সময়ের প্রতিধ্বনি-দূরে সরে যাচ্ছে আওয়ামী লীগের বন্ধুরা by মোস্তফা কামাল

আওয়ামী লীগকে নিয়ে একটা কথা চালু আছে। 'আওয়ামী লীগ নির্বাচনে জিতলে একা জেতে। আর হারলে পুরো জাতি হারে।' এই কথাটির সঙ্গে আওয়ামী লীগের অনেক মিল রয়েছে বলে মনে হয়। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেলে তার সুহৃদদের কথা দ্রুতই ভুলে যায়। চরম সুবিধাভোগীরা আওয়ামী লীগের বন্ধু বনে যায়।


অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, যারা বিএনপির আমলে সুবিধাভোগী ছিল, তারা আওয়ামী লীগের আমলেও সুবিধা ভোগ করছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের শত্রুরাও বিশেষভাবে মূল্যায়িত হয়েছে। রাজাকার-আলবদর হলেও আওয়ামী লীগ সরকারের সুবিধা পেতে তাদের তেমন বেগ পেতে হয়নি। অর্থাৎ সরকার বদল হলেও সুবিধাভোগী বদল হয় না। বদল হয় পোশাকের। এই পোশাকি মানুষগুলোকে আওয়ামী লীগ-বিএনপি উভয়ই চিনতে ভুল করে। সেই ভুলের খেসারতও তাদের দিতে হয়। তার পরও তাদের শিক্ষা হয় না।
আমরা বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার রাজনীতি ও তাঁর নেতৃত্বে দুটি সরকার দেখে আসছি। ১৯৯৬ সালে অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনে খুব অল্প ব্যবধানে বিএনপিকে পরাজিত করে আওয়ামী লীগ। সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসেবে শেখ হাসিনা প্রথম প্রধানমন্ত্রী হন। ওই সময় তাঁর মন্ত্রিসভার অধিকাংশ সদস্যই প্রথমবার মন্ত্রী হন। কিন্তু তাঁরা রাজনীতিতে অত্যন্ত পরিপক্ব ছিলেন। সরকার পরিচালনার ব্যাপারে তাঁদের যথেষ্ট হোমওয়ার্ক ছিল। তাঁদের নেতৃত্বের গুণে প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের কাছে বিশেষভাবে সম্মান পেতেন। ফলে তাঁরা বেশ দক্ষতার সঙ্গেই মন্ত্রণালয় পরিচালনা করেছেন। কিন্তু বর্তমান সরকারের আমলে মন্ত্রিসভার অধিকাংশ সদস্য এতটাই অপরিপক্ব যে তাঁরা পুরোপুরি আমলানির্ভর। ফলে আমলারা তাঁদের যেভাবে পরিচালনা করেন, সেভাবেই তাঁরা পরিচালিত হন। এটাই হচ্ছে বর্তমান সরকারের বড় ব্যর্থতা। অভিজ্ঞতার অভাবে সরকারের লেজেগোবরে অবস্থা।
ভোটে জেতার জন্য আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে যে মহাজোট হয়েছিল, তা এখন ভেঙে যাওয়ার অবস্থায় চলে গেছে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের প্রধান শরিক জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ অনেক আগে থেকেই ঘোষণা দিয়ে রেখেছেন, তিনি মহাজোট ছেড়ে দেবেন। আগামী নির্বাচনে এককভাবে প্রার্থী দেবেন। তা ছাড়া আওয়ামী লীগের সবচেয়ে কাছের রাজনৈতিক সঙ্গী বাম দলগুলোও আলাদা হয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। ইতিমধ্যে বাম নেতারা বেশ কয়েকটি বৈঠক করেছেন। খুব শিগগির মহাজোট ভেঙে যাবে বলে ধারণা করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। সরকারের বিরুদ্ধে শরিকদের মূল অভিযোগ, আওয়ামী লীগ সরকারে গিয়ে প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেনি। শরিক দলগুলোকে সমভাবে মূল্যায়ন করেনি। নির্বাচনের আগে জনগণের কাছে দেওয়া প্রতিশ্রুতি পূরণে ব্যর্থ হয়েছে।
