ইউরোপ আমেরিকায় বিক্ষোভের আগুন

বৈষম্যপূর্ণ, অতি মুনাফালোভী পুঁজিবাদী বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থাবিরোধী বিক্ষোভের আগুন ছড়িয়ে পড়েছে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেনসহ সারাবিশ্বে। বিক্ষোভ সামলাতে হিমশিম ইউরোপ, আমেরিকা। শনিবার বিশ্বের ৮২টি দেশের ৯৫১ শহরে বিক্ষোভ হলেও অস্ট্রেলিয়া, এশিয়া, আফ্রিকার দেশগুলোতে তা ছিল মোটামুটি শান্তিপূর্ণ। আর সহিংসতার আগুন ইউরোপ, আমেরিকায়। ইতালির রাজধানী রোমে পুলিশের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়েছে। সেখানে বিক্ষোভকারীরা একটি সরকারি ভবন, বেশ কয়েকটি গাড়ি ও ব্যাংকে আগুন ধরিয়ে দেয়। বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ টিয়ার শেল নিক্ষেপ ও জলকামান ব্যবহার করে।


সহিংসতায় আহত হয় ৭০ জন। পুলিশ ১২ বিক্ষোভকারীকে গ্রেফতার করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় শহর নিউইয়র্কের ওয়ালস্ট্রিট (নিউইয়র্ক শেয়ারবাজার) এলাকার জুকোটি পার্ক থেকে শনিবার বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে ব্যস্ততম টাইমস স্কয়ারে। সেখানে পুলিশের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের ব্যাপক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। পুলিশ নিউইয়র্ক থেকে কমপক্ষে ৮৮ বিক্ষোভকারীকে গ্রেফতার করেছে।
গত ১৭ সেপ্টেম্বর 'অকুপাই ওয়ালস্ট্রিট' বা 'ওয়ালস্ট্রিট দখল করো' শীর্ষক এ আন্দোলন শুরু হয় নিউইয়র্ক থেকেই। শিক্ষার্থী ও সদ্য শিক্ষা জীবন শেষ করা হতাশ বেকার তরুণ-তরুণীদের এ আন্দোলন ক্রমেই ছড়িয়ে পড়ে ওয়াশিংটন ডিসিসহ পুরো আমেরিকায়। প্রায় এক মাসের মাথায় শনিবার দুনিয়া কাঁপালো অকুপাই ওয়ালস্ট্রিট আদলের পুঁজিবাদবিরোধী বিক্ষোভ। এরই মধ্যে এ বিক্ষোভকে অনেকে তুলনা করছেন সাম্প্রতিক আরব গণজাগরণের সঙ্গে। আরব গণজাগরণে মিসর বিপ্লবে কায়রোর তাহরির স্কয়ার কিংবা ইয়েমেনের ফ্রিডম স্কয়ারের কথা নিশ্চয়ই সবার মনে আছে। তাঁবু গেড়ে হাজার হাজার বিক্ষোভকারী রাতের পর রাত কাটিয়েছে তাহরির স্কয়ার ও ফ্রিডম স্কয়ারে। শনিবার নিউইয়র্কের টাইমস স্কয়ার, ব্রিটেনের লন্ডন, জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট ও হল্যান্ডের আমস্টারডামে মোটামুটি সে আদলেই রাত কাটিয়েছে শত শত পুঁজিবাদবিরোধী বিক্ষোভকারী। করপোরেটদের অতি মুনাফার লোভ আর সরকারের বাজেট সংকোচনের প্রতিবাদে লন্ডনের প্রধান বাণিজ্যিক জেলার সেন্ট পল গির্জার বাইরে প্রায় ৫০০ বিক্ষোভকারী রাত যাপন করেছে। সেখানে টাঙানো হয়েছে প্রায় ৭০টি তাঁবু। ফ্রাঙ্কফুর্টে ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সামনে রাতে অবস্থান নেয় প্রায় ২০০ বিক্ষোভকারী। আমস্টারডাম স্টক এক্সচেঞ্জের বাইরে ৫০টি তাঁবুতে রাত কাটায় কয়েকশ' বিক্ষোভকারী। শনিবার সবচেয়ে বড় বিক্ষোভ হয়েছে স্পেনের মাদ্রিদ, পর্তুগালের লিসবনে। মাদ্রিদের পুয়েত্রা দেল সোল স্কয়ারে 'আদিবাসী' পরিচয়ে ১০ হাজরের বেশি মানুষ বিক্ষোভে অংশ নেয়। স্পেনের এল পাইস দৈনিক পত্রিকার ভাষায়_ 'আদিবাসী আন্দোলন বিশ্বশক্তির সঙ্গে আবার জাগ্রত হয়েছে।' ইতালির লা স্তাম্পা পত্রিকার ভাষায়_ 'রাস্তায় নেমে এসেছে গোটা বিশ্ব।' ইতালির রিপাবলিকা পত্রিকা এটাকে আরব গণজাগরণের সূচনা বা মুখবন্ধ হিসেবে অভিহিত করেছে। পর্তুগালের লিসবনে বিক্ষোভ করেছে ২০ হাজার মানুষ।
নিউইয়র্কের টাইমস স্কয়ার থেকে পুলিশ গ্রেফতার করে ৪৫ জন 'অকুপাই ওয়ালস্ট্রিট' বিক্ষোভকারীকে। কঠোর পুলিশি নিরাপত্তা ভেদ করে পর্যটকদের মধ্যে মিশে গিয়ে সেখানে হাজার হাজার বিক্ষোভকারী প্রধান প্রধান বাণিজ্যিক স্থাপনা এলাকায় ঢুকে পড়ে। নিউইয়র্কের ৪৬তম স্ট্রিট ও সেভেনথ এভিনিউতে পুলিশের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষ হয়। পুলিশ টাইমস স্কয়ারের মুখে বিক্ষোভকারীদের গতিরোধ করে। এ সময় হুড়োহুড়ি ও ছোটাছুটিতে এক মহিলার মাথা ফেটে যায়। বিক্ষোভকারীরা স্লোগান দেয়, 'অল ডে অল উইক, অকুপাই ওয়ালস্ট্রিট।' এর আগে সিটিব্যাংকের একটি শাখায় অনুপ্রবেশকালে পুলিশ ২৪ বিক্ষোভকারীকে গ্রেফতার করে। সিটিব্যাংক বলেছে, নিউইয়র্কের ওয়াশিংটন স্কয়ার পার্কের কাছে ব্যাংকের একটি শাখার ভেতরে বহুসংখ্যক বিক্ষোভকারী ঢুকে পড়ার পর তারা পুলিশ তলব করে। এ ছাড়া মধ্যরাতের কারফিউ লঙ্ঘনের দায়ে ওয়াশিংটন স্কয়ার পার্ক থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে আরও ১৪ জনকে। নগরীর বিভিন্ন স্থানে আটক হয়েছে আরও বিক্ষোভকারী। এর আগে শিক্ষার্থী, প্রাতঃভ্রমণে বের হওয়া বিভিন্ন পরিবার এবং ট্রেড ইউনিয়ন কর্মীরা 'উই আর দ্য ৯৯ পারসেন্ট', 'অ্যারেস্ট দ্য ওয়ান পারসেন্ট' লেখা প্ল্যাকার্ড নিয়ে বিক্ষোভ করে ওয়ালস্ট্রিটের দিকে এগিয়ে যায়। তাদের প্ল্যাকার্ডে আরও লেখা ছিল, 'উই আর দ্য পিপল' এবং 'মি. ওবামা উই নিড ইওর সাপোর্ট'। এ ছাড়া ওয়াশিংটনের ন্যাশনাল মল এলাকায় ২ হাজার থেকে ৩ হাজার মানুষ পুঁজিবাদবিরোধী বিক্ষোভে অংশ নেয়।
প্রসঙ্গত, 'ইউনাইটেড ফর গ্গ্নোবাল চেঞ্জ' নামে একটি কেন্দ্রীয় ওয়েবসাইটের মাধ্যমে আয়োজন করা হয়েছে শনিবারের এ বিশ্বজুড়ে বিক্ষোভ। এ ছাড়া ফেসবুক ও টুইটারে 'অক্টোবর ১৫' নামে পেজ খুলে তরুণ-তরুণীদের আহ্বান জানানো হয় বিক্ষোভে অংশ নিতে।

