রামুর সহিংসতা- সেই বিভীষিকাময় রাত by প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু
২৯ সেপ্টেম্বর রাত প্রায় নয়টা। হঠাৎ শুনি, একটি মিছিল সীমাবিহার ঘেঁষে পাড়ার রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে। বিহারের ভেতরে পাথর, ইটপাটকেল ছুড়ে মারার শব্দ। অনেকক্ষণ পর তারা চলে গেল। রাত ১০টার পর আবার অনেক মানুষের মিছিল নানা দিক থেকে এসে রামু চৌমুহনীতে জড়ো হতে থাকে।
সময় যতই গড়াচ্ছে পরিস্থিতি ততই খারাপের দিকে যাচ্ছে। বিহারের মূল গেটে দাঁড়িয়ে চৌমুহনীর পরিস্থিতি আঁচ করার চেষ্টা করছিলাম আমরা কজন। রাত ১১টার দিকে স্থানীয় যুবক সিপন বুড়য়া বললেন, ‘অবস্থা ভালো না। চলুন, বড় ভান্তেকে (সত্যপ্রিয় মহাথেরো) আমাদের ঘরে নিয়ে যাই।’ আমি গেট থেকে এক দৌড় দিয়ে দোতলা বিল্ডিংয়ে ওঠার চেষ্টা করি। দেখি গ্রিল বন্ধ। বিহারের ছোট ভান্তে এগিয়ে এলে বিষয়টি তাকে জানিয়ে আবার দৌড়ে গেটে গেলাম। গেটে অনেক লোক জড়ো হয়ে গেল। রাত ১২টার দিকে দেখি পূর্ব দিকে আগুনের লেলিহান শিখা দাউ দাউ করে জ্বলছে। জানতে পারলাম শ্রীকুল লাল চিং বৌদ্ধবিহারে আগুন দেওয়া হয়েছে। আমি আবার বিল্ডিংয়ে উঠি। ভান্তেকে নিচে নামাতে থাকি। তিনি ভীষণ শঙ্কিত হলেন। আমি ও আরেকজন তাঁর দুই বাহু চেপে ধরে দোতলা থেকে নেমে পড়লাম। ততক্ষণে মিছিলকারীদের একাংশ পাড়ায় ঢুকে পড়েছে। ভান্তেকে নিয়ে সিপন বড়ুয়ার বাসায় যাওয়ার সুযোগ হলো না। তাঁকে নিয়ে বিহারের পেছন দিয়ে ছুটলাম। তিনি ঠিকমতো পা চালাতে পারছিলেন না। আমাদের পিছু পিছু ছুটছেন বিহারের সব শ্রমণ ও ভিক্ষু। নালা-নর্দমা পেরিয়ে বড় ভান্তেকে কোনোমতে মানদা চরণের বাড়িতে ঢুকিয়ে দিলাম। আমি, শীলপ্রিয় ভান্তেসহ কজন আবার বিহারে ফিরে এলাম। মিছিলকারীরা গ্রিলের গেটের তালা ভেঙে একপর্যায়ে বিহারে ঢুকে পড়ে। আমরা দেখতে পেলাম, ওরা বিহারের সর্বত্র বিভিন্ন উপকরণ ছিটিয়ে দিচ্ছে। আমি রামু থানার ওসির সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছি। রিং বাজে কিন্তু তিনি রিসিভ করছেন না। কিছুক্ষণ পরে বিহারের কয়েক দিক থেকে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে ওঠে।
যেসব নারী-পুরুষ দূর থেকে রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে দেখছিলেন, তাঁদের অনেকে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। তাদের কান্নার শব্দ শুনে হামলাকারীদের কিছু লোক তাদের দিকে গালিগালাজ করে তেড়ে এল। ওরা সবাই কান্না করতে করতে পেছনে দৌড়াতে লাগল। হামলাকারীরা রাস্তার পাশের বাড়িগুলোতে ভাঙচুর শুরু করল। আমি থানার ওসির মোবাইলে বারবার ফোন করছিলাম, কিন্তু তিনি রিসিভ করছিলেন না। তাঁর সঙ্গে আমার পূর্ব পরিচয় ছিল। আমার যে নাম্বারটা তাঁর মোবাইলে সেভ করা আছে, ঠিক সেই নাম্বার থেকে ডায়াল করছিলাম। এরপর দেখি, তিনি কল কেটে দিচ্ছেন। প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা পর তিনি ফোন রিসিভ করলেন। আমি বললাম, দাদা, আমাদের সীমাবিহারে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। আপনি অন্তত লোকজনকে একটু নিরাপত্তা দিন। তিনি বললেন, ‘জি দাদা, আমি আসছি।’ ২০-২৫ মিনিট কেটে গেল, তিনি এলেন না। কিছুক্ষণ পর আবার অনুরোধ করলাম। তিনি আবারও আমাকে ভরসা দিলেন।