আমার এই নিবন্ধে সরকারের ভ্রান্তনীতির কারণে আওয়ামী লীগ যে বন্ধুহীন হয়ে পড়ছে, সে বিষয়টিই তুলে ধরব। তবে তার আগে শেখ হাসিনার রাজনৈতিক সংগ্রাম ও উত্থান নিয়ে কিছু কথা বলতে চাই।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের যাত্রা শুরু হয় ১৯৮১ সালে। তখন আওয়ামী লীগ ছিল বহুধাবিভক্ত। মালেক উকিলের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের মূল অংশ থাকলেও মিজান চৌধুরীর নেতৃত্বে আরেকটি অংশ আলাদাভাবে সংগঠিত হয়েছিল। একক নেতৃত্বের অভাবে আওয়ামী লীগ যখন ক্ষত-বিক্ষত, তখন ড. কামাল হোসেনসহ কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় নেতা ঐক্যের প্রতীক হিসেবে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে রাজনীতিতে নিয়ে আসেন। আওয়ামী লীগের হাল ধরে তিনি বহুধাবিভক্ত দলকে ঐক্যবদ্ধ করার উদ্যোগ নেন। নেতাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব ও মতবিরোধ কমিয়ে আনতে সক্ষম হন তিনি। একই সঙ্গে আওয়ামী লীগকে কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত সুসংগঠিত করতে নিরলস প্রচেষ্টা চালান।
১৯৮২ সালে তৎকালীন সেনাপ্রধান এরশাদ সেনাশাসন জারির পর প্রথম প্রতিবাদ জানান শেখ হাসিনা। তার পর থেকেই স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে আওয়ামী লীগ ইতিবাচক ভূমিকা রাখে এবং একটি প্রধান রাজনৈতিক দল হিসেবে নতুনভাবে আত্মপ্রকাশ করে। আওয়ামী লীগে শেখ হাসিনার নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। বঙ্গবন্ধুর কন্যা হিসেবে শেখ হাসিনা সংগঠনের হাল ধরলেও নেতৃত্বের গুণে তিনি একটি শক্ত অবস্থান তৈরি করেন। একটা পর্যায়ে বাকশালও আওয়ামী লীগে একীভূত হয়।
শেখ হাসিনার সুযোগ্য নেতৃত্বের কারণেই আওয়ামী লীগ দুইবার (১৯৯৬ ও ২০০৯) রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে সক্ষম হয়। তা ছাড়া ১৯৮৬, ১৯৯১ ও ২০০১ সালে জাতীয় সংসদে প্রধান বিরোধী দলের আসনে বসার সুযোগ লাভ করে। বর্তমান সময়ে আওয়ামী লীগ দেশের একটি বৃহত্তর রাজনৈতিক দল। গ্রাম-ওয়ার্ড পর্যায় পর্যন্ত দলটির মজবুত সাংগঠনিক কাঠামো রয়েছে। দেশের একটা বড় অংশের মানুষ আওয়ামী লীগের ভক্ত-সমর্থক। অবশ্য আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তার প্রধান কারণ বঙ্গবন্ধু। তাঁর প্রতি দেশের মানুষের অকৃত্রিম ভালোবাসার কারণেই আওয়ামী লীগকে তাঁরা পছন্দ করেন। দেশের লেখক, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, আইনজীবী, শিক্ষক, ছাত্রসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ আওয়ামী লীগের কর্মকাণ্ডে রীতিমতো হতাশ। তাঁরা শুরুর দিকে যতটা আশাবাদী ছিলেন, এখন ততটাই হতাশ।
প্রধানমন্ত্রীসহ মন্ত্রিসভার কিছু সদস্য ও নেতার অতিকথনের কারণে সরকারকে বারবার বিপাকে পড়তে হচ্ছে। ইতিমধ্যে বেশ কিছু ঘটনায় সরকারকে বেশ ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে। তার পরও মন্ত্রিসভার সদস্যদের লাগামহীন কথাবার্তা বিরামহীনভাবে চলছে। এসব কারণে আওয়ামী লীগের সুহৃদ, এমনকি আন্তর্জাতিক অঙ্গনের বন্ধুরাও সরকারের ওপর বিরক্ত হচ্ছে। পদ্মা সেতু ইস্যুতে প্রধানমন্ত্রীর সাম্প্রতিক কিছু মন্তব্যে বিশ্বব্যাংকসহ উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা ও দেশ খুবই নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করছে।
তবে এটা ঠিক, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বঙ্গবন্ধুর সুহৃদরাই আওয়ামী লীগকে নানাভাবে সহযোগিতা ও সমর্থন দিয়ে আসছে। কিন্তু বর্তমান সরকারের কিছু কর্মকাণ্ডে সেই বন্ধুদের হারাতে বসেছে আওয়ামী লীগ। বলা হয়ে থাকে, আওয়ামী লীগের চিরায়ত বন্ধুরাষ্ট্র হচ্ছে ভারত। এখনো ভারতের নীতি আওয়ামী লীগের পক্ষেই রয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। যদিও ভারতের কাছ থেকে আওয়ামী লীগ সরকার কিছুই আদায় করতে পারেনি।
