এখানেই থামেনি। মুক্তিযুদ্ধে সব দল ও মতের তরুণ-তরুণীরা অংশগ্রহণ করলেও বামবিরোধী আওয়ামী লীগের অবস্থানকে সুদৃঢ় করতে মুক্তিবাহিনীর বিপরীতে ভারতপন্থী মুজিব বাহিনীও গঠন করে, যদিও বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এই পরিকল্পনার বিরোধিতা করেছিলেন। মুজিব বাহিনীর সদস্যদের প্রশিক্ষণ ছিল উন্নততর। তাদের অস্ত্রশস্ত্র ছিল উন্নতমানের। ভারতের গোয়েন্দা সংস্থার [Research and Analysis Wing (RAW)] তত্ত্বাবধানে এই বাহিনী প্রবাসী সরকারকে এড়িয়েও কাজ করত। এই তো হলো বামপন্থী সম্পর্কে ভারতের দৃষ্টিভঙ্গি ও কার্যক্রম।'
এমাজউদ্দীন সাহেবের কথাগুলো সাধারণভাবে সত্য হলেও ঢালাওভাবে এ রকমটি 'ভারতের দৃষ্টিভঙ্গি ও কার্যক্রম' বলাটা ঠিক নয়। আসলে এটি ভারতের শাসকগোষ্ঠীর একটি বিশেষ প্রভাবশালী অংশের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। এদের এ রকম মনোভঙ্গি এখনো, এই একবিংশ শতাব্দীতেও, বহাল আছে। তবে ভারতের মুক্তমনা ও প্রগতিচেতন মানুষের সংখ্যা ও শক্তিও একেবারে কম নয়। তাদেরই মুখপাত্ররূপে যেন কিছুদিন আগেও ভারতের বিশিষ্ট চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব গৌতম ঘোষ বলেছেন, 'দিলি্লতে করপোরেট আর আমলাদের একটা লবি আছে, যারা বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বাণিজ্য বাধাগ্রস্ত করছে। এই লবিটা বাংলাদেশের সঙ্গে বন্ধুভাবাপন্ন এবং ভ্রাতৃত্বমূলক সম্পর্ক চায় না। এই লবিকে হটাতে না পারলে ভারত ও বাংলাদেশ কাছাকাছি হতে পারবে না' ('মত ও পথ', ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১১)।
গৌতম ঘোষকে যাঁদের মুখপাত্র বলেছি, আমাদের মুক্তিসংগ্রামের কালে তাঁদের সক্রিয়তাও যথেষ্ট শক্তিশালী ছিল। সে কারণেই আমাদের মুক্তিসংগ্রামটি বেপথু হয়ে যেতে পারেনি।
ভারতের সেই প্রগতিশীল শক্তিটির সঙ্গে মৈত্রী স্থাপনের মধ্য দিয়েই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে।

লেখক : শিক্ষাবিদ

No comments

Powered by Blogger.