একপর্যায়ে হামলাকারীরা বিহারের ভেতর থেকে বেরিয়ে পড়ে। তখন প্রত্যক্ষদর্শী কয়েকজন চিৎকার দিয়ে বলল, ‘চলো, আমরা বিহারে পানি ঢালি।’ অনেক লোক এগিয়ে গেলেন। পানিও কয়েক বালতি ছুড়ে মারলেন। ওত পেতে থাকা হামলাকারীরা আবার ধাওয়া শুরু করল। আমরা আবার পিছু হটে এলাম। তারা তখন বড় বড় পাথরের ব্লক ছুড়ে মারছিল। অনেকের হাতে ধারালো অস্ত্র। অনেকক্ষণ তাণ্ডবলীলা চালিয়ে তারা চলে গেল। শতাধিক নারী-পুরুষ পানি ঢালা শুরু করলেন। ভাগ্য ভালো, বিহারের সামনেই পুকুর ছিল। জ্বলতে থাকা বিহারটিতে পানি ঢালতে ঢালতে তাঁরা কোনোমতে আগুন নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এলেন। কিছুক্ষণ পর দমকল বাহিনী সাইরেন বাজিয়ে ঢুকে পড়ল। উপস্থিত জনতা উত্তেজিত হয়ে বলল, ‘আগুন নেভানো হয়ে গেছে, এখন আবার পানি ঢালার দরকার হবে না।’ তাদের সঙ্গে জনতার অনেকক্ষণ বাগিবতণ্ডা হলো। প্রশাসনসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা চলে এলেন। পুলিশ অফিসারকে বললাম, আমাদের এখানে যা পোড়ার তা পুড়ে গেছে, দয়া করে আপনারা অন্য বিহারগুলো রক্ষা করুন। পুলিশ রওনা দিল বটে কিন্তু খবর নিয়ে জানতে পারি, তারা ভোর চারটা অবধি ঘটনাস্থলে পৌঁছতে পারেনি।
রাতের আঁধার কেটে গেল। রয়ে গেল রামুর সমৃদ্ধ পুরাকীর্তি, সম্প্রীতি, ঐতিহ্য ও সভ্যতার নিদর্শনের পোড়া গন্ধ। শত শত বছরের পুরোনো বিহার, বুদ্ধমূর্তি, ত্রিপিটক গ্রন্থ, বুদ্ধধাতুসহ অনেক অমূল্য সম্পদ জ্বলে-পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। রামুতে পরিদর্শন করার মতো আর বেশি কিছু রইল না। কক্সবাজারে প্রতিবছর যে বিপুলসংখ্যক দেশি-বিদেশি পর্যটকের আগমন ঘটে, তাঁরা সমুদ্রসৈকতের পাশাপাশি রামুর বৌদ্ধবিহার ও পুরাকীর্তিগুলোও দেখতে আসেন। রামু ধন্য হয়েছে এসব বৌদ্ধ পুরাকীর্তিকে গর্ভে ধারণ করে। আজ রামুর বুক খালি করা হয়েছে। আমরা ব্যথিত, মর্মাহত। আগুন ও লুটপাটে যা ক্ষতি হয়েছে তা আমরা কিছুটা হলেও পূরণ করতে পারব। কিন্তু সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ওপর যে ধাক্কা লাগানো হয়েছে, দেশের ভাবমূর্তি যেভাবে নষ্ট হয়েছে, তা কতটুকু পূরণ হয় জানি না। বিশ্ববাসী আমাদের কীভাবে জানল জানি না।
