আত্মজীবনী-নিউ ইয়র্ক শহরটাকে এভাবে কখনো দেখিনি

বেশির ভাগ বিশ্লেষণে তিনিই গত শতকের সেরা ক্রীড়াবিদ। বাংলাদেশের মানুষের কাছেও মোহাম্মদ আলীর আবেদন অন্য রকম। নিজের উত্থান-পতন, লড়াই-সংগ্রামের গল্প আলী শুনিয়েছেন 'দ্য গ্রেটেস্ট মাই ওন স্টোরি' বইয়ে। কালের কণ্ঠ পাঠকদের জন্য সেটার অনুবাদ ছাপা হচ্ছে প্রতি সোমবার১৯৭১ সালের ৮ মার্চ নিউ ইয়র্কের ম্যাডিসন স্কোয়ার গার্ডেনে হবে জো ফ্রেজিয়ারের সঙ্গে আমার বহুল আলোচিত লড়াই। আয়োজকরা আমায় বলেছিল ম্যাচের ১০ দিন আগে নিউ ইয়র্কে চলে আসতে। কিন্তু আসার পর সারাক্ষণ দেখি মানুষ আর মানুষ, হোটেলের লবিতে পা ফেলা দায়।


তাই দিন সাতেকের জন্য উড়াল দিলাম মায়ামিতে, ফিরে এলাম ওজন মাপার দিনে। এসে যা দেখলাম, নিউ ইয়র্ক শহরটাকে এভাবে কখনো দেখিনি।পুরো ম্যাডিসন স্কোয়ার ঘিরে রেখেছে পুলিশ আর নিজস্ব নিরাপত্তাকর্মীরা। যারা টিকিট পায়নি তারা বাইরে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে, উঁকি-ঝুঁকি মারছে। এমন সময় আয়োজকদের তরফ থেকে বলা হলো, নিরাপত্তার খাতিরেই আমাকে হোটেলে নেওয়া যাবে না। অথচ লড়াইতে নামার আগে চার-পাঁচ ঘণ্টা ঘুমানো আমার পুরনো অভ্যাস, এভাবেই স্নায়ুর চাপটা সরিয়ে মনোযোগটা শুধুই রিংয়ের ভেতর নিয়ে আসি। তখন আমাকে দেখিয়ে দেওয়া হলো ছোট্ট একটি রুম, সেখানে একটা ছোট্ট চৌকি পাতা। আমার পক্ষে চৌকিতে ঘুমানো সম্ভব নয়, তাই ড্রেসিংরুমে যাওয়ার আগ পর্যন্ত জেগেই ছিলাম। সময় হলেই চলে গেলাম ড্রেসিংরুমে, সেখানে গায়ে দিলাম এই লড়াইয়ের জন্যই বিশেষভাবে নকশা করা শর্টস, জুতা আর আলখাল্লা। সেখানে দেখি, তথ্যচিত্র ধারনের জন্য বার্ট ল্যাংকাস্টার তৈরি। দেখা হলো জো লুইসের সঙ্গেও, যথারীতি বিশেষজ্ঞ হিসেবে আমি হেরে যাব এমন একটা ভবিষ্যদ্বাণী করেছে। আমিও তাকে আমার জয় উদ্যাপনের পার্টিতে দাওয়াত দিতে ভুললাম না। আসলে স্রোতের প্রতিকূলে সাঁতরাতেই যে আমার বেশি ভালো লাগে!
ড্রেসিংরুম থেকে রিংয়ের ছোট্ট কিন্তু লম্বা পথটা হেঁটে গিয়ে মাঝখানে দাঁড়ালাম। জনারণ্য থেকে ভেসে আসছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। কেউ বা বিদ্রূপ করছে, কেউ বলছে, 'এবার তোর পালা।' আমি এসবে পাত্তা না দিয়ে রিংয়ের ভেতর গা গরম করতে শুরু করলাম, কিছুটা নাচানাচি করে পেশিগুলোতে ঢিল দিচ্ছি, একবার তো কোনায় দাঁড়ানো ফ্রেজিয়ারের কাঁধে ইচ্ছে করেই একটা ধাক্কা দিলাম। মাথার ভেতরের প্রতিটি স্নায়ুই টান টান, জানি ঘণ্টা আসলে বাজবে একটাই কিন্তু লড়াই আসলে দুটো। একটা হচ্ছে আমার ফিরে আসার লড়াই, যার জন্য আমার এত দিনের এত সব কষ্ট। আর আরেকটা হচ্ছে, ১৫ রাউন্ডের বঙ্ংি ম্যাচ। এটাও জানি, লড়াই দুটো হলেও ফল আসলে একটাই। প্রতিটা লড়াইতে নামার আগেই আমি প্রতিপক্ষকে নিয়ে একটা কবিতা লিখে থাকি, এবারও তার ব্যতিক্রম হলো না। জোকে নিয়ে লেখা কবিতাটা ছিল এমন_
ভেব না রিংয়ের ভেতর আমি লোক হাসাব
তোমায় খোঁচাব এবং ক্ষতবিক্ষত করব।
তোমার গর্বের আগুনে ঢেলে দেব জল
হয়তো অবাক হবে, ভাববে এ কোন প্রতিপক্ষের সামনে আমি
কিন্তু মনে রেখো, তোমায় আমি ধ্বংস করেই ছাড়ব ফ্রেজিয়ার।
লড়াই শুরু হয়ে গেল। কানে ভেসে এলো পরিচিত সেই শব্দ, দর্শকদের বুনো উল্লাসের সঙ্গে ঘণ্টা বাজার মিশ্রধ্বনি। ১২ বছর বয়স থেকেই আমার কান এই শব্দের সঙ্গে অভ্যস্ত, শোনা মাত্রই মেরুদণ্ড বেয়ে নেমে যায় একটা শীতল স্রোত। আমি জানি ফ্রেজিয়ারেরও এমনটা হয়। এই শব্দ শোনা মাত্রই রক্তে বেজে ওঠে দামামা, জানিয়ে দেয় এখানে আমাদের দুজনের একজনকে মরতেও হতে পারে।
অনুবাদ : সামীউর রহমান

No comments

Powered by Blogger.