সাগর-রুনি হত্যা-বন্ধু তানভীরসহ পেশাদার খুনিদের কাজ : স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী-এড়িয়ে গেলেন অনেক প্রশ্ন

তড়িঘড়ি সংবাদ সম্মেলন ডেকে চাঞ্চল্যকর সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে নতুন মাত্রা যোগ করলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর। সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নেওয়ার পর তিনি আশ্বাস দেন, ১০ অক্টোবরের মধ্যে এই সাংবাদিক দম্পতির হত্যারহস্য উদ্ঘাটিত হবে।


এর এক দিন আগে গতকাল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদের ডেকে বলেছেন, চাঞ্চল্যকর এ খুন পেশাদার খুনিচক্রের কাজ এবং এর সঙ্গে পারিবারিক একজন বন্ধু তানভীরসহ বাড়ির দারোয়ান জড়িত। তবে পেশাদার খুনিদের কাজ হলে এর সঙ্গে একজন পারিবারিক বন্ধুর যোগসূত্র কী হতে পারে- সাংবাদিকদের এ প্রশ্নের কোনো উত্তর দেননি মন্ত্রী।
রুনির ভাই ও হত্যা মামলার বাদী নওশের আলম রোমান কালের কণ্ঠকে বলেছেন, তাঁরা তানভীর নামে রুনির কোনো বন্ধুকে চেনেন না। সাগর-রুনি খুন হওয়ার পরই তাঁরা নামটি শোনেন। একইভাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দেওয়া কিছু তথ্যের ব্যাপারে প্রশ্ন তুলে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সভাপতি সাখাওয়াত হোসেন বাদশা বলেছেন, 'জোড়া খুনের খণ্ডচিত্র উপস্থাপন করা হয়েছে। আশা করি, সরকার অনতিবিলম্বে প্রকৃত মোটিভ স্পষ্ট করবে।'
গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে নিজ মন্ত্রণালয়ের সম্মেলনকক্ষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এ সংবাদ সম্মেলন ডেকে বলেন, সাংবাদিক দম্পতি খুনের ঘটনায় সাতজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের মধ্যে সাংবাদিক দম্পতির পারিবারিক বন্ধু তানভীর ছাড়াও তাঁদের বাড়ির এক পাহারাদার রয়েছে। অন্য পাঁচজন ডা. নারায়ণচন্দ্র দত্ত নিতাই হত্যা মামলার আসামি। তবে এই হত্যাকাণ্ডের মোটিভ কী ছিল, কাজটি পেশাদার খুনিদের হলে এর সঙ্গে একজন পারিবারিক বন্ধুর যোগসূত্রতা কী- এসব প্রশ্ন এড়িয়ে যান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। ফলে জোড়া খুনের রহস্য প্রকারান্তরে আরো ঘনীভূত হয়।
সংবাদ সম্মেলনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, 'এ যাবৎ সাতজন অপরাধীকে শনাক্ত ও গ্রেপ্তার করতে সমর্থ হয়েছি। এরা হচ্ছে রফিক, মিন্টু, সাঈদ, বকুল ও ডা. নিতাইয়ের গাড়িচালক কামরুল। সাগর-রুনির পারিবারিক বন্ধু তানভীরকেও অপরাধী হিসেবে শনাক্ত করেছি। এ ছাড়া সাগর-রুনিদের বাসার দুই পাহারাদারের একজন রুদ্র পলাশকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অন্য পাহারাদার হুমায়ুন কবির ওরফে এনামুল পলাতক রয়েছে। তাকে কেউ ধরিয়ে দিলে ১০ লাখ টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে।' মন্ত্রী বলেন, হত্যাকারী দলে চারজন ছিল, যারা পেশাদার খুনি।
সংবাদ সম্মেলনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদের একের পর এক প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে কোনো কোনো সময় বিব্রতকর অবস্থায় পড়েন। কোনো কোনো প্রশ্নের জবাবও তিনি দিতে পারেননি। তিনি সংবাদ সম্মেলনে বলেন, পেশাদার খুনিরা এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত রয়েছে। তবে এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে পেশাদার খুনিদের কী সম্পর্ক থাকতে পারে কিংবা এই হত্যাকাণ্ডের মূল কারণ কী- এসব প্রশ্নের উত্তর তিনি দিতে পারেননি। আবার সাংবাদিকরা যখন প্রশ্ন করেন, খুনিরা ভাড়াটে ছিল কি না- তখনো তিনি বিষয়টি স্পষ্ট করতে পারেননি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, খুনিরা ভাড়াটে হতে পারে। এভাবেই সাংবাদিকদের কোনো প্রশ্নের জবাব এড়িয়ে আবার কোনো কোনো প্রশ্নের স্পষ্ট জবাব না দিয়ে তাড়াতাড়ি শেষ করেন সংবাদ সম্মেলন।
গতকাল সকাল থেকেই সাংবাদিকদের অনেকে এই হত্যা রহস্যের ব্যাপারে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কী বলেন তা জানতে উদগ্রীব ছিলেন। একপর্যায়ে মন্ত্রণালয় থেকে আশ্বাস মেলে, বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এ ব্যাপারে কথা বলবেন। সাংবাদিকদের ডেকে নিয়ে তিনি এই জোড়া হত্যার কিছু তথ্য তুলে ধরেন।
