আলী বাবা ও চল্লিশ চোরের জন্য দুঃখগাথা by শাহনেওয়াজ বিপ্লব

১. আলী বাবা ও চল্লিশ চোরের গল্প পড়েছিলাম ছেলেবেলায়। পড়তে পড়তে একটা শিহরণ খেলে যেত শরীরে, কিভাবে আলী বাবার সহায়তায় চল্লিশজন চোর মিলে চুরি করা সম্পদের মজুদ গড়ে তুলেছিল- তার এক রোমহর্ষক কাহিনী।


ঘুষ-দুর্নীতি আর লুণ্ঠনে পৃথিবীর অন্যতম দেশ হিসেবে আমাদের দেশ বাংলাদেশ এখন তুচ্ছ করে দিয়েছে আরব্য উপন্যাসের এসব ছিঁচকে চোরের কাহিনী। বাংলাদেশে এখন চুরি আর লুটের যে নিত্যনতুন রমরমা কাহিনীর জন্ম হচ্ছে, তাতে আলী বাবা ও চল্লিশ চোরের কাহিনী পড়লে শরীরের লোম এখন আর দাঁড়ায় না। মাঝেমধ্যে ভাবি, আলী বাবা ও চল্লিশ চোরের সে কাহিনীর লেখক যদি বেঁচে থাকতেন আজ অবধি, তবে আলী বাবা ও চল্লিশ চোরের মতো পানসে কাহিনীর জন্য তিনি সম্ভবত বর্তমান বাংলাদেশ সরকারের কাছে লজ্জিত হতেন। আর স্বয়ং আলী বাবা বেঁচে থাকলে তিনিও পরাজয় স্বীকার করে নিতে বাধ্য হতেন আমাদের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের কাছে। যদিও এসব চুরি আর লুটপাটে অর্থমন্ত্রীর সমর্থন বা প্রশ্রয় নেই। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ তিনি সাধারণ মানুষের অর্থ চুরি আর লুটপাট প্রতিরোধে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেননি। পৃথিবীর রূপকথাগুলোতে চুরি-চামারি আর লুটপাটের যত কাহিনী আছে, সব কাহিনীই হার মানবে বর্তমানের চুরি আর লুটপাটের কাহিনীর কাছে। দস্যু বাহরাম বা রবিনহুডের কাহিনী পানসে মনে হবে, যখন আপনি শুনবেন শেয়ারবাজার থেকে কিভাবে কৌশল করে চোর আর লুটেরারা হাতিয়ে নিয়েছে সাধারণ মানুষের ৪০ হাজার কোটি টাকা। হলমার্ক নামে একটা ছোট্ট প্রতিষ্ঠান নামে-বেনামে কিভাবে হাতিয়ে নিয়েছে চার হাজার কোটি টাকা। ইউনিপেটুইউর নাম করে ২০ হাজার কোটি টাকা, ডেসটিনির নাম দিয়ে ১০ হাজার কোটি টাকা- এভাবে হিসাব করলে দেখা যায়, বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সাধারণ মানুষের এক লাখ কোটি টাকা চুরি অথবা লুটপাট হয়েছে।
২. আমরা যখন ছোট, তখন এখনকার মতো এত টেলিভিশন চ্যানেল ছিল না। টেলিভিশন বলতেই ছিল বাংলাদেশ টেলিভিশন। পড়াশোনা শেষ হলে রাত ৮টা বা ১০টার সংবাদটা মনোযোগসহকারে দেখতে বসতাম। খবর দেখার চেয়েও মন বেশি পড়ে থাকত খবরের আগে যখন করুণ কণ্ঠে গেয়ে উঠত : 'সব কটা জানালা খুলে দাও না। ওরা আসবে চুপি চুপি...। যারা এই দেশটাকে ভালোবেসে দিয়ে গেছে প্রাণ।' সেই গানে। চোখ পানিতে ভিজে একাকার হযে যেত গানটা শুনে। একবার রাতের খবরের পর জানালা খুলে রেখে ঘুমিয়েছিলাম, শহীদরা আসবে বলে। সকালে আমার মা ব্যাপারটা জানতে পেরে রাতে ঘরের জানালা খোলা রাখতে বারণ করেছিলেন। জানালা খোলা রেখে ঘুমোলে চোর হয়তো জানালা দিয়ে চুপি চুপি ঢুকে সব নিয়ে যেতে পারে- এই ভেবে। ব্যাপারটা তখন বুঝতে পারতাম না। তখন