ঢাকায় ছিনতাইকারীদের ত্রাস জবাই, গুলি করে টাকা লুট

যাত্রাবাড়ী আর গেণ্ডারিয়া। এই দুই থানা এলাকা গতকাল রবিবার যেন ছিল অনেকটা সন্ত্রাসীদের দখলে। দিনের আলোর শুরুতেই উত্তর যাত্রাবাড়ীতে ছিনতাইকারীরা জবাই করে হত্যা করেছে নুরুল ইসলাম নামের এক ক্ষুদ্র মাছ ব্যবসায়ীকে। এর মাত্র কয়েক ঘণ্টা পরই ছিনতাইকারীদের আরেকটি দল গেণ্ডারিয়ায় একটি মোবাইল কম্পানির দুই কর্মচারীকে গুলি করে ও চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে ২৫ লাখ টাকা ছিনিয়ে নিয়েছে। একই এলাকায় আরেক ঘটনায় সন্ত্রাসীরা নির্মাণাধীন একটি বাড়ির মালিককে না পেয়ে সেখানে কর্তব্যরত দুজনকে গুলি করে গুরুতর আহত করেছে। ঘটনার পর মালিকের মোবাইল ফোনে পাঠানো মেসেজে জানানো হয়েছে, 'কাফনের কাপড় রেডি রাখিস।


' এ ছাড়া রাজধানীর দক্ষিণখান থানা এলাকায় পৃথক ঘটনায় সন্ত্রাসীরা একজন ব্যবসায়ীকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে চার লাখ টাকা ছিনিয়ে নিয়েছে। পৃথক এসব ঘটনায় আহত পাঁচজনই এখন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
উল্লেখ্য, গেণ্ডারিয়ায় এর আগের রবিবারও ছিনতাইকারীরা দুই ব্যক্তিকে গুলি করে ১১ লাখ টাকা ছিনিয়ে নিয়েছিল। ওই ঘটনায় পুলিশ এখন পর্যন্ত কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি। পুলিশ জানায়, গতকাল ঘটনার পরপরই র‌্যাবসহ ডিবি ও পুলিশের অন্য শাখার কর্মকর্তারাও ঘটনাস্থলগুলোতে যান। অপরাধীদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।
যাত্রাবাড়ীতে মাছ ব্যবসায়ী খুন
গতকাল ভোর সাড়ে ৫টার দিকে একটি আড়ত থেকে মাছ আনতে যাত্রাবাড়ীর ৮৬/বি নম্বরের ভাড়া বাসা থেকে বের হয়েছিলেন নুরুল ইসলাম। তাঁর কাছে প্রায় আট হাজার টাকা ছিল। পায়ে হেঁটেই যাচ্ছিলেন তিনি। যাত্রাবাড়ী থানার অদূরে শহীদ জিয়া স্কুলের কাছে পেঁৗছামাত্র কয়েকজন ছিনতাইকারী তাঁর গতিরোধ করে। এ সময় ছিনতাইকারীদের সঙ্গে তাঁর ধস্তাধস্তি হয়। একপর্যায়ে ছিনতাইকারীরা তাঁকে জবাই করে তাঁর কাছে থাকা টাকা নিয়ে চলে যায়। কয়েকজন পথচারী ঘটনাটি দূর থেকে প্রত্যক্ষ করলেও তারা ভয়ে কেউই এগিয়ে আসেনি। পুলিশ সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
যাত্রাবাড়ী থানার এসআই প্রদীপ জানান, ভোরের দিকে আশপাশে পুলিশ টহল থাকলেও ঘটনাটি তাদের নজরে আসেনি। পরে পুলিশ গিয়ে লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল মর্গে পাঠিয়েছে। নিহতের চাচাত ভাই আবদুর রশিদ বাদী হয়ে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছেন।
নিহত নুরুল ইসলামের মামা মুনির হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, নুরুল ইসলাম উত্তর যাত্রাবাড়ী এলাকায় সাত-আট বছর ধরে ফেরি করে মাছ বিক্রি করছিলেন। তাঁর গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরে। তিনি এক ছেলে, তিন মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে যাত্রাবাড়ীতে থাকতেন।