এই খুনের কারণ কী ছিল- জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, 'এটি সুনির্দিষ্ট করা যায়নি। তবে আমরা ভাড়াটে খুনিদের কাজ ও পরিচিতদের কাণ্ড এই দুভাবেই ঘটতে পারে বলে ধারণা করছি। ডিএনএ টেস্টে আরো অপরাধীর সাযুজ্য পেলে তাদেরকে আইনের আওতায় আনা হবে।'
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদের আরো বলেন, 'আমরা জজ মিয়ার মতো নাটক সাজাতে চাই না। নাটক সাজাতে আসিনি। আওয়ামী লীগ সরকার এ ধরনের কাজ করে না। জনগণের প্রতিনিধিত্ব করে।' খুনি ভাড়াটিয়া কি না জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, খুনি ভাড়াটিয়া হতে পারে।
সংবাদ সম্মেলনে অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট শামসুল হক টুকু, স্বরাষ্ট্রসচিব সি কিউ কে মুসতাক আহমেদ, র‌্যাবের মিডিয়া উইংয়ের প্রধান এস এম সোহায়েল প্রমুখ।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনের পর রুনির ভাই ও হত্যা মামলার বাদী নওশের আলম রোমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমরা প্রকৃত খুনি বা খুনিদের গ্রেপ্তার হওয়ার অপেক্ষায় আছি। পারিবারিক বন্ধু হিসেবে তানভীর নামে যার কথা বলা হচ্ছে, তাকে পারিবারিকভাবে চিনি না। সংবাদ সম্মেলনে প্রকাশ হওয়া তথ্যগুলো আমার কাছে ততটা পরিষ্কার নয়। এ ব্যাপারে আরো স্পষ্টতা দরকার।'
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দেওয়া কিছু তথ্যের ব্যাপারে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সভাপতি সাখাওয়াত হোসেন বাদশা কালের কণ্ঠকে বলেন, 'এখানে এই জোড়া খুনের খণ্ডচিত্র উপস্থাপন করা হয়েছে। আশা করি, সরকার অনতিবিলম্বে প্রকৃত মোটিভ স্পষ্ট করবে। তবে আমরা এ-ও বলতে চাই, হত্যা রহস্য নিয়ে কোনো ধরনের নাটক যেন সাজানো না হয়। আমরা আট মাস ধরে আন্দোলন করছি। আমরা রহস্য জানার দাবি জানিয়ে, খুনি কে তা জানতে উদগ্রীব ছিলাম। এত দিন একটা ধোঁয়াশার মধ্যে ছিলাম। আজ জানতে পারলাম, এই হত্যাকাণ্ডে তানভীর নামে কেউ জড়িত রয়েছে, যে কিনা সাগর-রুনির বন্ধু ছিল। আমরা বলব, অচিরেই এসব দাবির সত্যতা নির্ণয় করে তা জাতির কাছে প্রকাশ করা হোক। ১১ অক্টোবর সাগর-রুনির শোকসভা হবে জাতীয় প্রেসক্লাবে। এই সভার আগেই আমরা বৈঠক করব।' এর আগে সাংবাদিক নেতারা ঘোষণা দিয়েছিলেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তাঁর দেওয়া প্রতিশ্রুতিমতো ১০ অক্টোবরের মধ্যে এ হত্যা রহস্যের কিনারা না করলে গণতদন্ত দল ও গণ-আদালত প্রতিষ্ঠা করা হবে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নেওয়ার পর মহীউদ্দীন খান আলমগীর গত ২৫ সেপ্টেম্বর আশ্বাস দেন, ১০ অক্টোবরের মধ্যে সাংবাদিক দম্পতির হত্যা রহস্য উদ্ঘাটন করা সম্ভব হবে। এরপর সাংবাদিক নেতারা ঘোষণা দেন, এই তারিখের মধ্যে এ হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য পাওয়া না গেলে ১৫ অক্টোবর ঢাকায় সাংবাদিকদের মহাসমাবেশ থেকে কঠোর আন্দোলনের কর্মসূচি দেওয়া হবে। আগামীকাল সাগর-রুনি হত্যার আট মাস পূর্ণ হচ্ছে। এ দিন তাঁদের স্মরণে জাতীয় প্রেসক্লাবে শোকসভা করবেন সাংবাদিকরা।
সম্প্রতি রাজধানীর বক্ষব্যাধি হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক ডা. নারায়ণচন্দ্র দত্ত নিতাই নিজ বাসভবনে খুন হন এবং এরপর এ ঘটনায় জড়িত সন্দেহে কয়েক ব্যক্তিকে আটক করা হয়। এই একই চক্র সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড ঘটায় বলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী গতকাল সাংবাদিকদের তথ্য দেন।
গত ১১ ফেব্রুয়ারি রাজধানীতে নিজের বাসায় খুন হন মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক সাগর সরওয়ার ও এটিএন বাংলার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক মেহেরুন রুনি। হত্যাকাণ্ডের পরপরই তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে খুনিকে ধরার জন্য পুলিশকে নির্দেশ দেন। তবে খুনি আর ধরা পড়েনি।

No comments

Powered by Blogger.