কমিউনিস্ট আন্দোলনের অতীত ও ভবিষ্যৎ by হায়দার আকবর খান রনো

১১ থেকে ১৩ অক্টোবর তিন দিনের জন্য বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির দশম কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হতে চলেছে। সিপিবি ১৯৪৮-পরবর্তীকাল থেকে পার্টির ইতিহাস গণনা করে যে হিসাবে এটাকে দশম কংগ্রেস বলে ঘোষণা করছে, তা এক হিসাবে সঠিক হলেও অন্য হিসাবও আছে।


বস্তুত সিপিবি অবিভক্ত ব্রিটিশ-ভারতের বিশের দশকে গঠিত কমিউনিস্ট পার্টির ধারাবাহিকতা ও অংশবিশেষও বটে। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির জন্মতারিখকেও এ দেশের কমিউনিস্ট পার্টির জন্মতারিখ বলে ধরা চলে এবং সেটাই হবে সঠিক ঐতিহাসিক তথ্য। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির জন্মতারিখ কী? সেই ক্ষেত্রেও বিভিন্ন মত আছে। ১৯২০ সালের ১৭ অক্টোবর তাসখন্দে স্বয়ং লেনিনের তত্ত্বাবধানে এবং প্রবাসে অবস্থানরত মানবেন্দ্রনাথ রায়ের নেতৃত্বে প্রথম ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি গঠিত হয়েছিল। সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন মহম্মদ শফিক সিদ্দিকী। এই দিনটিকে কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা মোজাফ্ফর আহমদ পার্টির জন্মতারিখ হিসেবে বিবেচনা করেন। অনেকে অবশ্য তা মনে করেন না। প্রবাসে গঠিত এই কমিটি ভারতের অভ্যন্তরে কাজ করার সুযোগ পায়নি। কমিটির নেতারা যখন আফগান সীমান্ত অতিক্রম করে দেশে প্রবেশ করেন, তখনই তাঁরা একে একে গ্রেপ্তার হন এবং দীর্ঘ কারাবাস করেন। প্রতিষ্ঠাতা নেতা এম এন রায়ও চল্লিশের দশকে মার্কসবাদ ও কমিউনিস্ট মতাদর্শ পরিত্যাগ করেন।
১৯২১ সালের দিকে কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল ভারতের বিভিন্ন জায়গায় কমিউনিস্ট আদর্শে বিশ্বাসী কমরেডদের সঙ্গে যোগাযোগ তৈরি করেন এবং তাঁদের পরস্পরকে পরিচিত করিয়ে দেন। এভাবে বাংলায় মোজাফ্ফর আহমদ, মুম্বাইয়ে এস এ ডাঙ্গে, লাহোরে গোলাম হোসেন এবং মাদ্রাজে সিঙ্গারাভেলু চেট্টিরার- এই চারজন পথিকৃতের মাধ্যমে নিউক্লিয়াস গঠিত হয়েছিল। পার্টি ছিল নিষিদ্ধ এবং মোজাফ্ফর আহমদ প্রমুখ নেতা, এমনকি কমিউনিস্ট আদর্শে বিশ্বাসী কর্মীরা জেল-জুলুম ও চরম নির্যাতনের শিকার হন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যখন হিটলার সোভিয়েত আক্রমণ করেন, তখন ব্রিটিশ, ফরাসি ও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েতের যুদ্ধকালীন মৈত্রী তৈরি হয়েছিল। সেই সময় ভারতে কমিউনিস্ট পার্টি আইনগত স্বীকৃতি লাভ করেছিল। পি সি জোসি ছিলেন সাধারণ সম্পাদক।
১৯৪৭ সালের মধ্য আগস্টে ভারতবর্ষ স্বাধীনতা লাভ করল এবং ভারত ও পাকিস্তান দুটি রাষ্ট্র গঠিত হলো। ১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হলো কলকাতায় প্রকাশ্যে। সেই কংগ্রেসেরই শেষ অধিবেশনে পার্টিকে দুই ভাগ করা হলো। যাঁরা ভারতে থাকবেন, তাঁরা এক ভাগে। যাঁরা পাকিস্তানে থাকবেন তাঁরা আরেক ভাগে। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক হলেন কমরেড বিটিরনদীভে এবং পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক কমরেড সৈয়দ সাজ্জাদ জহির।
পাকিস্তান আমলে কমিউনিস্টদের ওপর চরম নির্যাতন এবং পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের ভৌগোলিক দূরত্ব ইত্যাদি কারণে সারা পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি ভালোভাবে কাজ করতে পারেনি। পূর্ব পাকিস্তানের জন্য পার্টির প্রাদেশিক কমিটিই গোপনে কাজ পরিচালনা করত। ১৯৫৬ সালে কলকাতায় গোপনে অনুষ্ঠিত এক সম্মেলনের মধ্য দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টির কমিটি গঠিত হয়েছিল, যার সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন কমরেড মণি সিংহ।
