হকিতে পরিবর্তনের হাওয়া

দিনবদলের হাওয়া এখন সবখানে। রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি, ক্রীড়াঙ্গন_সবখানেই চলছে পরিবর্তন। এ মাসের ১ তারিখ থেকে বদলে গেল ক্রিকেটের অনেক আইন-কানুন। বদলে যাচ্ছে হকিও। তবে এক ঘোষণায় নয়, ধীরে ধীরে। একেবারে নতুন আদলের একটা টুর্নামেন্ট ২০ অক্টোবর থেকে শুরু হবে অস্ট্রেলিয়ার পার্থে, যার নাম 'ল্যাংকো ইন্টারন্যাশনাল সুপার সিরিজ_হকি ৯'। ছেলেদের বিভাগে অংশ নিচ্ছে অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, ভারত ও পাকিস্তান আর মেয়েদের বিভাগে অস্ট্রেলিয়া, ভারত ও মালয়েশিয়া।


অস্ট্রেলিয়ান মিডিয়ার ভাষায় এটা হতে যাচ্ছে হকির রেনেসাঁ! অস্ট্রেলিয়ার পুরুষ দলের কোচ রিক চার্লসওয়ার্থের উচ্ছ্বাসটা আরো বেশি, 'সত্তরের দশকে ক্রিকেটে বিপ্লব এনেছিল ক্যারি প্যাকার সিরিজ। রঙিন পোশাক, সাদা বল আর ফ্লাডলাইটের আলো নতুন জাগরণ ঘটিয়েছিল ক্রিকেটে। আমার মনে হয় এই সুপার সিরিজও হকিতে এমন কিছুই ঘটাবে।'
কী এমন হতে যাচ্ছে যে এত বেশি উচ্ছ্বসিত অস্ট্রেলীয়রা? সবচেয়ে বড় পরিবর্তনটা হচ্ছে খেলার সময়ে। হকি ম্যাচের ব্যাপ্তি এমনিতে ৭০ মিনিট। কিন্তু সুপার সিরিজে প্রত্যেকটা ম্যাচ হবে ৩০ মিনিটের। দুই অর্ধে খেলা হবে ১৫ মিনিট করে। প্রতি দলে ১১ জনের বদলে খেলবেন ৯ জন খেলোয়াড়। এ কারণেই টুর্নামেন্টের নামের সঙ্গে আছে 'হকি নাইন (৯)'। আরো বেশি গোলের জন্য পেনাল্টি কর্নারের সময় গোলরক্ষকের পাশে চারজনের বদলে এ আসরে থাকতে পারবে মাত্র দুজন। আর প্রতিপক্ষের ফরোয়ার্ড থাকবেন চারজন। অর্থাৎ দুজন ডিফেন্ডারের সঙ্গে চার ফরোয়ার্ডের লড়াই হয়ে পড়বে পেনাল্টি কর্নারে। একজন অন্তত খেলোয়াড়কে সব সময় থাকতে হবে প্রতিপক্ষের ডিফেন্সে। গোল বাঁচানোর জন্য সবাই নিজেদের সীমানায় এসে জড়ো হলে চলবে না। গোল পোস্টটাও হবে এক মিটার বেশি প্রশস্ত। অস্ট্রেলিয়ার এ আসরে সাদা বদলে খেলা হবে হলুদ বল দিয়ে। মোটা দাগে এই হচ্ছে পরিবর্তন।