এখনকার পররাষ্ট্রনীতির পূর্ব শর্তই হচ্ছে, পারস্পরিক লেনদেন। কিন্তু নিকট প্রতিবেশী এই দুই দেশের মধ্যে সুসম্পর্ক থাকলেও ঝুলে থাকা সমস্যাগুলোর কোনো সমাধান হয়নি। তিস্তা নিয়ে বারবার মানুষের মধ্যে আশাবাদ জাগালেও চুক্তির ব্যাপারে কার্যকর কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। উপরন্তু বাংলাদেশ ভারতের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি এমন কয়েকজনকে সীমান্ত এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করে ভারতের হাতে তুলে দিয়েছে। বিচ্ছিন্নতাবাদীদের আন্দোলন দমনে ভারতকে সহযোগিতা দিয়েছে। বিনিময়ে বাংলাদেশ কী পেয়েছে, তা নিয়ে মানুষ এখন প্রশ্ন তুলছে।
তা ছাড়া বঙ্গবন্ধু সরকারের শেষ সময়ের বন্ধু যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগকে বিভিন্নভাবে সমর্থন ও সহযোগিতা দিয়েছে। অথচ বর্তমান সরকারের কিছু কর্মকাণ্ডে যুক্তরাষ্ট্র সরকার খুবই বিরক্ত। সুপার পাওয়ারের সঙ্গে ডিলিংয়ের ক্ষেত্রেও সরকারের অভিজ্ঞতার অভাব রয়েছে। দুই দেশের মধ্যে কিছু বিতর্কিত বিষয় ছিল, সেগুলো কৌশলে এড়ানো যেত; সে বিষয়ে অতিরিক্ত কথাবার্তা বলার কারণে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। ড. ইউনূস ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের মন্তব্যের পাল্টা কড়া প্রতিক্রিয়া জানিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার পরিস্থিতি ঘোলাটে করেছে।
একইভাবে আওয়ামী লীগের নতুন বন্ধু (যদিও কারো কারো দ্বিমত রয়েছে) চীন ও সৌদি আরবের সঙ্গেও সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে ব্যর্থ হয়েছে সরকার। আমরা বিগত জাতীয় নির্বাচনের আগে এই দুটি দেশের তৎপরতা দেখেছি। বিগত বিএনপি সরকারের আমলে ঢাকায় তাইওয়ানের অফিস খোলাকে কেন্দ্র করে দলটির চীনের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটে। এ জন্য দায়ী করা হয় তারেক রহমানকে। ঢাকায় নিযুক্ত চীনের তখনকার রাষ্ট্রদূত এই লেখককে বলেছিলেন, তারেক রহমানের ইঙ্গিতেই তাইওয়ান ঢাকায় অফিস খুলেছিল। পরে চীনের কঠোর মনোভাবের কারণে অফিসটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। কিন্তু চীন সে কথা ভোলেনি। ওই সময় দেশটি আওয়ামী লীগের পাশে দাঁড়ায় এবং নির্বাচনের আগে বেশ সক্রিয় ভূমিকা পালন করে।
সৌদি আরবের ঢাকায় নিযুক্ত রাষ্ট্রদূতও আটটি মুসলিম দেশকে একত্র করে আওয়ামী লীগের পক্ষে কাজ করেছিলেন। তিনি নির্বাচনের আগে বেশ কয়েকবার শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠকও করেন। সে কথা নিশ্চয়ই আওয়ামী লীগের ভুলে যাওয়ার কথা নয়। অথচ ক্ষমতায় যাওয়ার পর সৌদি আরবসহ মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক অক্ষুণ্ন রাখতে সরকার ব্যর্থ হয়েছে। সৌদি দূতাবাসের একজন কর্মকর্তাকে হত্যার ঘটনায় দুই দেশের সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে।
এ ক্ষেত্রে সরকারের উচিত ছিল, যত দ্রুত সম্ভব হত্যাকারীকে খুঁজে বের করে শাস্তি নিশ্চিত করা। অথচ দীর্ঘদিন ধরে কেবল তদন্তকাজ চলছে। সংগত কারণেই সৌদি সরকার আওয়ামী লীগের ওপর বিরক্ত হয়েছে এবং দূরে সরে যাচ্ছে। আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব কি এ বিষয়গুলো উপলব্ধি করতে পারছে?

লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
mostofakamalbd@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.