পুঁজিবাদবিরোধী 'ওয়ালস্ট্রিট দখল করো' আন্দোলন ইউরোপে ছড়াচ্ছে ভিন্ন নামে। 'ইউরোপ দখল করো' স্লোগানে বিভিন্ন শহরে শত শত বিক্ষোভকারী রাজপথে নেমে এসেছে। বিক্ষোভকারীরা জড়ো হচ্ছে বৃহৎ ব্যাংক, শেয়ারবাজার ও করপোরেট প্রতিষ্ঠানের সামনে।
জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্টের প্রধান ব্যবসায়িক কেন্দ্র, দেশটির শেয়ারবাজার ও ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সদর দফতর অভিমুখে হাজার হাজার কর্মী বিক্ষোভ করেছে। 'লন্ডন শেয়ারবাজার দখল করো' স্লোগান নিয়ে শত শত বিক্ষোভকারী শেয়ারবাজার অভিমুখে বিক্ষোভ করার চেষ্টা করেছে। বিক্ষোভকারীরা জানায়, তারা আরব গণজাগরণে অনুপ্রাণিত। লন্ডনের বিক্ষোভে যোগ দিয়েছেন ভিন্নধারার গণমাধ্যম উইকিলিকসের প্রতিষ্ঠাতা জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ। তিনি বলেন, 'এই বিক্ষোভে সমর্থন দেওয়ার অন্যতম কারণ হলো, এখানকার ব্যাংক ব্যবস্থা দুর্নীতির টাকার গ্রহীতা।'
বিশ্বব্যাপী চলতে থাকা পুঁজিবাদবিরোধী বিক্ষোভের সমর্থনে এবং জি-২০ অর্থমন্ত্রীদের বৈঠক সামনে রেখে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে শত শত মানুষ বিক্ষোভ করেছে।

No comments

Powered by Blogger.