আমরণ অনশনে রাজনীতির হাওয়া

শেয়ারবাজারে অব্যাহত দরপতনের প্রতিবাদে এবার বিনিয়োগকারীরা আমরণ অনশন কর্মসূচিতে নেমেছেন। গতকাল রবিবার কর্মসূচির প্রথম দিনেই তাতে লেগেছে রাজনৈতিক হাওয়া। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি, ক্ষমতাসীন মহাজোটের শরিক দল জাতীয় পার্টিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কেন্দ্রীয় নেতারা বিনিয়োগকারীদের ডাকা আমরণ কর্মসূচির সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করেছেন।পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের সভাপতি মিজান রশীদ চৌধুরী অনশন কর্মসূচি শুরু করে বলেছেন, প্রয়োজনে তাঁরা গায়ে পেট্রল ঢেলে আত্মাহুতি দিতেও দ্বিধা করবেন না।


অব্যাহত দরপতনে পুঁজি হারিয়ে বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের ব্যানারে ১৪ দফা দাবিতে এ অনশন কর্মসূচিতে নেমেছেন। রাজধানীর মতিঝিলে ঢাকা স্টক এঙ্চেঞ্জ (ডিএসই) ভবনের সামনে কর্মসূচি চলছে। এতে প্রথম দিনেই চারজন বিনিয়োগকারী অসুস্থ হয়ে পড়েন। দেশের অন্যান্য শহরেও একই কর্মসূচি শুরু হয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে।
গতকাল বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার পক্ষে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. মঈন খান, সাবেক রাষ্ট্রপতি ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জেএসডি) সভাপতি আ স ম আবদুর রব, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) প্রেসিডিয়াম সদস্য সাজ্জাদ জহির চন্দন এবং দৈনিক শেয়ারবিজ পত্রিকার সম্পাদক মনজুর সাদেক খোশনবিশসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা সশরীরে উপস্থিত থেকে বিনিয়োগকারীদের কর্মসূচির প্রতি সংহতি প্রকাশ করেন। নেতারা শেয়ারবাজারের লুটপাটকারীদের বিচারের দাবি করেন। একইসঙ্গে বাজার স্থিতিশীল করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপ দাবি করেন। বিনিয়োগকারীদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ারও প্রতিশ্রুতি দেন তাঁরা।
আগের দুই কার্যদিবস ঊর্ধ্বমুখী থাকার পর রবিবার আবারও পতনের ধারায় ফিরেছে শেয়ারবাজার। নানা ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণের ঘোষণা দেওয়ায় গত সপ্তাহের শেষ দুই দিন টানা দরপতন থেকে বেরিয়ে আসে শেয়ারবাজার। কিন্তু গতকাল সপ্তাহের প্রথম কার্যদিবস লেনদেনের শুরুতেই দরপতন ঘটে শেয়ারবাজারে। প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এঙ্চেঞ্জের (ডিএসই) সাধারণ মূল্যসূচক আগের দিনের ৫৫৬৮.৩৫ পয়েন্ট থেকে ১৫ মিনিটের মধ্যে ৪০ পয়েন্ট কমে যায়। পরের ১০ মিনিটে আবার ৪২ পয়েন্ট বৃদ্ধি পেয়ে আগের অবস্থানে চলে যায়। এরপর শুরু হয় টানা দরপতন। অধিকাংশ কম্পানি দর হারাতে থাকে। দিনের শেষে আগের দিনের তুলনায় ১৮১ পয়েন্টের পতন হয়ে ৫৩৮৭ পয়েন্টে স্থির হয় ডিএসইর সূচক।
পূর্বঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী গতকাল রবিবার সকাল ১১টা থেকে মতিঝিলে ডিএসই ভবনের সামনে আমরণ অনশন শুরু করেন বিনিয়োগকারীরা। প্রথম দিকে মাথায় সাদা কাপড় বেঁধে কয়েকজন বিনিয়োগকারী এ কর্মসূচি শুরু করেন। বেলা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে অনশনে অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। দুপুর ১টা থেকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা অনশন কর্মসূচির সঙ্গে সংহতি জানাতে সেখানে আসতে শুরু করেন।
