বীর মুক্তিযোদ্ধা- তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না
৫৩৬ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। আমিন উল্লাহ শেখ, বীর বিক্রম সফল এক নৌ মুক্তিযোদ্ধা মুক্তিযুদ্ধকালে মুক্তিবাহিনীর নৌ মুক্তিযোদ্ধারা কেন্দ্রীয় পরিকল্পনায় আগস্ট মাসে একযোগে কয়েকটি সফল অপারেশন পরিচালনা করেন।
এতে পাকিস্তান সরকারের ভিত কেঁপে ওঠে। বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে হইচই পড়ে। এর সাংকেতিক নাম ছিল ‘অপারেশন জ্যাকপট’।
এরপর নৌ মুক্তিযোদ্ধারা বাংলাদেশ থেকে ভারতে ফিরে যান। কিছুদিন পর তাঁরা কয়েকটি দলে বিভক্ত হয়ে আবার বাংলাদেশে রওনা হন। আমিন উল্লাহ শেখের নেতৃত্বে ২৬ জনের একটি দল রওনা হয় চাঁদপুরের উদ্দেশে। অক্টোবর মাসের শেষে তাঁরা চাঁদপুরে পৌঁছান।
এবার আগের মতো কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা ছিল না। কোনো নির্দিষ্ট এলাকা বা সময় বেঁধে দেওয়া হয়নি। প্রতিটি দলের দলনেতা সহযোদ্ধাদের সঙ্গে আলোচনা করে টার্গেট নির্ধারণ করতেন। দ্বিতীয় পর্যায়ে আমিন উল্লাহ শেখরা চাঁদপুরে অনেকগুলো অপারেশন করেন। এর মধ্যে বার্মা ইস্টার্ন (বর্তমানে মেঘনা) কোম্পানির তেলের ডিপো, এমভি লোরেম, এমভি স্বামী, এমভি লিলিসহ চীনা পতাকাবাহী জাহাজ ও পাকিস্তান নৌবাহিনীর গানবোট ধ্বংস উল্লেখযোগ্য।
৩০ অক্টোবর রাতে তাঁরা দুটি দলে বিভক্ত হয়ে একই সময় দুটি অপারেশন করেন। আমিন উল্লাহ শেখ পরিকল্পনা করেছিলেন ওই রাতে তাঁরা চাঁদপুরের ভাটিতে নীলকমলের কাছে অপারেশন করবেন। সেখানে রাতে পাকিস্তানি সেনা ও নৌবাহিনীর কয়েকটি গানবোট নোঙর করা থাকত।
এদিকে ডাকাতিয়া নদীর লন্ডন ঘাটে আমেরিকান পতাকাবাহী এমভি লোরেমও সেদিন নোঙর করা ছিল। জাহাজটি পাকিস্তানিদের জন্য খাদ্য ও সমরাস্ত্র বহন করে সেখানে আসে। এ খবর আমিন উল্লাহ শেখ সে দিনই জানতে পারেন। তিনি সহযোদ্ধাদের সঙ্গে আলোচনা করে একই দিন ওই জাহাজেও অভিযান পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেন।
তাঁর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয় পাকিস্তানি গানবোট ধ্বংসের অভিযান। অপর দল এমভি লোরেম জাহাজ ধ্বংস করে। নীলকমলে নিরাপত্তাব্যবস্থা ছিল অত্যন্ত মজবুত। এরই মধ্যে সে দিন তাঁর সহযোদ্ধারা দুঃসাহসিকতার সঙ্গে মাইন লাগিয়ে পাকিস্তানি নৌবাহিনীর একটি গানবোট ডুবিয়ে দেন।
দুর্ধর্ষ নৌ-মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণ পাকিস্তানিরা কঠোর নিরাপত্তাবলয় তৈরি করেও প্রতিরোধ করতে পারেনি। অন্যদিকে লন্ডন ঘাটে ডুবে যাওয়া ‘এমভি লোরেম’ স্বাধীনতার পর তিন দশক ওই অভিযানের স্মৃতি বহন করে। তখন পর্যন্ত সেটি উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।
মুক্তিযুদ্ধকালের এসব অভিযানের ধরন ও বিবরণ এখন মনে হয় একই রকম। কিন্তু বাস্তবে কোনো ঘটনাই এক রকম ছিল না। স্থান ও অবস্থানভেদে প্রতিটি অভিযান ছিল ভিন্ন রকমের। সুচিন্তিত পরিকল্পনা করে মুক্তিযোদ্ধাদের এক একটি অভিযান সফল করতে হয়েছে।
