কেরানীগঞ্জে কারখানার বিষাক্ত গ্যাসে অসুস্থ অর্ধশতাধিক

ঢাকার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের হাসনাবাদ এলাকার একটি রাসায়নিক কারখানা থেকে ক্লোরিন গ্যাস নিঃসরণে ফায়ার সার্ভিসের কর্মী ও কারখানার শ্রমিকসহ অর্ধশতাধিক ব্যক্তি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। অসুস্থদের উদ্ধার করে স্থানীয় ক্লিনিক, মিটফোর্ড হাসপাতালসহ ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। গতকাল রবিবার সকাল সাড়ে ৮টায় হাসনাবাদ এলাকায় গ্লোবাল হ্যাভি কেমিক্যাল লিমিটেডের কারখানায় এ দুর্ঘটনা ঘটে।ফায়ার সার্ভিস, থানা পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, রবিবার সকালে গ্লোবাল হ্যাভি কেমিক্যালের শ্রমিকরা কাজের উদ্দেশ্যে কারখানায় সংরক্ষিত ক্লোরিন গ্যাস পাইপে সংযোগ দিতে যান।


এ সময় ওই গ্যাস পাইপের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে মুহূর্তের মধ্যে কারখানা ও আশপাশে বিষক্রিয়া ছড়িয়ে পড়লে কারখানার শ্রমিক, পথচারী ও এলাকাবাসীর অনেকেই অচেতন হয়ে পড়ে। খবর পেয়ে পোস্তগোলা ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা দ্রুত ঘটনাস্থলে পেঁৗছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য কারখানার ভেতর প্রবেশ করলে তাঁরাও জ্ঞান হারান। এ খবর ফায়ার সার্ভিস সদর দপ্তরে পেঁৗছলে সেখান থেকে একটি অভিজ্ঞ টিম ঘটনাস্থলে এসে স্থানীয়দের সহযোগিতায় বিচ্ছিন্ন গ্যাসের পাইপে
সংযোগ দিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। এ ঘটনায় এলাকাবাসীর মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। আশপাশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দ্রুত ছুটি ঘোষণা করা হয়।
গতকাল দুপুরে মিটফোর্ড হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, মেডিসিন বিভাগের মেঝেতে শুয়ে আছে অনেকে। মিটফোর্ড হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে ১৭ জনকে। তাদের মধ্যে ৯ জনই ফায়ার সার্ভিসের কর্মী।
ফায়ার সার্ভিস কর্মী মো. শাহজাহান বলেন, 'আদেশ পেয়ে আমরা গাড়ি নিয়ে কারখানার ভেতরে চলে যাই। কিন্তু গাড়ি থেকে নামার সঙ্গে সঙ্গেই কাশি ও বমি শুরু হয়ে যায়। আমরা বের হওয়ার জন্য দৌড়াতে শুরু করার কিছুক্ষণের মধ্যে জ্ঞান হারিয়ে ফেলি।' ওই কারখানার পাশের বাসায় থাকেন একটি প্রসাধনী প্রস্তুতকারী কম্পানির ডেলিভারি ম্যানেজার বাহাদুর হাওলাদার। তিনি বলেন, 'লোকজনের হৈচৈ শুনে বাইরে আসি। কিছুক্ষণের মধ্যেই বুকে ব্যথা করতে থাকে। একপর্যায়ে ঢলে পড়ি। লোকজন হাসপাতালে নিয়ে আসে।' ওই কারখানার পাশের আরেকটি বাড়ির একই পরিবারের পাঁচজন বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মিটফোর্ড হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। তাদের একজন নাহিদা বলেন, 'দেখলাম সবুজ ঘাসগুলো মুহূর্তের মধ্যে হলুদ হয়ে গেল। একটু পর বুকে ব্যথা শুরু হয় হলো। কাশতে লাগলাম। এরপর আর কিছু মনে নেই।'