হকির এই পরিবর্তনের সঙ্গে ক্যারি প্যাকার সিরিজের সম্পর্ক কী? সত্তর দশকে ক্যারি প্যাকার সিরিজে আইসিসির অনুমোদন ছিল না। সে কারণে কোনো ক্রিকেট বোর্ডই তাদের খেলোয়াড়দের সেখানে অংশ নেওয়ার অনুমতি দেয়নি। তার পরও সে সময়ের অনেক তারকা ক্রিকেটারই অংশ নিয়েছিলেন ওই 'বিদ্রোহী লিগ'-এ। সাদা বল, রঙিন পোশাক আর দিবারাত্রীর ম্যাচ দর্শকরা উপভোগ করায় এখন ওয়ানডে আর টোয়েন্টি টোয়েন্টি খেলা হচ্ছে সেই আদলেই। সেই সিরিজের সঙ্গে হকির সুপার সিরিজের ব্যবধান আকাশ-পাতাল, কেননা হকির আইন-কানুন এত বেশি পরিবর্তন হচ্ছে যে, খেলোয়াড়রাই অনেক সময় ধন্দে থাকেন কোন টুর্নামেন্টে কোন নিয়ম চলবে এ নিয়ে। এই যেমন কিছুদিন আগে এশিয়ান কাপ হকির টাইব্রেকারটা হয়েছে অদ্ভুত নিয়মে। গোলরক্ষক একা থাকবেন আর শট নেবেন একজন_দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা এই নিয়মের বদলে ওই টুর্নামেন্টে 'ভি'র বাইরে থেকে গোলরক্ষক আর বিপক্ষ দলের একজন খেলোয়াড় অংশ নিয়েছিলেন ওয়ান টু ওয়ানে। সেখানে গোলরক্ষককে কাটিয়ে নিয়ে বল ঠেলতে হয়েছে জালে। এ নিয়মটা থাকছে সুপার সিরিজেও।
এত পরিবর্তনের মাঝে সুপার সিরিজে দুজন খেলোয়াড় কম নিয়ে ৩০ মিনিটের খেলাটা আসলেই কোনো বিপ্লব ঘটাতে পারবে কি? এ নিয়ে সিডনি মর্নিং হেরাল্ড লিখেছে, 'এই টুর্নামেন্টে গোল হবে অনেক বেশি। মানুষ তো গোলের জন্যই খেলাটা দেখতে যায়। গ্যালারির পাশাপাশি টেলিভিশন দর্শকরাও উপভোগ করবেন সুপার সিরিজ। আন্তর্জাতিক হকি ফেডারেশনও নতুন ফরম্যাটের এই হকি চালু করে দিতে পারে টুর্নামেন্টটা সফল হলে।'
আসর শুরুর আগেই কিন্তু সুপার সিরিজের একটা নিয়ম পছন্দ করে ফেলেছে আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি। সাদার বদলে হলুদ বলে খেলাটা। ২০১২ অলিম্পিকেও তাই প্রথমবারের মতো হকি খেলা হবে হলুদ বলে। এই টুর্নামেন্টের পর আরো অনেক কিছুই সবাই পছন্দ করবে বলে মনে করেন নতুন এসব আইনের মূল পরিকল্পনাকারী রিক চার্লসওয়ার্থ, 'এ নিয়মে খেলার গতি-ছন্দ যেমন বাড়বে তেমনি বাড়বে খেলোয়াড়দের স্কিলও। এখন খেলাটা অনেক বেশি স্ট্যামিনানির্ভর। আমরা চাই এর সঙ্গে যোগ হোক স্টাইলও। ভারত-পাকিস্তানের খেলোয়াড়রা অনেক বেশি স্টাইলিশ। এই ফরম্যাটে ওদের ভালো করার সম্ভাবনা বেশি।'
আসলে হকিকে আরো আকর্ষণীয় করতে প্রতিবছরই নতুন নতুন নিয়ম পরীক্ষামূলকভাবে প্রয়োগ করে দেখা হয় বিভিন্ন আসরে। আন্তর্জাতিক হকি ফেডারেশন বা এফআইএইচ এমন পরীক্ষা-নিরীক্ষার অনুমতি দিয়েই রেখেছে। ২০০৭-০৮ মৌসুমে এফআইএইচ রুল বুকে সংযুক্ত করেছে 'টু ইয়ার্স রুল সার্কেল'। এর মূল কথা হলো প্রতি দুই বছর পরপর বিভিন্ন আইনের রিভিউ হবে। এই দুই বছরের মধ্যে