শতাধিক অসুস্থ বিষাক্ত গ্যাসে

রাজধানীর অদূরে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জে রাসায়নিক কারখানায় ক্লোরিন প্লান্টের গ্যাস সরবরাহ লাইন থেকে ছড়িয়ে পড়া রাসায়নিক গ্যাসে শতাধিক ব্যক্তি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। গতকাল রোববার সকালে গেল্গাবাল হেভি কেমিক্যালস লিমিটেড নামে ক্লোরিন গ্যাস উৎপাদনকারী কারখানায় এ ঘটনা ঘটে। অসুস্থদের মধ্যে কারখানাটির শ্রমিক, স্থানীয় লোকজন, ফায়ার সার্ভিসের সদস্য ছাড়াও পুলিশ সদস্য রয়েছেন। তাদের মধ্যে মিটফোর্ড হাসপাতালে ২১ এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১৯ জনকে ভর্তি করা হয়েছে।


বাকিদের স্থানীয় হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। ছড়িয়ে পড়া রাসায়নিক গ্যাসের বিষক্রিয়ার আশঙ্কায় কারখানাটির পাশে একটি হাইস্কুলের সমাপনী পরীক্ষা স্থগিত করে শিক্ষার্থীদের ছুটি দিয়ে দেওয়া হয়।এদিকে রাসায়নিক গ্যাসের বিষক্রিয়ায় এলাকাবাসীর অসুস্থ হওয়ার জের ধরে স্থানীয় লোকজন কারখানাটির সামনে বিক্ষোভ মিছিল করেছেন। কারখানাটি থেকে ছড়িয়ে পড়া বিষাক্ত গ্যাসে এলাকার গাছপালা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে জানিয়ে বিক্ষোভকারীরা কারখানাটি অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন। দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের হাসনাবাদ এলাকায় বুড়িগঙ্গার তীর ঘেঁষে অবস্থিত ওই কেমিক্যাল কারখানায় বি্লচিং পাউডার, চুনের সমন্বয়ে বিভিন্ন রাসায়নিক দিয়ে ক্লোরিন গ্যাস উৎপাদন
করা হয়। এ গ্যাস পানি বিশুদ্ধকরণ, সার কারখানা ও কাগজ তৈরির কারখানায় ব্যবহার করা হয়। এছাড়াও সেখানে বিভিন্ন দাহ্য রাসায়নিক পদার্থ উৎপাদন করা হয়।
বিষাক্ত গ্যাসে অসুস্থ হয়ে মিটফোর্ড হাসপাতালে নাজমা বেগম, আরিফ, আনিসা, খোরশেদ, বদিউজ্জামান, কহিনুর, আলী হাওলাদার, বাহাদুর বেপারী, রফিক, আঁখি, রকিব ও ইউনুসকে ভর্তি করা হয়েছে। তারা সবাই স্থানীয় বাসিন্দা ও কারখানাটির শ্রমিক। এছাড়াও একই হাসপাতালে ফায়ার সার্ভিসের কর্মী আমিনুল ইসলাম, রবিন, মোশাররফ, মাহতাব, আজিজুল, আনোয়ার, রুবেল, শাহজাহান ও দেলোয়ার নামে ৯ জনকে ভর্তি করা হয়েছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মাসুম, স্বপন, সাধন, বরত আলী, মোঃ ফরিদ, টিপু সুলতান, ফটিক মিয়া, সাইদুল ইসলাম, ইদ্রিস মিয়া, রোজি আক্তার, ইকবাল হোসেন ও মেহেদি হাসানসহ ১৯ জনকে ভর্তি করা হয়েছে। এছাড়াও এ দুটি হাসপাতালসহ স্থানীয় হাসনাবাদ জেনারেল হাসপাতালে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার পরিদর্শক (তদন্ত) বেলায়েত হোসেনসহ পুলিশের তিন সদস্য এবং স্থানীয় লোকজন প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়েছেন।
স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের (মিটফোর্ড হাসপাতাল) মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. রফিকুল ইসলাম সমকালকে বলেন, ভর্তি হওয়া লোকজন গ্যাসের বিষক্রিয়ায় শ্বাসকষ্টে ভুগছে। তারা কেউই গুরুতর নন। ওই চিকিৎসক জানান, এ ধরনের গ্যাস অ্যাজমা রোগীর জন্য খুবই ভয়ঙ্কর।
