চারদিক- বাঁধের ওপরের উদ্বাস্তু জীবন by সাইফুদ্দিন রবিন
চিত্র ১: চোখ বন্ধ করুন। কল্পনায় ছুটে যান কক্সবাজার কিংবা সেন্ট মার্টিনের সমুদ্রসৈকতে। সময়টা জানান দিচ্ছে মধ্যরাত। বসে আছেন সমুদ্রের পাড়ে। ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে তীরে। এমন রাতের ঢেউয়ের গর্জন আপনার কেমন লাগবে? পাগল করে দেওয়া অদ্ভুত অনুভূতি নিয়ে সাগরের তীরে নান্দনিক এক সময় পার করবেন নিশ্চয়ই?
চিত্র ২: আবার চোখ বন্ধ করুন। কল্পনায় ছুটে যান দেশের দক্ষিণের বিচ্ছিন্ন দ্বীপ হাতিয়ার সমুদ্রপাড়ে। সময়টা ঠিকই এক—মধ্যরাত। সমুদ্রের কাছেই বাঁধের ওপর ছোট্ট খুপরি এক ঘরে বসতি। ঢেউয়ের গর্জন দ্রুত কানে আসছে। মনে হচ্ছে, এই বুঝি আছড়ে পড়ল। কেমন লাগবে? সাগরের জলে যেকোনো মুহূর্তে হারিয়ে যাওয়ার শঙ্কায় নিশ্চিত পুরো শরীরে সৃষ্টি হবে কম্পন? বিচিত্র হলেও বাস্তব সত্য, কিছু কিছু মানুষ আছে যারা জীবনের রূপ-রস-গন্ধ এড়িয়ে কেবল বেঁচে থাকার আশায় ভয়কে তুচ্ছ করে বেঁচে থাকে নদীর পারে। প্রতিটি মুহূর্ত অনিশ্চয়তা আর শঙ্কায় কাটে তাদের। তবু থাকার জায়গা যে নেই। তাই ভূমিহীন এই মানুষগুলো আশ্রয় নেয় নদীর পাড়ের বেড়িবাঁধে, বাঁধের ভেতরে কিংবা বাইরে। যেকোনো মুহূর্তে জোয়ারের জলে ভেসে যাওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে।
দেশের দক্ষিণের দ্বীপ হাতিয়া। যার চারপাশেই পানি। উত্তরে, পুবে, পশ্চিমে মেঘনা। এই মেঘনাকে রাক্ষুসেই বলা চলে। কেননা, তার বুকে যে দ্বীপের মাটি ক্ষয়ে ক্ষয়ে পড়ে। আর দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর। বুক উজাড় করে যে সাগরের বুকে জেগে ওঠে নতুন নতুন চর। ভাঙন থেকে রক্ষা পেতে এই দ্বীপটিরই চার পাশে রক্ষাকবচ হিসেবে তৈরি হয় বাঁধ। কোথাও কোথাও সেই বাঁধও আর নেই। ভাঙতে ভাঙতে একসময় বাঁধও ভাঙে। আবার নতুন করে নদীভাঙা মানুষের আর্তনাদ। আবার বাঁধ তৈরি। এই যে বারবার নদীভাঙন, তাতে ঘরহারা হয়ে, হয়ে ওঠে বহুজন ভূমিহীন। একসময় হাজার বিঘা জমির মালিকও এই দ্বীপে এখন থাকার জায়গা খুঁজে পায় না। দারুণ প্রমত্তা নদীতে সব গেল বলে। যারা থাকার প্রিয় জায়গাটুকু নদীতে হারায়, তাদের আর বিকল্প কী? কেউ কেউ ছুট দেয় শহরে। খুঁজে নেয় আশ্রয় ব্যস্ত নগরের পায়ে হাঁটার পথে, বস্তিতে, যেখানে যেমন করে পারে। আবার কেউ দৌড়ঝাঁপ করে হাতিয়ার চারপাশে নতুন জেগে ওঠা চরে এক টুকরো ভূমি পাওয়ার আশায়। নতুন করে জীবন শুরুর স্বপ্নে। কেউ কেউ সফল হয় আবার কেউ বা ব্যর্থ। ব্যর্থ কিছু মানুষের দেখা মিলল নিকট অতীতে হাতিয়ার নলচিরা এলাকার বেড়িবাঁধে। সবকিছু হারিয়ে এই বাঁধের বুকেই আশ্রয় খুঁজে নিয়েছে তারা। এখানেই ছোট্ট কুঁড়েঘরে তাদের সব স্বপ্ন আর সুখের চাষবাস। যেকোনো মুহূর্তে নদীগর্ভে হারাতে পারে এই বাঁধের কিনারা। তবু এখানেই থাকতে হচ্ছে, কেননা যাওয়ার যে আর জায়গা নেই।