তবে আমরা এখনো আশা ছাড়িনি। আমরা শোকাহত-মর্মাহত কিন্তু এখনো আশাহত হইনি। আমরা সম্প্রীতি ও ভালোবাসার বন্ধনে এই দেশে বাঁচতে চাই। যা ঘটার ঘটে গেছে, আমরা যা হারানোর তা হারিয়েছি। নতুন করে হারানোর আর কিছুই নেই প্রাণ ছাড়া। ঘটনার পর এখন যা দেখা যাচ্ছে, তা আমাদের কাম্য নয়। এটিকে রাজনৈতিক ইস্যু করে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে কাদা ছোড়াছুড়ি হোক, আমরা তা মোটেই কামনা করি না। আলোচনায় আসছে জঙ্গিবাদ, মৌলবাদ ও রোহিঙ্গা ইস্যু। প্রত্যক্ষদর্শী ও ঘটনার শিকার হিসেবে আমি বলব, রামুর এই সহিংস ঘটনার জন্য কোনো নির্দিষ্ট একটি দল বা গোষ্ঠীকে দায়ী করা ঠিক হবে না। তদন্ত হওয়ার আগে থেকেই পারস্পরিক দোষারোপ চলতে থাকলে ঘটনার প্রকৃত রহস্য চাপা পড়ে যাবে, প্রকৃত অপরাধীরা পার পেয়ে যাবে। তা হলে এ ধরনের সহিংস ও সাম্প্রদায়িক অপরাধ রোধ করা যাবে না।
রামুর যেখানে জ্বালাও-পোড়াও ঘটেছে, তা দুর্গম এলাকা নয়। থানা-পুলিশ ও উপজেলা প্রশাসনের নাকের ডগায় অবস্থিত রামুর এসব বৌদ্ধবিহার ও পল্লি। ঘটনার ইঙ্গিত ও আশঙ্কা সন্ধ্যা থেকেই বিরাজ করছিল। প্রশাসন স্বয়ং তা প্রত্যক্ষ করেছে। জ্বালাও-পোড়াও, লুটপাট ও ভাঙচুর হয়েছে রাত প্রায় ১২টার পর। রামুর শ্রীকুল গ্রামের লাল চিং, সাদা চিং, মৈত্রী বিহার, অপর্ণাচরণ মন্দিরে রাত ১২টায় আগুন দিলেও রামু সীমাবিহারে আগুন দিয়েছে রাত একটার পর। রামুর উত্তর মিঠাছড়ি ভাবনা কেন্দ্রে রাত আড়াইটা-তিনটার দিকে এবং প্রজ্ঞামিত্র বনবিহারে আগুন দিয়েছে ভোর প্রায় চারটার দিকে। উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, সবখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী হাজির হয়েছে পুড়ে যাওয়ার পর। স্থানীয় প্রশাসনকে বারবার বলা হলেও তারা কোনো গুরুত্ব দেয়নি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যে সিদ্ধান্ত রাত দুইটার পরে নিয়েছে, সেটা রাত ১১টায় নিতে পারল না কেন?
স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের ব্যর্থতা আছে কি না, ঘটনার ইন্ধনদাতা কারা, পরিকল্পনাকারী কারা, হামলাকারী কারা, তা খতিয়ে না দেখে ঘটনাটি স্রেফ রাজনৈতিক ইস্যু বানানোর চেষ্টা চলছে। প্রশাসনিক তদন্তে আমাদের আস্থা নেই। আমরা বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি করছি। ঘটনার পর গণগ্রেপ্তার শুরু হয়েছে। এটাও আমাদের কাম্য নয়। নিরীহ-নিরপরাধ ব্যক্তিদের হয়রানি না করে দলমতের ঊর্ধ্বে থেকে সুষ্ঠুভাবে তদন্ত করে প্রকৃত দোষী ব্যক্তিদের আইনের আওতায় এনে বিচার করা হোক। রামুর এই ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে কয়েকটি বিহার রক্ষা পেয়েছে স্থানীয় মুসলিম সম্প্রদায়ের কিছু মানবতাবাদী লোকের প্রচেষ্টায়। এ ক্ষেত্রে প্রশাসন কোনো কাজে লাগেনি। আমরা সে রকম একটি মানবিক পরিবেশ চাই, যেখানে সুখ-দুঃখের সময় একজনের পাশে একজন দাঁড়াবে।
প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু: কেন্দ্রীয় সীমাবিহার, রামু।
