ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের আমরণ অনশন গতকালও সূচক পড়েছে ১৮১ পয়েন্ট

শেয়ারবাজারে অব্যাহত ধসে নিঃস্ব বিনিয়োগকারীরা গতকাল থেকে আমরণ অনশন শুরু করেছেন। এ কর্মসূচিতে বিএনপি, জাতীয় পার্টিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা সংহতি প্রকাশ করেছেন। প্রায় ১০ মাস ধরে শেয়ারবাজারে একের পর এক দরপতনের কারণে পুঁজি হারিয়ে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা বিভিন্ন সময় আন্দোলন করলেও প্রথমবারের মতো দেশের রাজনৈতিক দলগুলো তাদের সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করেছে। এর মাধ্যমে বিনিয়োগকারীদের আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে।


আন্দোলন কর্মসূচির সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে সাবেক রাষ্ট্রপতি জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বলেন, শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির জন্য যারা দায়ী তাদের সবাই চেনেন। তাদের শাস্তি দিন। বিএনপির পক্ষে একাত্মতা ঘোষণা করে সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী ড. আবদুল মঈন খান বলেন, আগামীতে বিএনপি ক্ষমতায় এলে শেয়ারবাজারের প্রত্যেক ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীর ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা নেয়া হবে। এদিকে গতকাল সপ্তাহের প্রথম দিনে দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সাধারণ সূচকের পতন হয়েছে ১৮১ পয়েন্টের।
বিনিয়োগকারীরা জানিয়েছেন, শেয়ারবাজার নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে সুস্পষ্ট ঘোষণা না আসা পর্যন্ত তারা আন্দালন কর্মসূচি চালিয়ে যাবেন। দাবি না মানা পর্যন্ত তারা ঘরে ফিরে যাবেন না। রাত ৯টায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত বিনিয়োগকারীরা ডিএসই ভবনের সামনের রাস্তায় অবস্থান নিয়ে অনশন করছিলেন। বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের সভাপতি মিজানুর রশীদ চৌধুরী জানান, আমাদের আর হারানোর কিছু নেই। পুঁজি হারিয়ে এখন আমরা সর্বস্বান্ত। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত বিনিয়োগকারীরা তাদের কর্মসূচি চালিয়ে যাবেন।
ঐক্য পরিষদের সাংগঠনিক সম্পাদক এ কে শাহাদাত হোসেন ফিরোজ রাত সোয়া ৯টার দিকে জানান, কর্মসূচি অব্যাহত রয়েছে। দাবি না আদায় হওয়া পর্যন্ত তা চলবে। তিনি আরও বলেন, রাজনৈতিক ও পেশাজীবী সংগঠনের নেতারা আমাদের আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করছেন। সারা রাত বিনিয়োগকারীরা ডিএসই ভবনের সামনে অবস্থান নিয়ে অনশন করবেন বলেও জানান তিনি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, পূর্বঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী গতকাল সকাল ১১টা থেকে মতিঝিলে ডিএসই ভবনের সামনে আমরণ অনশন শুরু করেন বিনিয়োগকারীরা। বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের ব্যানারে কয়েকশ’ বিনিয়োগকারী এতে যোগ দেন। মাথায় সাদা কাপড় বেঁধে তারা বিভিন্ন স্লোগান দিয়ে ডিএসই সামনের রাস্তায় অবস্থান নেন। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিনিয়োগকারীদের উপস্থিতিও বাড়তে থাকে। শেয়ারবাজারে লেনদেন শুরুর পর থেকে সূচকের অব্যাহত পতনে বিনিয়োগকারীর উপস্থিতি বাড়তে তাকে। এরমধ্যে বেলা ১টার দিকে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সংহতি প্রকাশ করতে আসছেন—এমন ঘোষণায় আন্দোলনকারীর সংখ্যা আরও বেড়ে যায়। বেলা ১টা ৫০ মিনিটে ডিএসই ভবনের সামনে আসেন এরশাদ। এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী জাফর আহমদ ও মহাসচিব রুহুল আমিন হাওলাদার। ২টা ০৫ মিনিটে এরশাদ চলে যান। এরপর বেলা ৩টার দিকে আসেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী ড. আবদুল মঈন খান। এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব আবদুস সালাম। বেলা ৫টায় জেএসডি সভাপতি আসম আবদুর রব অনশনস্থলে এসে সংহতি জানান। সন্ধ্যায় সংহতি জানাতে আসেন এলডিপির যুগ্ম সাধারণ সম্পদাক শাহাদাত হোসেন সেলিম, লেবার পার্টির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ডা. মোস্তাফিজুর রহমান ইরান। এছাড়া বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থ টেলিফোনে সংহতি জানিয়েছেন বলে অনশনকারীরা জানান।
এদিকে লেনদেন শুরুর পর বেলা দেড়টার দিকে ডিএসই’র সাধারণ সূচক ১৫০ পয়েন্টের বেশি পড়ে গেলে বিপুলসংখ্যক বিনিয়োগকারী বিভিন্ন ব্রোকারেজ হাউস থেকে নেমে অনশনস্থলে সমবেত হন। এ সময় বিনিয়োগকারীদের একটি গ্রুপ বিভিন্ন ব্রোকারেজ হাউস ও মার্চেন্ট ব্যাংকে গিয়ে অন্যদের অনশন কর্মসূচিতে সমবেত হওয়ার আহ্বান জানান। বেলা ২টার মধ্যে ডিএসই’র সামনে দুই হাজারেরও বেশি বিনিয়োগকারী সমবেত হন। বিকাল তিনটায় দিনের লেনদেন শেষ হলেও এই সংখ্যা আরও বাড়ে।
সংহতি বক্তব্যে ড. মঈন খান বলেন, আগামীতে বিএনপি ক্ষমতায় গেলে ক্ষতিগ্রস্ত প্রত্যেক বিনিয়োগকারীকে ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে। আন্দোলনকারী বিনিয়োগকারীদের নামে দায়ের সব মামলা প্রত্যাহার করা হবে। পাশাপাশি তাদের ওপর পুলিশি নির্যাতন ও জুলুমের বিচার করা হবে। আমরা ৩৩ লাখ বিনিয়োগকারীর পক্ষে আছি এবং থাকব।
তিনি বলেন, শেয়ারবাজার নিয়ে আগেই সরকারকে সতর্ক করেছিলাম। ১৯৯৬ সালে শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির কারণে আমরা এবার অর্থমন্ত্রী এবং এসইসিকে সতর্ক থাকার জন্য বলেছিলাম। কিন্তু এবারও শেয়ারবাজার থেকে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের অর্থ লুট করা হয়েছে। ৮৫ হাজার কোটি টাকা শেয়ারবাজার থেকে লুট করা হয়েছে বলে জানান তিনি। তিনি বলেন, বিএনপি সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি আন্দোলনে বিশ্বাসী দল। বিএনপি জনগণের দল। জনগণ যদি সুযোগ দেয়, তাহলে বিএনপি আগামীতে ক্ষমতায় এসে প্রথমেই শক্তিশালী পুঁজিবাজার গঠনের মাধ্যমে বিধ্বস্ত অর্থনীতি পুনরুদ্ধার করবে।
মঈন খান আরও বলেন, শেয়ারবাজারে কারসাজি তদন্তে কমিটি গঠন করা হলেও অর্থমন্ত্রী বলেছেন, দোষীদের নাম প্রকাশ করা যাবে না। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন নজির নেই যে, প্রকৃত দোষীদের নাম প্রকাশ করা যাবে না। বিনিয়োগকারীরা তাদের সঞ্চয় নিয়ে শেয়ারবাজারে এসেছেন। এজন্য বিনিয়োগকারীদের শ্রদ্ধা করা উচিত। কিন্তু সরকার শ্রদ্ধা না করে উল্টো তাদের ফাটকাবাজ নামে অভিহিত করছে।
জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বলেন, শেয়ারবাজারে ভয়াবহ ধসের কারণে বিনিয়োগকারীরা নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছেন। এটা কারও কাম্য নয়। কারসাজিতে জড়িতদের সবাই চেনেন। তাদের অবশ্যই শাস্তি দিতে হবে। প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ করে এরশাদ বলেন, আপনি একজন মা হিসেবে বিনিয়োগকারীদের পাশে এসে দাঁড়ান। তাদের দুঃখ-দুর্দশা দূর করার চেষ্টা করুন। তাদের চোখের পানি মুছে দিন।
বিনিয়োগকারীদের বিরুদ্ধে দায়ের মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে এরশাদ বলেন, সর্বস্ব হারিয়ে এরা জীবন রক্ষার জন্য আন্দোলন করছে। এদের বিরুদ্ধে পুলিশ যেসব ব্যবস্থা নিয়েছে, তা অন্যায় হয়েছে। এরশাদ নিজেকে দেশের প্রবীণ রাজনীতিবিদ হিসেবে উল্লেখ করে বিনিয়োগকারীদের উদ্দেশে বলেন, শেয়ারবাজার বিষয়ে আমি আপনাদের দায়িত্ব নিলাম। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব। আপনারা অনশন করে মৃত্যুর দিকে ধাবিত হবেন না। এ সঙ্কট অবশ্যই দূর হবে।