দুপুর দেড়টার দিকে সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ অনশনস্থলে হাজির হন। ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করে এরশাদ বলেন, 'শেয়ারবাজারের ব্যাপারে আমি আপনাদের দায়িত্ব নিলাম। আপনারা অনশন করে মৃত্যুর দিকে ধাবিত হবেন না। এ সংকট অবশ্যই দূর হবে। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব।' এরশাদ বলেন, 'অনেক আগেই আমি শেয়ারবাজার ঠিক করার জন্য সংসদে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রীকে আহ্বান জানিয়েছিলাম। কারণ শেয়ারবাজারে ধসের কারণে আমরা এক কোটি ভোটার হারিয়েছি। তাঁদের ফিরিয়ে আনতে হবে।'
প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ করে এরশাদ বলেন, 'আপনি একজন মা হিসেবে বিনিয়োগকারীদের পাশে এসে দাঁড়ান। তাঁদের দুঃখ-দুর্দশা দূর করার চেষ্টা করুন। তাঁদের চোখের পানি মুছে দিন।'
সাবেক রাষ্ট্রপতি বলেন, শেয়ারবাজার লুটকারীদের খুঁজে বের করার দরকার নেই। তাঁদের সবাই চেনে। লুটপাটকারীদের শাস্তি দিতে হবে। এরশাদ বলেন, ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা সর্বস্ব হারিয়ে আন্দোলনে নেমেছেন। এখন তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হচ্ছে। তিনি বিনিয়োগকারীদের নামে দায়ের করা মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানান। এরশাদ বিনিয়োগকারীদের অনশন ভঙ্গের আহ্বান জানান।
এরশাদ চলে যাওয়ার আধঘণ্টা পর বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সাবেক মন্ত্রী ড. মঈন খান আসেন মঞ্চে। তিনি বলেন, 'বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার পক্ষ থেকে এসেছি বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করার জন্য।'
মঈন খান বলেন, 'শেয়ারবাজারে এই পরিস্থিতি সৃষ্টির আগেই ১৯৯৬ সালের ঘটনা উল্লেখ করে আমরা অর্থমন্ত্রী ও এসইসির চেয়ারম্যানকে সতর্ক করেছিলাম। কিন্তু তার পরও শেয়ারবাজার থেকে লুট হলো।' তিনি বলেন, যাঁরা স্ত্রীর অলংকার বিক্রি করে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করেছেন, তাঁদের ফটকাবাজ উপহাস করা হয়েছে। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিনিয়োগ থেকে বড় বড় বিনিয়োগ গড়ে ওঠে। তাঁদের জমানো টাকার ওপর এ শেয়ারবাজার। এখান থেকে কারসাজি করে ৭৫ হাজার কোটি টাকা গায়েব করা হয়েছে। ড. মঈন বলেন, 'তদন্ত রিপোর্ট হলো। অর্থমন্ত্রী বললেন, যাদের নাম এসেছে তাদের নাম প্রকাশ করা যাবে না। যারা শেয়ারবাজার লুট করে অর্থনীতি পঙ্গু করে দিল তাদের কিছু বলা হবে না_এটা কেমন কথা?' ৩৩ লাখ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীর পাশে অবস্থান নেওয়ার আশ্বাস দিয়ে ড. মঈন বলেন, বিএনপি ক্ষমতায় যেতে পারলে শেয়ারবাজার লুটকারীদের বিচার করবে। প্রতিটি ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীকে ক্ষতিপূরণ দেবে। বিনিয়োগকারীদের বিরুদ্ধে যারা মামলা দিয়েছে তাদের বিচার করা হবে।
ড. মঈন খানের বিদায়ের প্রায় দেড় ঘণ্টা পর বিকেল ৪টার দিকে জেএসডি নেতা আ স ম আব্দুর রব বিনিয়োগকারীদের মাঝে আসেন। তিনি বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে বলেন, এখনো যদি শেয়ারবাজার ঠিক করা না হয় তবে এর প্রভাব জেলা থেকে উপজেলা পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়বে। তখন কিছু করার থাকবে না। সাবেক এই মন্ত্রী বলেন, মাছের পচন ধরে মাথায়। সরকারের পচন ধরেছে মাথায়। আওয়ামী লীগ দিন বদলের কথা বলে ক্ষমতায় এসেছে। কিন্তু দিন বদলের মানে যদি পঙ্গু অর্থনীতি, শেয়ারবাজার লুট, আইনশৃঙ্খলার অবনতি হয়; তবে সেই দিন বদলের দরকার নেই।
