লাগামহীন মূল্যস্ফীতি গড় ১২ খাদ্যে ১৪

লাগামহীনভাবে বাড়ছে মূল্যস্ফীতি। জিনিসপত্রের দাম এখন নিয়ন্ত্রণের বাইরে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো থেকে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, দেশে পয়েন্ট টু পয়েন্ট অর্থাত্ আগের বছরের সেপ্টেম্বরের তুলনায় চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে গড় মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১ দশমিক ৯৭ শতাংশ। উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, এ সময় খাদ্যে মূল্যস্ফীতি ১৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ। খাদ্যে মূল্যস্ফীতি শহরাঞ্চলে ১৪ দশমিক ৬৭ শতাংশ। বিবিএসের হিসাবে, বাংলাদেশের একজন মানুষ আয়ের প্রায় ৫৯ শতাংশ ব্যয় করে খাদ্য কিনতে। খাদ্যের মূল্য বেড়ে গেলে মূল্যস্ফীতিতে বড় ধরনের চাপ তৈরি হয়।


এদিকে মূল্যস্ফীতিতে বর্তমান সরকারের আমলেই ঝুঁকিসীমা অতিক্রম করেছে বাংলাদেশ। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাব অনুযায়ী মূল্যস্ফীতি ৮ শতাংশ ছাড়িয়ে যাওয়াটা ঝুঁকিপূর্ণ।
মূল্যস্ফীতিতে এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শীর্ষ চারে এখন বাংলাদেশের অবস্থান, যা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে তৃতীয়। তবে কয়েক বছর আগেও শীর্ষ ১০-এর নিচে ছিল বাংলাদেশ। ক্রমেই অন্য দেশগুলোকে পেছনে ঠেলে মূল্যস্ফীতির লাগাম আরও উচ্চতায় টেনে নিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। এ তালিকায় দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম অবস্থানে আছে যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তান ও দ্বিতীয় পাকিস্তান। এশিয়ার দেশগুলোর সেপ্টেম্বরের মূল্যস্ফীতি নিয়ে নিউইয়র্কভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘ট্রেডিং ইকনোমিক্স’ সম্প্রতি একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। এতে জানানো হয়েছে, এশিয়ার মধ্যে ভিয়েতনামে সেপ্টেম্বরে মূল্যস্ফীতি ছিল সর্বোচ্চ ২২ দশমিক ৪২ শতাংশ। আফগানিস্তানে ১৭ শতাংশ, পাকিস্তানে ১১ দশমিক ৯৯ শতাংশ।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) জানিয়েছে, গত সেপ্টেম্বরে দেশে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১১ দশমিক ৯৭ শতাংশ, যা গত আগস্টে ছিল ১১ দশমিক ২৯ শতাংশ, জুলাইয়ে ১০ দশমিক ৯৬, জুনে ১০ দশমিক ১৭ শতাংশ, মে মাসে ১০ দশমিক ২০ শতাংশ, এপ্রিলে ১০ দশমিক ৬৭ শতাংশ, মার্চে ১০ দশমিক ৪৯ শতাংশ, ফেব্রুয়ারিতে ৯ দশমিক ৭৯ এবং জানুয়ারিতে ৯ দশমিক ০৪ শতাংশ। গত বছরের সেপ্টেম্বরে মূল্যস্ফীতি ছিল ৭ দশমিক ৬১ শতাংশ, আগস্টে ৭ দশমিক ৫২ শতাংশ, জুলাইয়ে ছিল ৭ দশমিক ২৬ শতাংশ, জুনে ৮ দশমিক ৭০ শতাংশ, মে মাসে ৮ দশমিক ৬৫ শতাংশ, এপ্রিলে ৮ দশমিক ৫২ শতাংশ, মার্চে ৮ দশমিক ৭৮ শতাংশ, ফেব্রুয়ারিতে ৯ দশমিক ০৬ শতাংশ এবং জানুয়ারিতে ৮ দশমিক ৯৯ শতাংশ। পর্যালোচনায় দেখা যায়, বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি ঝুঁকিসীমা অতিক্রম করেছে গত বছর জানুয়ারিতেই।
