আলোকের এই ঝরনাধারায় (পর্ব-৫১)-'এলাম দেখলাম জয় করলাম' by আলী যাকের

সেই বাল্যকাল থেকেই আকাশের প্রতি আমার এক ধরনের প্রচণ্ড দুর্বলতা ছিল। সে আকাশ মেঘহীন সুনীল হোক কিংবা জলভরা মেঘে আচ্ছন্ন। তবে এ কথা স্বীকার করতেই হয় যে হেমন্তে যখন ঘন নীল আকাশ থাকে, মাঝেমধ্যে ভেসে যায় সাদা মেঘ, ওই আকাশ সত্যিকার অর্থে আমাকে উৎফুল্ল করে তোলে। আকাশ না দেখে আমি জীবন শুরু করতে পারি না। আমার সৌভাগ্য, আমার ঠিক বিছানার সঙ্গেই রয়েছে একটা বিশাল জানালা। রোজ ভোরের আলো


ফোটার সঙ্গে সঙ্গে আমি বিছানায় উঠে বসি, জানালা দিয়ে আকাশ দেখি, মনটা অসীম আনন্দে ভরে যায়।
কিছুদিনের মধ্যেই মনে হলো, এ রকম শুয়ে-বসে আর কাটানো যাচ্ছে না। করাচিতে যদি থাকতেই হয়, তাহলে একটা কিছু করা দরকার। সেই মুহূর্তে দেশে যে ফিরব, সে সম্ভাবনাও ছিল না। কেননা আমি ওয়ানওয়ে টিকিট নিয়ে করাচিতে এসেছি। ফিরে যাওয়ার টিকিট আমার কাছে ছিল না। যে সামান্য মাসোহারা ভাইয়া আমাকে পাঠাতেন, তা দিয়ে টিকিট কেনাও দুষ্কর। এ ছাড়া তখনো করাচি আমার সম্পূর্ণভাবে দেখা হয়ে ওঠেনি। ফলে একটা চাকরির প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। সে সময় করাচিতে আমার এক দূরসম্পর্কের খালাতো ভাই ছিল, প্রায় আমারই সমবয়সী। সে আমাকে খবর দিল যে করাচির একটি নামকরা বিজ্ঞাপনী প্রতিষ্ঠানে এঙ্িিকউটিভ ট্রেইনি নেবে। সেখানে চেষ্টা করে দেখতে পারি। যেদিন তার সঙ্গে কথা হয়, এর দুই দিন পর ইংরেজি দৈনিক 'ডন' পত্রিকায় একটি বিজ্ঞাপন বেরোল যে ক্রফোর্ড অ্যাডভারটাইজিং সার্ভিসেস লিমিটেড কম্পানিতে ট্রেইনি এঙ্িিকউটিভ নেওয়া হবে এবং এই নিয়োগের জন্য প্রার্থীদের সরাসরি ওই কম্পানির দপ্তরে গিয়ে ইন্টারভিউ দিতে হবে। রোমান সম্রাট জুলিয়াস সিজার বলেছিলেন_'ভিনি ভিডি ভিসি', অর্থাৎ 'এলাম দেখলাম জয় করলাম।' মাত্র ১৫ মিনিটের ইন্টারভিউতে আমার ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে গেল। আমাকে বলা হলো পরের সোমবার থেকে কাজ শুরু করতে। তখন এবং এখনো ইসলামিক রিপাবলিক অব পাকিস্তানে শনি ও রবিবার সাপ্তাহিক ছুটি।
চাকরি হয়ে গেল বটে, অফিসের খাতায় ৯টা-৫টা। ৯টায় অফিসে ঢুকতাম, কিন্তু কখন বেরোব তার ঠিক-ঠিকানা ছিল না। সেই বয়সে খুব যে একটা কষ্ট হতো তা নয়। আমার কাজটা ছিল অত্যন্ত সৃজনশীল প্রকৃতির। আমাকে একজন নির্বাহী পরিচালক বিজ্ঞাপনে শিক্ষিত করে তুলছিলেন। তিনি নাসরিন আন্দালিব। ওই এজেন্সিতে কপি চিফ ছিলেন। শুরু থেকেই আমাকে ইংরেজি কপির ওপর প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু হলো। কত অল্প কথায় কত সুন্দরভাবে একটি পণ্যের বিজ্ঞাপন লেখা যায়_এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ। লিখতে আমার ভালোই লাগত। প্রথম দিকে অত্যন্ত বেশি অলংকার দিয়ে লেখার একটা প্রবণতা আমার ছিল। ক্রমে আমি বিজ্ঞাপনের ভাষা বেশ আয়ত্তে নিয়ে