যেসব নারী-পুরুষ দূর থেকে রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে দেখছিলেন, তাঁদের অনেকে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। তাদের কান্নার শব্দ শুনে হামলাকারীদের কিছু লোক তাদের দিকে গালিগালাজ করে তেড়ে এল। ওরা সবাই কান্না করতে করতে পেছনে দৌড়াতে লাগল। হামলাকারীরা রাস্তার পাশের বাড়িগুলোতে ভাঙচুর শুরু করল। আমি থানার ওসির মোবাইলে বারবার ফোন করছিলাম, কিন্তু তিনি রিসিভ করছিলেন না। তাঁর সঙ্গে আমার পূর্ব পরিচয় ছিল। আমার যে নাম্বারটা তাঁর মোবাইলে সেভ করা আছে, ঠিক সেই নাম্বার থেকে ডায়াল করছিলাম। এরপর দেখি, তিনি কল কেটে দিচ্ছেন। প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা পর তিনি ফোন রিসিভ করলেন। আমি বললাম, দাদা, আমাদের সীমাবিহারে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। আপনি অন্তত লোকজনকে একটু নিরাপত্তা দিন। তিনি বললেন, ‘জি দাদা, আমি আসছি।’ ২০-২৫ মিনিট কেটে গেল, তিনি এলেন না। কিছুক্ষণ পর আবার অনুরোধ করলাম। তিনি আবারও আমাকে ভরসা দিলেন।
একপর্যায়ে হামলাকারীরা বিহারের ভেতর থেকে বেরিয়ে পড়ে। তখন প্রত্যক্ষদর্শী কয়েকজন চিৎকার দিয়ে বলল, ‘চলো, আমরা বিহারে পানি ঢালি।’ অনেক লোক এগিয়ে গেলেন। পানিও কয়েক বালতি ছুড়ে মারলেন। ওত পেতে থাকা হামলাকারীরা আবার ধাওয়া শুরু করল। আমরা আবার পিছু হটে এলাম। তারা তখন বড় বড় পাথরের ব্লক ছুড়ে মারছিল। অনেকের হাতে ধারালো অস্ত্র। অনেকক্ষণ তাণ্ডবলীলা চালিয়ে তারা চলে গেল। শতাধিক নারী-পুরুষ পানি ঢালা শুরু করলেন। ভাগ্য ভালো, বিহারের সামনেই পুকুর ছিল। জ্বলতে থাকা বিহারটিতে পানি ঢালতে ঢালতে তাঁরা কোনোমতে আগুন নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এলেন। কিছুক্ষণ পর দমকল বাহিনী সাইরেন বাজিয়ে ঢুকে পড়ল। উপস্থিত জনতা উত্তেজিত হয়ে বলল, ‘আগুন নেভানো হয়ে গেছে, এখন আবার পানি ঢালার দরকার হবে না।’ তাদের সঙ্গে জনতার অনেকক্ষণ বাগিবতণ্ডা হলো। প্রশাসনসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা চলে এলেন। পুলিশ অফিসারকে বললাম, আমাদের এখানে যা পোড়ার তা পুড়ে গেছে, দয়া করে আপনারা অন্য বিহারগুলো রক্ষা করুন। পুলিশ রওনা দিল বটে কিন্তু খবর নিয়ে জানতে পারি, তারা ভোর চারটা অবধি ঘটনাস্থলে পৌঁছতে পারেনি।
রাতের আঁধার কেটে গেল। রয়ে গেল রামুর সমৃদ্ধ পুরাকীর্তি, সম্প্রীতি, ঐতিহ্য ও সভ্যতার নিদর্শনের পোড়া গন্ধ। শত শত বছরের পুরোনো বিহার, বুদ্ধমূর্তি, ত্রিপিটক গ্রন্থ, বুদ্ধধাতুসহ অনেক অমূল্য সম্পদ জ্বলে-পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। রামুতে পরিদর্শন করার মতো আর বেশি কিছু রইল না। কক্সবাজারে প্রতিবছর যে বিপুলসংখ্যক দেশি-বিদেশি পর্যটকের আগমন ঘটে, তাঁরা সমুদ্রসৈকতের পাশাপাশি রামুর বৌদ্ধবিহার ও পুরাকীর্তিগুলোও দেখতে আসেন। রামু ধন্য হয়েছে এসব বৌদ্ধ পুরাকীর্তিকে গর্ভে ধারণ করে। আজ রামুর বুক খালি করা হয়েছে। আমরা ব্যথিত, মর্মাহত। আগুন ও লুটপাটে যা ক্ষতি হয়েছে তা আমরা কিছুটা হলেও পূরণ করতে পারব। কিন্তু সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ওপর যে ধাক্কা লাগানো হয়েছে, দেশের ভাবমূর্তি যেভাবে নষ্ট হয়েছে, তা কতটুকু পূরণ হয় জানি না। বিশ্ববাসী আমাদের কীভাবে জানল জানি না।