শ্যামপুরে ২৫ লাখ টাকা ছিনতাই
সকাল ১১টা। শ্যামপুরের দোলাইরপাড় এলাকার একটি ব্যস্ততম সড়কে শত শত পথচারীর সামনে অনেকটা ফিল্মি স্টাইলে ছিনতাইয়ের শিকার হন বাংলালিংকের ডিস্ট্রিবিউটর প্রতিষ্ঠান এনটিসি ডিস্ট্রিবিউশনের কর্মী ওয়াহিদুল ইসলাম ও হিসাবরক্ষক মোহাম্মদ দিদার। ছিনতাইকারীরা তাঁদের দুজনকে গুলি করে ২৫ লাখ টাকা ছিনিয়ে নেয়।
এনটিসি ডিস্ট্রিবিউশনের ব্যবস্থাপক আলমগীর হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, সকাল ১১টার দিকে ৯৮ দোলাইরপাড়ে রিমজউদ্দিন প্লাজার পঞ্চম তলায় অবস্থিত তাঁদের প্রতিষ্ঠানের অফিস থেকে প্যাকেটে ২৫ লাখ টাকা ভরে সিলগালা করে জমা দিতে দিদার ও ওয়াহিদুল যাত্রাবাড়ী ওয়ান ব্যাংকের শাখায় যাওয়ার জন্য গাড়িতে উঠছিলেন। এ সময় তিনটি মোটরসাইকেলে করে ছয় যুবক এসে তাঁদের ঘিরে ধরে টাকা ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। বাধা পেয়ে ছিনতাইকারীরা ওয়াহিদুলকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়লে তাঁর বুকে ও ডান হাতে গুলি লাগে। বাধা দিতে গিয়ে হিসাবরক্ষক দিদারও মারাত্মক আহত হন। তাঁর ডান হাতে চাপাতি দিয়ে আঘাত করে ছিনতাইকারীরা। ছিনতাইকারীরা তাঁদের কাছে থাকা টাকার প্যাকেটটি নিয়ে শত শত লোকের সামনেই ঘটনাস্থল ত্যাগ করে। তাদের হাতে থাকা আগ্নেয়াস্ত্রের ভয়ে কেউ এগিয়ে আসেনি। ছিনতাইকারীরা চলে যাওয়ার পর পথচারী এবং প্রতিষ্ঠানের লোকজন এসে দিদার ও ওয়াহিদুলকে উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠায়।
শ্যামপুর থানার ওসি মিয়া কুতুবুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, সম্প্রতি এলাকায় ছিনতাইকারীদের তৎপরতা বেড়ে গেছে। এর আগেও এ এলাকায় বেশ কয়েকটি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে। গত সপ্তাহে এলাকায় একই কায়দায় আরো একটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের ১১ লাখ টাকা ছিনতাই হয়েছে। এসব ঘটনায় কাউকে গ্রেপ্তার করা যায়নি।
গেণ্ডারিয়ায় চাঁদা না দেওয়ায় গুলিবিদ্ধ : সকালে গেণ্ডারিয়ার ঢালকানগর এলাকায় সন্ত্রাসীদের গুলিতে দুজন আহত হয়েছেন। তাঁরা হলেন ওয়াসার কর্মচারী আলী আজম ও নিরাপত্তাকর্মী জাহিদুল ইসলাম। আশঙ্কাজনক অবস্থায় তাঁদের ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শী ও পুলিশ জানায়, এক সপ্তাহ আগে শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমনের নাম ব্যবহার করে সন্ত্রাসীরা কাপড় ব্যবসায়ী ইকবাল হোসেনের কাছে ১০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে। তিনি ৮৫/৩ ঢালকানগরে নতুন বাড়ি নির্মাণ করছেন। এটি তৈরি করছিল ইনসাফ কনস্ট্রাকশন। গতকাল দুপুর ১টার দিকে দুই যুবক মোটরসাইকেলযোগে এসে নির্মাণাধীন ভবনে ইনসাফ কনস্ট্রাকশনের অফিস কক্ষে ঢুকে ইকবাল হোসেনের খোঁজ করেন। নিরাপত্তাকর্মী জাহিদুল যুবকদের পরিচয় জানতে চাইলে তর্কাতর্কি শুরু হয়। একপর্যায়ে যুবকদের একজন জাহিদুলকে লক্ষ্য করে এক রাউন্ড গুলি করে। এ সময় তাঁর চিৎকার ও গুলির শব্দে পাশেই কর্মরত ওয়াসার কর্মচারী আজম এগিয়ে এলে সন্ত্রাসী যুবকরা তাঁকে লক্ষ্য করেও গুলি করে। লোকজন এগিয়ে এলে দুই যুবক ফাঁকা গুলি ছুড়তে ছুড়তে মোটরসাইকেলে করে দ্রুত চলে যায়।
ইকবাল হোসেন গতকাল কালের কণ্ঠকে জানান, ২০-২৫ দিন আগে স্থানীয় ইমন গ্রুপের লোক পরিচয় দিয়ে মোবাইল ফোনে তাঁর কাছে ১০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করা হয়। বিষয়টি তিনি পুলিশকে জানান। গতকাল দুপুরে গুলির ঘটনা শুনে তিনি ঘটনাস্থলে যান। এর পর পরই তাঁর মোবাইল ফোনে একটি মেসেজ আসে। মেসেজে উল্লেখ আছে, 'তোকে দেখে নেব। তোর কাফনের কাপড় রেডি রাখিস_ইমন।' পুলিশ জানিয়েছে, যে নম্বর থেকে মেসেজটি এসেছে, সেটি দেশের বাইরের নম্বর। গেণ্ডারিয়া থানার এসআই আরশেদ আলী জানান, গুলিবিদ্ধ দুজনের অবস্থাই আশঙ্কাজনক। চাঁদা না দেওয়ার কারণেই এই ঘটনা ঘটেছে বলে তাঁরা জানতে পেরেছেন।
দক্ষিণখানে চার লাখ টাকা ছিনতাই : গত শনিবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে চাঁদা না দেওয়ায় দক্ষিণখান থানা এলাকার আমতলায় বিল্লাল হোসেন নামের এক ব্যবসায়ীকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে তাঁর কাছে থাকা চার লাখ টাকা ছিনিয়ে নিয়ে গেছে সন্ত্রাসীরা।
আহত বিল্লালের ভাই শফিকুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে জানান, বিল্লাল আমতলায় আরিফ ফার্নিচার ও ফ্রেশ ডোর বিক্রির ব্যবসা করেন। ঘটনার সময় তাঁর ভাই টাকা নিয়ে দোকান থেকে পায়ে হেঁটে কাছেই বাসায় ফিরছিলেন। পথে লুকিয়ে থাকা সন্ত্রাসীরা তাঁর ওপর হামলা চালিয়ে টাকা ছিনিয়ে নেয়।
শফিকুল আরো জানান, এক সপ্তাহ আগে স্থানীয় সন্ত্রাসী সিরাজ তাঁর ভাইয়ের কাছে এক লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে। চাঁদা না দিলে তাঁকে খুন করা হবে বলে হুমকিও দেওয়া হয়। ওই ঘটনায় তাঁরা দক্ষিণখান থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেছেন। আর এতেই ক্ষিপ্ত হয়ে এ হামলা হয়েছে।
দক্ষিণখান থানার এসআই সবুর জানান, ঘটনার অভিযোগ পেয়ে তদন্ত চলছে।

No comments

Powered by Blogger.