জেএসডি সভাপতি আ.স.ম. আবদুর রব বলেন, সরকারের অদক্ষতা, অযোগ্যতা ও দায়িত্বহীনতার কারণে শেয়ারবাজারে ধস নেমেছে। অর্থমন্ত্রী বলেছেন যারা শেয়ারবাজার কারসাজির সঙ্গে জড়িত, তাদের নাম বলতে পারবেন না। তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষমতা না থাকার জন্যই অর্থমন্ত্রী এ কথা বলেছিলেন। যারা শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত, তারা প্রধানমন্ত্রীর চতুর্দিকে রয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে কোনো কিছুই করা যাচ্ছে না। আ.স.ম. রব বলেন, বিনিয়োগকারীদের আন্দোলন-সংগ্রামের প্রতি আমাদের সমর্থন রয়েছে। বিনিয়োগকারীদের দাবি পূরণ না করে পুলিশ বাহিনী বা ডাণ্ডাবেড়ি দিয়ে আন্দোলন দমানোর চেষ্টা করা হলে তা সারাদেশে ছড়িয়ে পড়বে। তিনি বলেন, শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারীদের জন্য সরকারের দায়িত্ব রয়েছে। কিন্তু সরকার দায়িত্বহীন আচরণ করেছে।
বেলা ১টার দিকে বিনিয়োগকারীদের অনশন কর্মসূচিতে সর্বপ্রথম সংহতি জানায় বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)। পার্টির পক্ষে প্রেসিডিয়াম সদস্য সাজ্জাদ জহির চন্দন বিনিয়োগকারীদের উদ্দেশে বলেন, কর্মসংস্থানের বিকল্প কোনো পথ না পেয়ে নিজেদের শেষ সম্বলটুকু নিয়ে অনেকেই শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করেছিলেন। লুটেরাচক্রের সীমাহীন লুটপাটের কারণে তারা আজ নিঃস্ব হয়ে গেছেন। অথচ এই লুটপাটকারীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। কারণ এরা সব সময় ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে আঁতাত করে চলে।
এদিকে অনশন কর্মসূচি থেকে ১৪ দফা দাবি সংবলিত লিফলেট বিতরণ করেন বিনিয়োগকারীরা। তাদের দাবির মধ্যে রয়েছে—অপ্রদর্শিত অর্থ পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করতে এনবিআর, দুদক ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সমন্বয়ের ভিত্তিতে প্রজ্ঞাপন জারি, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঞ্চিত (রিজার্ভ) অর্থের ৮০ শতাংশ শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ, মিউচুয়াল ফান্ডগুলোকে শেয়ারবাজারে সক্রিয় করা, শেয়ারবাজার থেকে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অর্জিত মুনাফা পুনঃবিনিয়োগ, আমানতের ১৫ শতাংশ শেয়ারে বিনিয়োগের সুযোগ প্রদান, জীবন বীমার ৪০ শতাংশ শেয়ারে বিনিয়োগ, মার্জিন ঋণের সুদ মওকুফ, উদ্যোক্তাদের শেয়ার বিক্রিতে দু’বছরের নিষেধাজ্ঞা (লকইন) আরোপ, প্রত্যেক ব্রোকারেজ হাউসকে কমপক্ষে ৫ কোটি টাকা বিনিয়োগ, তদন্ত প্রতিবেদনে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের শাস্তি হিসেবে বাজারে বিনিয়োগে বাধ্য করা এবং আন্দোলনে অংশ নেয়া বিনিয়োগকারীদের নামে দায়ের করা মামলা প্রত্যাহার।
এদিকে দিনশেষে ডিএসইতে সাধারণ সূচক ১৮১ পয়েন্ট কমে ৫ হাজার ৩৮৭ পয়েন্টে দাঁড়ায়। ডিএসইতে মোট আর্থিক লেনদেন হয়েছে ২৫৮ কোটি ৫৯ লাখ ৯১ হাজার টাকা। ২৬৩টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১১টির দর বেড়েছে, কমেছে ২৫০টির এবং অপরিবর্তিত রয়েছে দুটি প্রতিষ্ঠানের দর। অন্যদিকে সিএসইতে ২৬৫ পয়েন্ট কমে ৯ হাজার ৬৮৯ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে। মোট আর্থিক লেনদেন হয়েছে ৪৫ কোটি ৮ লাখ টাকা। ১৭৭টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে দর বেড়েছে ৫টির, কমেছে ১৭১টির এবং অপরিবর্তিত ছিল একটি প্রতিষ্ঠানের দর।

   

No comments

Powered by Blogger.