আব্দুর রব আরো বলেন, 'অর্থমন্ত্রী শেয়ারবাজার কারসাজির সঙ্গে জড়িতদের চেনেন বলে জানিয়েছেন। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে কিছু করতে পারছেন না। তাহলে কেন তিনি চেয়ারে বসে রয়েছেন?' তিনি বিনিয়োগকারীদের উদ্দেশে বলেন, 'আপনারা অনশন করে যান। আমি আপনাদের সঙ্গে আছি। আপনাদের বিরুদ্ধে মামলা করলে আমিও আসামি হব।'
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) প্রেসিডিয়াম সদস্য সাজ্জাদ জহির চন্দন ডিএসই ভবনের সামনে অবস্থানরত বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেন। তিনি শেয়ারবাজার স্থিতিশীল করতে ব্যর্থ হওয়ায় সরকারের সমালোচনা করেন।
দৈনিক শেয়ারবিজ পত্রিকার সম্পাদক মনজুর সাদেক খোশনবিশ ডিএসই ভবনের সামনে এসে অনশনকারীদের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেন।
পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের সভাপতি মিজান রশীদ চৌধুরী অনশন কর্মসূচি শুরু করে বলেন, 'মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনার কথা মন্ত্রীরা শোনেন কি না তা নিয়ে সন্দেহ দেখা দিয়েছে। আপনি অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়ার কথা বলেছিলেন। অর্থমন্ত্রী সেটা দিয়েছেন। কিন্তু ভয় ঢুকিয়ে দিয়েছেন, যাতে কেউ সে অর্থ শেয়ারবাজারে না বিনিয়োগ করেন।' তিনি বলেন 'এখন প্রশ্ন দেখা দিয়েছে_কে বড়, প্রধানমন্ত্রী না অর্থমন্ত্রী?' তিনি আরো বলেন, 'আমরা আমরণ অনশন কর্মসূচি শুরু করেছি। প্রয়োজনে শরীরে পেট্রল ঢেলে আত্মাহুতি দেব।' তিনি বলেন, 'শেয়ারবাজারের স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার বড় বাধা বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ। আমরা এ দেশের অর্থনীতিকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশা আল্লাহ।'
এদিকে রাত সাড়ে ৮টায় এ প্রতিবেদন লেখার সময় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ডিএসইর সামনে অনশনরত বিনিয়োগকারীদের মধ্যে চারজন গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাঁরা হলেন বিনিয়োগকারী রুবেল, কবির, জাহাঙ্গীর আলম ও ফয়সাল। তাঁদের প্রাথমিক চিকিৎসা হিসেবে স্যালাইন দিয়ে রাখা হয়েছে। এ প্রতিবেদন লেখার সময়ও অনশন চলছিল।
১৪ দফা দাবি : গতকাল অনশন কর্মসূচি থেকে ১৪ দফা দাবিসংবলিত লিফলেট বিতরণ করেন বিনিয়োগকারীরা। দাবির মধ্যে রয়েছে অপ্রদর্শিত অর্থ পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করতে এনবিআর, দুদক ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সমন্বয়ের ভিত্তিতে প্রজ্ঞাপন জারি, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঞ্চিত (রিজার্ভ) অর্থের ৮০ শতাংশ শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ, মিউচ্যুয়াল ফান্ডগুলোকে শেয়ারবাজারে সক্রিয় করা, শেয়ারবাজার থেকে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অর্জিত মুনাফা পুনর্বিনিয়োগ, আমানতের ১৫ শতাংশ শেয়ারে বিনিয়োগের সুযোগ প্রদান, জীবন বীমার ৪০ শতাংশ শেয়ারে বিনিয়োগ, মার্জিন ঋণের সুদ মওকুফ, উদ্যোক্তাদের শেয়ার বিক্রিতে দুই বছরের নিষেধাজ্ঞা (লক-ইন) আরোপ, প্রতিটি ব্রোকারেজ হাউসকে কমপক্ষে পাঁচ কোটি টাকা বিনিয়োগ, তদন্ত প্রতিবেদনে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের শাস্তি হিসেবে বাজারে বিনিয়োগে বাধ্য করা এবং আন্দোলনে অংশ নেওয়া বিনিয়োগকারীদের নামে দায়ের করা মামলা প্রত্যাহার।

No comments

Powered by Blogger.