সরকারের আর্থিক খাতে চরম অব্যবস্থাপনার কারণে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাচ্ছে বলে অর্থনীতিবিদরা মনে করেন। তাদের মতে, অতিরিক্ত সুদ হারের কারণে শিল্প খাতের উত্পাদন ব্যয় বেড়ে যায়। তাছাড়া গ্যাস ও বিদ্যুত্ সঙ্কটের কারণে উদ্যোক্তারা বিকল্প জ্বালানি ব্যবহার করায় উত্পাদন ব্যয়ের পাশাপাশি বাড়ছে পণ্যমূল্য। ব্যাংক ব্যবস্থা থেকেও হাজার হাজার কোটি টাকার ঋণ নিচ্ছে সরকার। সরকারি ঋণের চাহিদা মেটাতে গিয়ে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ প্রায় বন্ধ। এতে দেশে শিল্পায়ন একেবারেই হচ্ছে না। বাড়ছে না কর্মসংস্থান।
মূল্যস্ফীতির মাধ্যমে নির্দিষ্ট সময়ে দেশে দ্রব্যমূল্য বাড়ার হার পরিমাপ করা হয়। ১১ দশমিক ৯৭ শতাংশ মূল্যস্ফীতির অর্থ হচ্ছে, আগে ১০০ টাকায় যে পণ্য পাওয়া যেত, বর্তমানে তার বাজারমূল্য ১১১ টাকা ৯৭ পয়সা। একই হারে আয় না বাড়লে জনসাধারণকে ১১ টাকা ৯৭ পয়সা মূল্যমানের পণ্য কম কিনতে হবে। খাদ্যে মূল্যস্ফীতি আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। আগস্টে দেশে খাদ্যে মূল্যস্ফীতি ছিল ১২ দশমিক ৭০ শতাংশ, যা সেপ্টেম্বরে হয়েছে ১৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ। তবে শহরে এই হার ১৪ দশমিক ৬৭ শতাংশ। গ্রামে খাদ্যে মূল্যস্ফীতি ১৩ দশমিক ৩৫ শতাংশ।
সেপ্টেম্বরে খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৮ দশমিক ৭৭ শতাংশ। শুধু শহরের হিসাব ধরলে এই হার ৯ শতাংশ, যা গ্রামে ৮ দশমিক ৬৯ শতাংশ।
মূল্যস্ফীতির হারকে উদ্বেগজনক পর্যায়ে উল্লেখ করে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. আকবর আলি খান আমার দেশকে বলেন, এটা এখন পরিষ্কার হয়ে উঠেছে যে, দেশের অর্থনীতি খারাপ সময়ের দিকেই যাচ্ছে। তিনি বলেন, বর্তমান মূল্য পরিস্থিতি খুবই উদ্বেগজনক। ডলারের মূল্য বাড়াসহ নানা কারণে দ্রব্যমূল্য লাগামহীনভাবে বেড়ে গেছে। এ অবস্থা বজায় থাকলে মূল্য পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে পারে। তিনি বলেন, মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশ অতিক্রম করলেই এর কারণে দ্রব্যমূল্য আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। কিন্তু এখন তা ডাবল ডিজিট ছাড়িয়ে গেছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য, বিশেষ করে খাবারের দাম বেড়ে যাওয়ায় গরিব ও স্থির আয়ের মানুষ অসহায় হয়ে পড়েছেন বলে মন্তব্য করেন ড. আকবর আলি।
পরিসংখ্যান ব্যুরো জানিয়েছে, ২০০৫-২০০৬ অর্থবছরে বিগত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে দেশে গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ৭ শতাংশ। ২০০৭-২০০৮ অর্থবছরে ফখরুদ্দীন ও মইন উদ্দিন সরকারের আমলে তা বেড়ে হয় ৯ দশমিক ৮ শতাংশ। আ’লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতা গ্রহণের এক বছরের মাথায় ২০০৯-১০ অর্থবছরে নিত্যব্যবহার্য পণ্যের ব্যাপক মূল্য বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে মূল্যস্ফীতি।