কথা হয় খাদিজা বেগমের সঙ্গে। যিনি পাঁচবার নদীভাঙার শিকার হয়েছেন। হারিয়েছেন বাবার রেখে যাওয়া ১০ বিঘা জমি। পুরোটাই এখন নদীগর্ভে। এখন বাস এই বাঁধের ওপর। নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে আঙুল তুলে দেখান দূরের দিকে। বলেন, ‘ওই যে দেহেন, কটা নৌকা মাছ ধরে। ওইখানেই আছিল আঙ্গো বাড়ি। আরেক্কানা সামনে আগাইলে দেখবেন নতুন চর। ওই হানে আছিল বাপ-দাদার জমিন। সব এই নদীর হেডে গ্যাছে।’ খাদিজা বেগম মেঘনার বহুদূরের কিছু স্থান দেখিয়ে কত কিছুর বর্ণনা দেন। কোথায় তাঁর শৈশব কেটেছে, কোথায় কৈশোর। কোথায় বিয়ে, সংসার-পাতা কিংবা সন্তানের জন্ম। আমার চোখে কিছুই ধরা পড়ে না। সবকিছুই শূন্য দেখি। সম্মুখে শুধুই নদীর উথাল-পাতাল ঢেউ। সব হারিয়ে এখন এই বেড়িবাঁধের বুকেই চলছে তাঁর জীবন। কেমন করে বেঁচে থাকা। কথা হয় রহিমার সঙ্গে। জানান, প্রতিরাতেই থাকেন ভয়ের মধ্যে। শিহরিত হন গভীর রাতে ঢেউয়ের শব্দ শুনলে। ভয় জাগে মনে, এই বুঝি আছড়ে পড়ল ঢেউ ঘরের চালার ওপর। কথা বলি খাদিজার পাশের ঘরের কিশোরী রহিমার সঙ্গে। তাঁর স্বামী নদীতে মাছ ধরেন। সপ্তাহ খানেকের জন্য হারিয়ে যান এই নদীতেই মাছের সন্ধানে। ভয় হয় তাঁর প্রিয় স্বামীর জন্য। জীবনের এই চিত্র নিয়মিত। অভ্যাস হয়ে গেছে থাকতে থাকতে। তবু কোথায় যেন কিসের শঙ্কা। নিজের দেড় বছর বয়সী সন্তানকে বুকে শক্ত করে আগলে রাখেন রহিমা। বলেন, ‘নিজের লাই ডরাই না। এই হোলার লাই ডরাই। ইশ্! যদি একখান জমি থাইক তো। এমনিতেই অভাবে থাই। হিয়ার হরও নদীর লাই এমন বাঁচন-মরণের ডর থাইকলে এইটা কোন জীবন হইল, কন?’। খুব সহজে ভাই বলে আপন করে নেওয়া রহিমা প্রশ্ন রাখেন। প্রশ্নের উত্তর জানা নেই।
হেঁটে চলি বাঁধের ওপর দিয়ে। দেখি ছোট ছোট বাচ্চা পুরো বাঁধটাকেই নিজের উঠোন বানিয়ে খেলছে। দুটি শিশু বাঁধের ওপর নিজের ঘরে হাত-পা ছড়িয়ে বাটি থেকে খাবার খাচ্ছে। কী অদ্ভুত সেই দৃশ্য। কতটা নির্ভার হয়ে কতটা আশ্চর্য দ্যুতি ছড়িয়ে খাচ্ছে সেই শিশু দুটি। অনাগত মুহূর্ত আর দিনক্ষণের কথা চিন্তা না করেই তাদের পথচলা। জানেও না, বুঝেও না এই অনিশ্চয়তায় ভরা জীবন কত দূর নিয়ে যাবে তাদের। কী অদ্ভুত রকমের উদ্বাস্তু জীবন এই বেড়িবাঁধের মানুষের। নদীর ওপরই নির্ভর করে তাদের উদ্বাস্তু হয়ে ওঠা আর বেড়িবাঁধের ওপর নির্ভর এই উদ্বাস্তু জীবন টেনে নেয়। কী আশ্চর্য জীবনধারণ!