অসুস্থ শ্রমিকরা জানান, গতকাল সকাল সাড়ে ৮টার দিকে প্রথম শিফটে ৫ শ্রমিক কারখানার বোটলিং প্লান্টে ক্লোরিন গ্যাস বোতলজাত করতে যান। হঠাৎ করেই মূল প্লান্ট থেকে বোটলিং প্লান্টের মধ্যখানে গ্যাসের পাইপ ছিদ্র হয়ে শব্দ করে গ্যাস বের হয়ে আসে। সঙ্গে সঙ্গে পুরো কারখানা এলাকায় বিষাক্ত গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে। এতে তাদের দম বন্ধ হয়ে আসে। তারা দ্রুত বোটলিং প্লান্ট থেকে অন্যত্র আশ্রয় নেন। এ সময় কর্মকর্তারাও অফিস থেকে বেরিয়ে নিরাপদে চলে যান। কারখানাটির সীমানার মধ্যে সাড়ে তিনশ' শ্রমিক বসবাস করে। আতঙ্কে তারা সবাই বাইরে বেরিয়ে যায়।
গ্যাস বোতলজাত করার দায়িত্বে থাকা কারখানাটির প্রকৌশলী মিলন বিশ্বাস সমকালকে বলেন, তার নেতৃত্বে পাঁচ শ্রমিক গ্যাস বোতলজাত করছিলেন। হঠাৎ করেই তাদের সামনে থাকা ডিজিটাল মিটার বন্ধ হয়ে গেলে তারা ঝামেলার আঁচ করতে পারেন। মুহূর্তেই ক্লোরিং গ্যাসের মূল প্লান্ট থেকে বোটলিং প্লান্টে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দেন। এ সময়ের মধ্যে পাইপে যতটুকু গ্যাস ছিল তাই বাইরে ছড়িয়ে পড়ে। তিনিসহ পাঁচ শ্রমিক ডিজিটাল মাস্ক (মুখোশ) পরা অবস্থায় থাকায় তাদের কোনো সমস্যা হয়নি। এতে প্লান্টের পাশে থাকা ১০-১২ জন শ্রমিক কিছুটা অসুস্থ হয়ে পড়লে তাদের অক্সিজেন দিয়ে কারাখানার মধ্যেই সুস্থ করা হয়। পাশাপাশি বড় ধরনের কোনো দুর্ঘটনার আশঙ্কায় ফায়ার সার্ভিস সদস্যদের খবর দেওয়া হয়।
ফায়ার সার্ভিসের উপ-পরিচালক (ঢাকা বিভাগ) শেখ মিজানুর রহমান সমকালকে বলেন, সকাল পৌনে ৯টার দিকে খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের তিনটি ইউনিট ঘটনাস্থলে যায়। সেখানে প্রায় এক ঘণ্টা চেষ্টা চালিয়ে কারখানার কর্মীদের সহযোগিতায় ছিদ্র হয়ে যাওয়া পাইপটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। তার আগেই পুরো কারখানায় বিষাক্ত ক্লোরিন গ্যাস ছড়িয়ে পড়ে। এতে ফায়ার সার্ভিসের ১৭ কর্মী অসুস্থ হয়ে পড়েন।
ফায়ার সার্ভিসের এ কর্মকর্তা আরও জানান, চার শতাংশ ক্লোরিন বাতাসের সঙ্গে মিশে গেলে তা মানুষের জীবনের জন্য ঝুঁকি হয়ে দাঁড়ায়। কারখানাটিতে আগুন নিয়ন্ত্রণে বা রাসায়নিক পদার্থের কারণে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনা মোকাবেলা করার মতো সরঞ্জাম ছিল না।
হাসনাবাদ এলাকার বাসিন্দা লাইজুল ইসলাম ও আমজাদ হোসেন অভিযোগ করেন, গ্গ্নোবাল হেভি কেমিক্যালের কারখানা থেকে শুধু গতকালই নয়; প্রতিদিনই বিষাক্ত গ্যাস ছড়াচ্ছে। এতে এলাকায় পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। কারখানাটির বিষাক্ত বর্জ্যে পুরো এলাকার গাছপালা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এ ঘটনার জের ধরে এর আগেও তারা মিছিল সমাবেশ করেছেন।
কারখানাটির প্লান্ট ম্যানেজার দীপক কুমার কুণ্ডু সমকালকে বলেন, ২০০২ সাল থেকে তারা এখানে ক্লোরিন গ্যাস উৎপাদন করে বাজারজাত করছেন। তাদের এ ক্লোরিন ঢাকা ওয়াসা, চট্টগ্রাম ওয়াসাসহ বিভিন্ন কারখানায় সরবরাহ করা হয়। ক্লোরিন উৎপাদন করে তা একটি প্লান্টে রাখা হয়। সেখান থেকে সাব-প্লান্টের মাধ্যমে বোতলজাত করা হয়। এ বোতলজাত করতে গিয়ে গতকাল সামান্য দুর্ঘটনা ঘটে। তিনি বলেন, গ্যাস কারখানার উৎপাদিত ক্লোরিন বিষাক্ত। এজন্য তারা সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করেন। পুরো কারখানাটি ডিজিটাল কম্পিউটারাইজড পদ্ধতিতে চলে। এখানের গ্যাস বাইরে ছড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। অসুস্থদের ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বোটলিং প্লান্টের পাশে মাস্ক ছাড়া ১০-১২ কর্মী অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাদের কারখানায় প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.