আক্রান্তদের মধ্যে ১৯ জনকে ভর্তি করা হয়েছে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। এর মধ্যে রয়েছেন ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক মনির হোসেন, পোস্তগোলার স্টেশন অফিসার আবদুস সালাম, ফায়ারম্যান আল আমিন, আক্তার হোসেন। স্টেশন অফিসার আবদুস সালাম বলেন, 'গ্যাসের পাইপ বিস্ফোরণ ঘটেছে বলে আমাদের ইনফর্ম করা হয়েছে। আমরা সেভাবেই প্রস্তুতি নিয়ে গিয়েছি। সেখানে গিয়ে দেখি এই অবস্থা। আমি গ্যাসের পাইপের সুইচ অফ করেছি। এর মধ্যেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। পরে এই হাসপাতালে।' তিনি বলেন, পাইপ ফেটে যাওয়ার পর কারখানার লোকেরাই সুইচটা বন্ধ করে দিতে পারত। কিন্তু তারা তা করেনি। ওই কারখানার যথাযথ ব্যবস্থা ছিল না জানিয়ে তিনি বলেন, কারখানাটি যেহেতু রাসায়নিক। তাই এ ধরনের ঘটনার জন্য পূর্বপ্রস্তুতি রাখা দরকার ছিল। ওই কারখানায় তা ছিল না।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের মেডিসিন বিভাগে কর্তব্যরত চিকিৎসকরা জানান, আহতরা সবাই ক্লোরিন গ্যাসের বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে। চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। বেশির ভাগের অবস্থা উন্নতির দিকে।
এলাকা থেকে কেমিক্যাল কারখানাটি অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল করে এলাকাবাসী। পরে র‌্যাব-১০, ফায়ার সার্ভিসের কর্মী, দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার ওসি (প্রশাসন) মো. শাখাওয়াত হোসেন কারখানা অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার আশ্বাস দিলে বিক্ষোভকারীরা শান্ত হয়।
স্থানীয়রা জানায়, বছর দু-এক আগেও এ কারখানায় এ ধরনের দুর্ঘটনা ঘটেছিল। তখন থেকেই কারখানাটি অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার দাবি এলাকাবাসীর। তাদের ধারণা, অদক্ষ শ্রমিক দিয়ে কারখানা পরিচালনার কারণেই বারবার এ ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে যাচ্ছে। স্থানীয়রা আরো জানায়, এলাকার কিছু প্রভাবশালী ও ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতাদের ম্যানেজ করে মালিকরা এ কারখানাটি চালিয়ে আসছেন।
দুর্ঘটনার ব্যাপারে কথা বলতে গেলে কারখানার ইলেকট্রিশিয়ান রফিক ও প্রসেস অপারেটর হুমায়ুন কবির ছাড়া অন্য কোনো প্রশাসনিক কর্মকর্তাকে পাওয়া যায়নি। উপস্থিত দুজন জানান, এই কারখানায় বি্লচিং পাউডার, ক্লোরিন, কস্টিক সোডা ও ক্যাপসুল তৈরির খোসা তৈরি করা হয়। সকালে ক্লোরিন গ্যাসের হুস পাইপের সংযোগ দেওয়ার সময় তা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে এ দুর্ঘটনা ঘটে। এ ব্যাপারে ফায়ার সার্ভিস সদর দপ্তরের উপপরিচালক শেখ মো. মিজানুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমরা সকাল ৮টা ৫০ মিনিটে খবর পাই, এ কারখানায় গ্যাস লিকেজ হয়েছে। এ সংবাদের ভিত্তিতে আমাদের পোস্তগোলা স্টেশনের ১০ জন কর্মী কারখানার ভেতর প্রবেশ করেন। ক্লোরিন গ্যাসের কথা কারখানার লোকজন প্রথমে না বলায় তাঁরা ভেতরে ডুকতেই অসুস্থ হয়ে পড়েন। ক্লোরিন গ্যাস অত্যন্ত বিষাক্ত। তাঁদের এই অসত্য তথ্যের জন্য প্রাণহানির ঘটনাও ঘটতে পারত।

No comments

Powered by Blogger.