যেকোনো দেশ পরীক্ষামূলকভাবে যেকোনো আইন চালু করতে পারে তাদের ঘরোয়া হকি বা নিজ দেশে অনুষ্ঠিত কোনো আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে। এই নিয়মগুলো 'এঙ্পেরিমেন্টাল'। পছন্দ হলে এফআইএইচ পরে সব দেশকেই নির্দেশ দেবে এটা মানার, তখন নিয়মটাকে বলা হবে 'ম্যান্ডেটরি এঙ্পেরিমেন্টাল'। সবাই প্রয়োগ করে দেখার পর কারো তরফ থেকে কোনো আপত্তি না উঠলে দুই বছর পর চূড়ান্তভাবে গৃহীত হবে সেটা। অর্থাৎ তিন ধাপে প্রতি দুই বছর পর নতুন আইন পাচ্ছে হকি। পরীক্ষা চালাতে গিয়ে কোনো কোনো দেশে গোলরক্ষক ছাড়াই খেলা চালানোরও চেষ্টা চলেছে! সেই চেষ্টাকে অবশ্য উৎসাহ দেয়নি এফআইএইচ।
গত পাঁচ বছরে হকির নিয়মে সবচেয়ে বড় যে পরিবর্তন এসেছে তা হলো অফসাইড উঠে যাওয়া। হকিতে এখন যে কেউ ম্যাচের পুরোটা সময়ই থাকতে পারবেন বিপক্ষ দলের 'ভি'র পাশে। এ ছাড়া ফাউল হলে ফ্রি-হিটের সময় কেউ চাইলে হিট না নিয়ে বা কাউকে পাস না দিয়ে একা একাই বল নিয়ে এগিয়ে যেতে পারেন এখন!
ঘাস থেকে টার্ফে অনেক দিন আগেই এসেছে হকি। ভারত-পাকিস্তানের রাজত্বও শেষ হয়েছে তাতে। তবে টার্ফেও সর্বকালের অন্যতম সেরা খেলোয়াড় ভাবা হয় পাকিস্তানের সোহেল আব্বাসকে। তাঁর হিটের সুইং অনেক গোলরক্ষক বুঝতেই পারতেন না। ৫০টির বেশি স্টিকের কার্ভ থাকাতেই এমন সুইং পেতেন আব্বাস। কিন্তু এখন আর এ ধরনের স্টিক নিয়ে খেলতে পারেন না কেউ। নতুন নিয়ম অনুযায়ী ২৫টির বেশি স্টিকের কার্ভ থাকতে পারবে না।
নতুন নতুন আইনের প্রয়োগে অস্ট্রেলিয়ার সুপার সিরিজ কি আসলেই 'রেনেসাঁ' আনতে পারবে হকিতে? বাংলাদেশ জাতীয় দলের খেলোয়াড় মশিউর রহমান বিপ্লব মনে করেন ক্রিকেটের টোয়েন্টি টোয়েন্টির আদলে হকির ফিফটিন-ফিফটিনের কোনো দরকার নেই, 'হকি তো এমনিতেই ৭০ মিনিটের খেলা। এর দৈর্ঘ্য আরো ছোট করার দরকার কী?' তবে বাংলাদেশ হকি দলের সাবেক কোচ কাওসার আলী স্বাগতই জানিয়েছেন নতুন নিয়মের টুর্নামেন্টকে, 'বিকেএসপিতে এ বছরের আগস্টে আমরা ৩০ মিনিটে খেলেছি সিঙ্ এ সাইড হকি। টুর্নামেন্টটা উপভোগ্যই ছিল। আন্তর্জাতিক হকিতেও ৯ জন নিয়ে ৩০ মিনিটের খেলাটা উপভোগ্য হওয়ার কথা।' আন্তর্জাতিক হকি ফেডারেশনও যদি মনে করে টুর্নামেন্টটা উপভোগ্য হয়েছে, তাহলে কিন্তু বিপ্লব না হলেও আরো কিছু পরিবর্তন আসতেই পারে হকিতে।

No comments

Powered by Blogger.