পরিসংখ্যান বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৭-০৮ অর্থবছরের সার্বিক মূল্যসূচক ছিল ১৯৩ দশমিক ৫৪ শতাংশ। এ সময় মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৯৩ শতাংশ। এ সময় খাদ্য ছাড়া অপরাপর পণ্যের মূল্যস্ফীতি ছিল ৬ দশমিক ৩২ শতাংশ। খাদ্যদ্রব্যের মূল্য ভয়াবহভাবে বাড়ার কারণে খাদ্যে মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়ায় ১২ দশমিক ২৮ শতাংশে। তখন গ্রামাঞ্চলে ৯ দশমিক ৯৯ শতাংশ মূল্যস্ফীতির বিপরীতে শহরে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৮৪ শতাংশ।
২০০৮-০৯ অর্থবছরে বিশ্ববাজারে পণ্যসামগ্রী বিশেষ করে খাদ্যদ্রব্যের মূল্য কমে গেলে দেশের মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমে আসে। ফলে মহাজোট সরকারের প্রথম বছরে মূল্যস্ফীতি নেমে দাঁড়ায় ৬ দশমিক ৬৬ শতাংশে। এ সময় খাদ্যবহির্ভূত পণ্যে ৫ দশমিক ৪৫ শতাংশ মূল্যস্ফীতির বিপরীতে খাদ্যদ্রব্যে স্ফীতি ছিল ৮ দশমিক ৫৩ শতাংশ। এ সময়ে শহরাঞ্চল ও গ্রামে মূল্যস্ফীতি ছিল যথাক্রমে ৬ দশমিক ২৪ ও ৬ দশমিক ৮৩ শতাংশ। গ্রামাঞ্চলে খাদ্যদ্রব্যে মূল্যস্ফীতি ছিল ৭ দশমিক ০৯ শতাংশ।
মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার ১ বছরের মাথায় ২০০৯-১০ অর্থবছরে নিত্যব্যবহার্য পণ্যের ব্যাপক মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে মূল্যস্ফীতি। ২০১০-এর জানুয়ারি মাসে মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়ায় ৮ দশমিক ৯৯ শতাংশ। খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের দাম ৬ দশমিক ৫৩ শতাংশ বাড়লেও তখন খাদ্যদ্রব্যের দাম বাড়ে ১০ দশমিক ৫৬ শতাংশ।
খাদ্যদ্রব্যের মূল্য ভয়াবহভাবে বেড়ে যাওয়ায় গত অর্থবছরের শেষের দিকে খাদ্যের মূল্যস্ফীতি সাড়ে ১৪ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। এ সময় সার্বিক মূল্যসূচকও ১০ শতাংশ অতিক্রম করে। এরপর থেকে টানা ৭ মাস ধরে মূল্যস্ফীতি দুই অঙ্কের ঘরে অবস্থান করছে।
দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন সহযোগী সংস্থা বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে আসছে। সরকারের ঊর্ধ্বতন দায়িত্বশীল ব্যক্তিরাও এ ব্যাপারে বিভিন্ন কথা বলে আসছেন। চলতি অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত মূল্যস্ফীতিকে অর্থনীতির প্রধান সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে এটি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সঙ্কোচনমূলক মুদ্রানীতিসহ নানা উদ্যোগের কথা বলেছিলেন। মূল্যস্ফীতির কারণে কৃচ্ছ্রতাসাধনের পরামর্শও দিয়েছিলেন তিনি। পরে পণ্যমূল্য বেড়ে যাওয়ায় একদিন বাজারে না যাওয়ার জন্যও জনসাধারণকে পরামর্শ দিয়েছিলেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত।

No comments

Powered by Blogger.