এলাম। এই সময় বিজ্ঞাপনজগতের উদীয়মান সব এঙ্িিকউটিভ মিলিত হতো শেজান অ্যাম্পিস নামের একটি রেস্তোরাঁয়। এটি ছিল হোটেল মেট্রোপলের ঠিক উল্টো দিকে। এখানে কফির সঙ্গে ধুমিয়ে আড্ডা দেওয়া হতো। একেবারে শুরুতে আমি চুপচাপ থাকতাম, কেননা করাচির ছেলেমেয়েরা অত্যন্ত চটপটে ছিল। বোঝার চেষ্টা করতাম, তারা কী নিয়ে কথা বলছে। তারপর আমিও ওই দলের সঙ্গে মিশে গেলাম। সপ্তাহান্তের দিনগুলো আমি ঘুরে বেড়াতাম বাসে করে করাচির সর্বত্র। করাচিতে বেড়ানোর জায়গার অভাব ছিল না। সমুদ্রের ধারে বড়লোকদের জন্য গড়ে উঠেছিল ক্লিফটন নামের আবাসিক এলাকা। একটু বাইরে গেলেই পর্যটনের জন্য সমুদ্রসৈকত ছিল স্যান্ডস ্পিট, মনোরি ও প্যারাডাইস পয়েন্ট। মাঝেমধ্যে এসব সমুদ্রসৈকতে যাওয়া পড়ত। আমি এবং আমার সহকর্মীরা হইহই করে বেড়াতে যেতাম। এ ছাড়া করাচির পূর্ব-দক্ষিণে একটি আবাসিক এলাকার ঠিক মাঝখানে ছিল টিলার ওপর একটি পার্ক। এটিকে ডাকা হতো 'হিল পার্ক' বলে। সন্ধ্যায় তরুণ-তরুণীদের সমাগম হতো এই পার্কে। এখানেও আমরা দল বেঁধে যেতাম। খুব ভালো কুলফি পাওয়া যেত ওই পার্কে। শুনেছি, সম্প্রতি পার্কটি নিষিদ্ধ নেশার কেন্দ্র হয়ে গেছে। গার্ডেন রোডের ওপরই ছিল 'গান্ধী গার্ডেন' বলে একটি চিড়িয়াখানা। ভাবতে অবাক লাগে যে ষাটের দশকের মধ্যভাগেও গান্ধী নামটি ওরা বদলায়নি। এই গান্ধী গার্ডেনে কিছু বন্য প্রাণীও ছিল। এগুলো দেখতে ভিড় করত বাচ্চারা। এখন আমাদের ঢাকায় যেমন, ঠিক তেমনি করাচিতেও রেস্তোরাঁর কোনো অভাব ছিল না। জিন্নাহর কবরের খুব কাছে রাজপথের ওপরই ছিল বন্ধু খানের কাবাবের দোকান। এখানে অতি উপাদেয় কাবাব তৈরি হতো। অনেক সন্ধ্যা এই কাবাবের দোকানের সামনে ফুটপাতে বসে বসে আড্ডার সঙ্গে বিস্তর কাবাব খেয়েছি_এখনো মনে আছে। এই দোকানসংলগ্ন ছিল একটি পানের দোকান। এটির মালিক ছিলেন একজন বাঙালি এবং নোয়াখালীর লোক। হতেই হবে। এই ভূখণ্ডের কোথাও কোনো বাঙালি নেই, এমন তো হতেই পারে না। তাঁর সঙ্গে আমি একাধিক সন্ধ্যায় দাঁড়িয়ে আড্ডা মেরেছি। খুবই ভালো লাগত গল্প করতে। তবে গল্প শেষে দুজনেরই দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসত দেশের কথা মনে করে। পেটের দায়ে ভদ্রলোক দোকান চালাতেন করাচিতে, মন পড়ে থাকত নোয়াখালীর কোনো গ্রামে, যেখানে থাকত তাঁর পরমাত্মীয়রা। মাঝেমধ্যে এলফিনস্টোন স্ট্রিটে যেতাম। সেখানে আলো ঝলমলে সব দোকানপাট ছিল এবং ছিল ধনী মানুষের ভিড়। আমাদের দু-চারজন বন্ধুর জন্য এসব দোকানে এসে ভিড় করার প্রধান আকর্ষণ ছিল যুবতীরাই। কিছুক্ষণ ওই রাজপথে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত হাঁটাহাঁটি করে দীর্ঘশ্বাস ফেলতে ফেলতে আমরা ফিরে যেতাম যার যার আবাসস্থলে। এভাবেই কেটে যাচ্ছিল করাচির জীবন। (চলবে)

লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
« পূর্ববর্তী সংবাদ

No comments

Powered by Blogger.