তবে আমরা এখনো আশা ছাড়িনি। আমরা শোকাহত-মর্মাহত কিন্তু এখনো আশাহত হইনি। আমরা সম্প্রীতি ও ভালোবাসার বন্ধনে এই দেশে বাঁচতে চাই। যা ঘটার ঘটে গেছে, আমরা যা হারানোর তা হারিয়েছি। নতুন করে হারানোর আর কিছুই নেই প্রাণ ছাড়া। ঘটনার পর এখন যা দেখা যাচ্ছে, তা আমাদের কাম্য নয়। এটিকে রাজনৈতিক ইস্যু করে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে কাদা ছোড়াছুড়ি হোক, আমরা তা মোটেই কামনা করি না। আলোচনায় আসছে জঙ্গিবাদ, মৌলবাদ ও রোহিঙ্গা ইস্যু। প্রত্যক্ষদর্শী ও ঘটনার শিকার হিসেবে আমি বলব, রামুর এই সহিংস ঘটনার জন্য কোনো নির্দিষ্ট একটি দল বা গোষ্ঠীকে দায়ী করা ঠিক হবে না। তদন্ত হওয়ার আগে থেকেই পারস্পরিক দোষারোপ চলতে থাকলে ঘটনার প্রকৃত রহস্য চাপা পড়ে যাবে, প্রকৃত অপরাধীরা পার পেয়ে যাবে। তা হলে এ ধরনের সহিংস ও সাম্প্রদায়িক অপরাধ রোধ করা যাবে না।
রামুর যেখানে জ্বালাও-পোড়াও ঘটেছে, তা দুর্গম এলাকা নয়। থানা-পুলিশ ও উপজেলা প্রশাসনের নাকের ডগায় অবস্থিত রামুর এসব বৌদ্ধবিহার ও পল্লি। ঘটনার ইঙ্গিত ও আশঙ্কা সন্ধ্যা থেকেই বিরাজ করছিল। প্রশাসন স্বয়ং তা প্রত্যক্ষ করেছে। জ্বালাও-পোড়াও, লুটপাট ও ভাঙচুর হয়েছে রাত প্রায় ১২টার পর। রামুর শ্রীকুল গ্রামের লাল চিং, সাদা চিং, মৈত্রী বিহার, অপর্ণাচরণ মন্দিরে রাত ১২টায় আগুন দিলেও রামু সীমাবিহারে আগুন দিয়েছে রাত একটার পর। রামুর উত্তর মিঠাছড়ি ভাবনা কেন্দ্রে রাত আড়াইটা-তিনটার দিকে এবং প্রজ্ঞামিত্র বনবিহারে আগুন দিয়েছে ভোর প্রায় চারটার দিকে। উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, সবখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী হাজির হয়েছে পুড়ে যাওয়ার পর। স্থানীয় প্রশাসনকে বারবার বলা হলেও তারা কোনো গুরুত্ব দেয়নি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যে সিদ্ধান্ত রাত দুইটার পরে নিয়েছে, সেটা রাত ১১টায় নিতে পারল না কেন?
স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের ব্যর্থতা আছে কি না, ঘটনার ইন্ধনদাতা কারা, পরিকল্পনাকারী কারা, হামলাকারী কারা, তা খতিয়ে না দেখে ঘটনাটি স্রেফ রাজনৈতিক ইস্যু বানানোর চেষ্টা চলছে। প্রশাসনিক তদন্তে আমাদের আস্থা নেই। আমরা বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি করছি। ঘটনার পর গণগ্রেপ্তার শুরু হয়েছে। এটাও আমাদের কাম্য নয়। নিরীহ-নিরপরাধ ব্যক্তিদের হয়রানি না করে দলমতের ঊর্ধ্বে থেকে সুষ্ঠুভাবে তদন্ত করে প্রকৃত দোষী ব্যক্তিদের আইনের আওতায় এনে বিচার করা হোক। রামুর এই ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে কয়েকটি বিহার রক্ষা পেয়েছে স্থানীয় মুসলিম সম্প্রদায়ের কিছু মানবতাবাদী লোকের প্রচেষ্টায়। এ ক্ষেত্রে প্রশাসন কোনো কাজে লাগেনি। আমরা সে রকম একটি মানবিক পরিবেশ চাই, যেখানে সুখ-দুঃখের সময় একজনের পাশে একজন দাঁড়াবে।
প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু: কেন্দ্রীয় সীমাবিহার, রামু।
No comments