ষাটের দশকের শুরুর দিকে সোভিয়েত ও চীন পার্টির মধ্যকার বিতর্ক মহা আন্তর্জাতিক বিতর্কে পরিণত হয়েছিল, যার ঢেউ সব দেশের কমিউনিস্ট পার্টিতে লেগেছিল এবং পার্টি বিভক্ত হয়েছিল। ভারতের পার্টি বিভক্ত হলো ১৯৬৪ সালে- সিপিআই এবং সিপিআই (এম)। ১৯৬৪ সালে পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টিও দ্বিধাবিভক্ত হয়েছিল। মস্কোপন্থী বলে পরিচিত অংশের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন কমরেড মণি সিংহ এবং পিকিংপন্থী অংশের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন কমরেড সুখেন্দু দস্তিদার।
স্বাধীনতাসংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ, ভাষা আন্দোলন- প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলন, মেহনতি মানুষের শ্রেণীসংগ্রাম, নারীমুক্তি, প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলনে কমিউনিস্ট পার্টির ছিল গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা। সেই কারণে এবং কমিউনিস্ট নেতা-কর্মীদের মহান আত্মত্যাগ, আদর্শনিষ্ঠা ও ব্যক্তিগতভাবে তাঁদের উচ্চতর মানবিক গুণাবলির জন্য তাঁরা দেশবাসীর শ্রদ্ধা অর্জন করে এসেছেন। তবু তাঁরা বুর্জোয়া রাজনৈতিক ও সামাজিক আধিপত্যকে পরাস্ত করতে পারেননি। উপরন্তু তাঁরা বিভন্ন সময় গুরুতর ভুলও করেছেন। দক্ষিণপন্থী সুবিধাবাদ ও অতি-বাম বিচ্যুতির শিকারও হয়েছেন। তা ছাড়া সোভিয়েত ইউনিয়নসহ সমাজতান্ত্রিক শিবিরের বিপর্যয় আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনকে বড় রকমের আঘাত করেছিল। আমাদের দেশেও কমিউনিস্ট আন্দোলন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। তবে আশার কথা এই যে পৃথিবীতে নতুন করে পুঁজিবাদবিরোধী ও সমাজতান্ত্রিক সংগ্রাম বিকাশ লাভ করছে। কমিউনিস্ট আন্দোলনও মোড় ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। ঠিক এ পরিপ্রেক্ষিতে কমিউনিস্ট পার্টির কংগ্রেস তিনটি কারণে গুরুত্বপূর্ণ।
প্রথমত, সমাজতন্ত্রবিরোধী বুর্জোয়া প্রচার যখন তীব্র, ঠিক তখনই কমিউনিস্ট পার্টি সাহস ও দৃঢ়তার সঙ্গে সমাজতন্ত্র এবং মার্কসবাদ-লেনিনবাদের পতাকাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরছে। দ্বিতীয়ত, বহুধাবিভক্ত কমিউনিস্ট আন্দোলনকে ঐক্যবদ্ধ করার যে নীতি সিপিবি ইতিপূর্বে গ্রহণ করেছিল, তা আবারও জোরের সঙ্গে উচ্চারিত হবে এই কংগ্রেসে। তৃতীয়ত, দ্বিদলীয় বুর্জোয়া বলয়কে ভেঙে বাম গণতান্ত্রিক বিকল্প গড়ার ডাক আসছে এই কংগ্রেস থেকে।
দুনিয়াব্যাপী কমিউনিস্ট আন্দোলনের বিশাল গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্য থাকা সত্ত্বেও বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে যে বিপর্যয় নেমে এসেছিল, সম্ভবত সেই বিপর্যয়ের যুগ শেষ হতে চলেছে। শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রাম মানুষের সহজাত ধর্ম। তাই শোষণমুক্তি তথা সমাজতন্ত্রের সংগ্রাম সাময়িক ক্ষতিগ্রস্ত হলেও কখনো নির্বাপিত হবে না। 'ইতিহাসের অবসান' হয়েছে বলে যারা একদা উল্লাস করেছিল, তাদের কপালে এখন আবার ভাঁজ পড়েছে। একবিংশ শতাব্দীতে সমাজতান্ত্রিক সংগ্রাম আরো পরিপক্ব রূপ নিয়ে বিকাশ লাভ করবে বলে মনে করার যথেষ্ট বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা ও যুক্তি আছে।
লেখক : বাম রাজনীতিক ও কলামিস্ট

No comments

Powered by Blogger.