সাইফুদ্দিন রবিন
দেশের দক্ষিণের দ্বীপ হাতিয়া। যার চারপাশেই পানি। উত্তরে, পুবে, পশ্চিমে মেঘনা। এই মেঘনাকে রাক্ষুসেই বলা চলে। কেননা, তার বুকে যে দ্বীপের মাটি ক্ষয়ে ক্ষয়ে পড়ে। আর দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর। বুক উজাড় করে যে সাগরের বুকে জেগে ওঠে নতুন নতুন চর। ভাঙন থেকে রক্ষা পেতে এই দ্বীপটিরই চার পাশে রক্ষাকবচ হিসেবে তৈরি হয় বাঁধ। কোথাও কোথাও সেই বাঁধও আর নেই। ভাঙতে ভাঙতে একসময় বাঁধও ভাঙে। আবার নতুন করে নদীভাঙা মানুষের আর্তনাদ। আবার বাঁধ তৈরি। এই যে বারবার নদীভাঙন, তাতে ঘরহারা হয়ে, হয়ে ওঠে বহুজন ভূমিহীন। একসময় হাজার বিঘা জমির মালিকও এই দ্বীপে এখন থাকার জায়গা খুঁজে পায় না। দারুণ প্রমত্তা নদীতে সব গেল বলে। যারা থাকার প্রিয় জায়গাটুকু নদীতে হারায়, তাদের আর বিকল্প কী? কেউ কেউ ছুট দেয় শহরে। খুঁজে নেয় আশ্রয় ব্যস্ত নগরের পায়ে হাঁটার পথে, বস্তিতে, যেখানে যেমন করে পারে। আবার কেউ দৌড়ঝাঁপ করে হাতিয়ার চারপাশে নতুন জেগে ওঠা চরে এক টুকরো ভূমি পাওয়ার আশায়। নতুন করে জীবন শুরুর স্বপ্নে। কেউ কেউ সফল হয় আবার কেউ বা ব্যর্থ। ব্যর্থ কিছু মানুষের দেখা মিলল নিকট অতীতে হাতিয়ার নলচিরা এলাকার বেড়িবাঁধে। সবকিছু হারিয়ে এই বাঁধের বুকেই আশ্রয় খুঁজে নিয়েছে তারা। এখানেই ছোট্ট কুঁড়েঘরে তাদের সব স্বপ্ন আর সুখের চাষবাস। যেকোনো মুহূর্তে নদীগর্ভে হারাতে পারে এই বাঁধের কিনারা। তবু এখানেই থাকতে হচ্ছে, কেননা যাওয়ার যে আর জায়গা নেই।
কথা হয় খাদিজা বেগমের সঙ্গে। যিনি পাঁচবার নদীভাঙার শিকার হয়েছেন। হারিয়েছেন বাবার রেখে যাওয়া ১০ বিঘা জমি। পুরোটাই এখন নদীগর্ভে। এখন বাস এই বাঁধের ওপর। নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে আঙুল তুলে দেখান দূরের দিকে। বলেন, ‘ওই যে দেহেন, কটা নৌকা মাছ ধরে। ওইখানেই আছিল আঙ্গো বাড়ি। আরেক্কানা সামনে আগাইলে দেখবেন নতুন চর। ওই হানে আছিল বাপ-দাদার জমিন। সব এই নদীর হেডে গ্যাছে।’ খাদিজা বেগম মেঘনার বহুদূরের কিছু স্থান দেখিয়ে কত কিছুর বর্ণনা দেন। কোথায় তাঁর শৈশব কেটেছে, কোথায় কৈশোর। কোথায় বিয়ে, সংসার-পাতা কিংবা সন্তানের জন্ম। আমার চোখে কিছুই ধরা পড়ে না। সবকিছুই শূন্য দেখি। সম্মুখে শুধুই নদীর উথাল-পাতাল ঢেউ। সব হারিয়ে এখন এই বেড়িবাঁধের বুকেই চলছে তাঁর জীবন। কেমন করে বেঁচে থাকা। কথা হয় রহিমার সঙ্গে। জানান, প্রতিরাতেই থাকেন ভয়ের মধ্যে। শিহরিত হন গভীর রাতে ঢেউয়ের শব্দ শুনলে। ভয় জাগে মনে, এই বুঝি আছড়ে পড়ল ঢেউ ঘরের চালার ওপর। কথা বলি খাদিজার পাশের ঘরের কিশোরী রহিমার সঙ্গে। তাঁর স্বামী নদীতে মাছ ধরেন। সপ্তাহ খানেকের জন্য হারিয়ে যান এই নদীতেই মাছের সন্ধানে। ভয় হয় তাঁর প্রিয় স্বামীর জন্য। জীবনের এই চিত্র নিয়মিত। অভ্যাস হয়ে গেছে থাকতে থাকতে। তবু কোথায় যেন কিসের শঙ্কা। নিজের দেড় বছর বয়সী সন্তানকে বুকে শক্ত করে আগলে রাখেন রহিমা। বলেন, ‘নিজের লাই ডরাই না। এই হোলার লাই ডরাই। ইশ্! যদি একখান জমি থাইক তো। এমনিতেই অভাবে থাই। হিয়ার হরও নদীর লাই এমন বাঁচন-মরণের ডর থাইকলে এইটা কোন জীবন হইল, কন?’। খুব সহজে ভাই বলে আপন করে নেওয়া রহিমা প্রশ্ন রাখেন। প্রশ্নের উত্তর জানা নেই।
হেঁটে চলি বাঁধের ওপর দিয়ে। দেখি ছোট ছোট বাচ্চা পুরো বাঁধটাকেই নিজের উঠোন বানিয়ে খেলছে। দুটি শিশু বাঁধের ওপর নিজের ঘরে হাত-পা ছড়িয়ে বাটি থেকে খাবার খাচ্ছে। কী অদ্ভুত সেই দৃশ্য। কতটা নির্ভার হয়ে কতটা আশ্চর্য দ্যুতি ছড়িয়ে খাচ্ছে সেই শিশু দুটি। অনাগত মুহূর্ত আর দিনক্ষণের কথা চিন্তা না করেই তাদের পথচলা। জানেও না, বুঝেও না এই অনিশ্চয়তায় ভরা জীবন কত দূর নিয়ে যাবে তাদের। কী অদ্ভুত রকমের উদ্বাস্তু জীবন এই বেড়িবাঁধের মানুষের। নদীর ওপরই নির্ভর করে তাদের উদ্বাস্তু হয়ে ওঠা আর বেড়িবাঁধের ওপর নির্ভর এই উদ্বাস্তু জীবন টেনে নেয়। কী আশ্চর্য জীবনধারণ!
সাইফুদ্দিন রবিন
No comments