আমরা এখনকার মতো এত চোর দেখিনি। তবে চোর সে সময়ও ছিল, একেবারে অল্প কিছু মানুষ লুকিয়ে-চাপিয়ে চুরি-চামারি করত। ধরা পড়লে খুব লজ্জিত হতো। সমাজের কাছে নিন্দিত হতো। আর এখন হয়েছে উল্টো। চুরি ধরিয়ে দিয়েছেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের এপিএসের ড্রাইভার আজম খান; এখন তাঁকেই পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে অথচ চোরেরা আছেন বহাল তবিয়তে। সোনালী ব্যাংকের হলমার্ক কেলেঙ্কারি ধরিয়ে দিয়েছেন মাশরুরুল হুদা সিরাজী। তাই তাঁর নামেই দেওয়া হয়েছে ১২টি মামলা। বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুতে দুর্নীতি হয়েছে অভিযোগ তুলেছে, এখন বিশ্বব্যাংকেরই বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ করেছে আমাদের সরকার- এই হচ্ছে অবস্থা। ইসলামের আবির্ভাবের আগে জাহেলিয়া বা অন্ধকার যুগ বলে একসময়ের কথা লেখা আছে ইতিহাসে। সে অন্ধকার সময়ে কি তবে আমরা প্রবেশ করেছি? এ জন্যই কি আমাদের শহীদরা প্রাণ দিয়েছিলেন? মনে মনে ভাবি, আহা রে... আমাদের ৩০ লাখ শহীদ। দেশের স্বাধীনতার জন্য, ন্যায় আর সাম্য প্রতিষ্ঠার জন্য, দুর্নীতিহীন একটি সমাজ গড়ার জন্য পাকিস্তানি হানাদারদের গ্রেনেড, গুলি আর ট্যাংকের নিচে নিজেদের প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন, যাঁদের তাজা রক্তে রঙিন হয়েছে বাংলার মাটি; সেই শহীদরা কি চুপি চুপি জানালা দিয়ে আসবেন? যদি তাঁরা জানেন, তাঁদের স্বপ্নের বাংলাদেশ ভরে গেছে অজস্র চোরে। তাঁরা কি আসবেন চুপি চুপি জানালা পথে, যদি তাঁরা জানেন তাঁদের রক্তে সিক্ত হয়ে আমাদের স্বাধীনতা এসেছে সত্যি; কিন্তু স্বাধীনতার স্বপ্ন পূরণ হয়নি আজও? তাঁরা তো জানেন না, স্বাধীনতা বলতে আমাদের রাজনীতিকরা বোঝেন স্বাধীনতা হচ্ছে- শামসুর রাহমানের কবিতা, স্বাধীনতা দিবস এলেই যেটা আবৃত্তি করা হয়। স্বাধীনতা দিবস পেরিয়ে গেলে পরদিন থেকেই আমরা স্বাধীনতার তাৎপর্য ভুলে যাই, শহীদদের কথা আর কেউ মনে রাখে না।
৩. এখনো বিটিভি ওয়ার্ল্ডে প্রতিদিন রাতের সংবাদ দেখতে বসলে 'সব কটা জানালা খুলে দাও না'- ওই গানটা শুনে দূর প্রবাসেও আমি আমার ঘরের জানালাটা খুলে দিই। জানালা খুলে আকাশের দিকে তাকাই। ভাবি, ওই যে আকাশ, অনেক ওপরে; সেখানেই তো থাকেন আমাদের মহান স্রষ্টা। ওই দিকে তাকিয়ে বলি, হে মহান প্রভু; চোর, লুটেরা আর বাটপারে ভরে গেছে আমাদের দেশ। আমাদের বাংলাদেশে যারা বেঁচে আছে, তারা কেউই শান্তিতে নেই, হে স্রষ্টা। কিন্তু আমাদের শহীদরা তো তোমার হেফাজতে আছেন মাবুদ। তাঁরা বড় অসহায় আর দুঃখী- আমাদের বাংলা মায়ের সন্তান। তুমি অন্তত তাঁদের কিছুটা শান্তি দিয়ো।

লেখক : গল্পকার, ভিয়েনা আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণারত।
shahnewazbiplob@hotmail.com

No comments

Powered by Blogger.