আমিন উল্লাহ শেখ পাকিস্তানি নৌবাহিনীতে ইলেকট্রিক আর্টিফিসার (ইএ) পদে চাকরি করতেন। ১৯৭১ সালে ফ্রান্সের তুলন নৌঘাঁটিতে সাবমেরিনার হিসেবে প্রশিক্ষণে ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ৩১ মার্চ আরও সাতজন বাঙালি সাবমেরিনারের সঙ্গে তুলন থেকে পালিয়ে অনেক বাধাবিপত্তি অতিক্রম করে ভারতে যান। পরে তিনি মুক্তিবাহিনীর নৌ-উইংয়ে অন্তর্ভুক্ত হন।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্ব প্রদর্শনের জন্য আমিন উল্লাহ শেখকে বীর বিক্রম খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ১২৭।
আমিন উল্লাহ শেখ স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ নৌবাহিনীতে কমিশন লাভ করেন। লেফটেন্যান্ট পদে কর্মরত থাকাবস্থায় আশির দশকে চাকরিচ্যুত হন। পরে তিনি বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনে কিছুদিন চাকরি করেন। ১৯৯৯ সালে মারা গেছেন। তাঁর পৈতৃক বাড়ি চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জ উপজেলার পাইকপাড়া গ্রামে। তাঁর বাবার নাম নোয়াব আলী শেখ, মা মাহমুদা খাতুন। স্ত্রী আয়েশা বেগম। তাঁর এক মেয়ে, ছয় ছেলে। উত্তরাধিকারীরা বর্তমানে চট্টগ্রাম মহানগরের পশ্চিম নাসিরাবাদে গ্রিনভিউ হাউজিংয়ে বসবাস করেন।
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধে নৌ-অভিযান, কমান্ডো মো. খলিলুর রহমান।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
rashedtr@prothom-alo.info
এরপর নৌ মুক্তিযোদ্ধারা বাংলাদেশ থেকে ভারতে ফিরে যান। কিছুদিন পর তাঁরা কয়েকটি দলে বিভক্ত হয়ে আবার বাংলাদেশে রওনা হন। আমিন উল্লাহ শেখের নেতৃত্বে ২৬ জনের একটি দল রওনা হয় চাঁদপুরের উদ্দেশে। অক্টোবর মাসের শেষে তাঁরা চাঁদপুরে পৌঁছান।
এবার আগের মতো কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা ছিল না। কোনো নির্দিষ্ট এলাকা বা সময় বেঁধে দেওয়া হয়নি। প্রতিটি দলের দলনেতা সহযোদ্ধাদের সঙ্গে আলোচনা করে টার্গেট নির্ধারণ করতেন। দ্বিতীয় পর্যায়ে আমিন উল্লাহ শেখরা চাঁদপুরে অনেকগুলো অপারেশন করেন। এর মধ্যে বার্মা ইস্টার্ন (বর্তমানে মেঘনা) কোম্পানির তেলের ডিপো, এমভি লোরেম, এমভি স্বামী, এমভি লিলিসহ চীনা পতাকাবাহী জাহাজ ও পাকিস্তান নৌবাহিনীর গানবোট ধ্বংস উল্লেখযোগ্য।
৩০ অক্টোবর রাতে তাঁরা দুটি দলে বিভক্ত হয়ে একই সময় দুটি অপারেশন করেন। আমিন উল্লাহ শেখ পরিকল্পনা করেছিলেন ওই রাতে তাঁরা চাঁদপুরের ভাটিতে নীলকমলের কাছে অপারেশন করবেন। সেখানে রাতে পাকিস্তানি সেনা ও নৌবাহিনীর কয়েকটি গানবোট নোঙর করা থাকত।
এদিকে ডাকাতিয়া নদীর লন্ডন ঘাটে আমেরিকান পতাকাবাহী এমভি লোরেমও সেদিন নোঙর করা ছিল। জাহাজটি পাকিস্তানিদের জন্য খাদ্য ও সমরাস্ত্র বহন করে সেখানে আসে। এ খবর আমিন উল্লাহ শেখ সে দিনই জানতে পারেন। তিনি সহযোদ্ধাদের সঙ্গে আলোচনা করে একই দিন ওই জাহাজেও অভিযান পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেন।
তাঁর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয় পাকিস্তানি গানবোট ধ্বংসের অভিযান। অপর দল এমভি লোরেম জাহাজ ধ্বংস করে। নীলকমলে নিরাপত্তাব্যবস্থা ছিল অত্যন্ত মজবুত। এরই মধ্যে সে দিন তাঁর সহযোদ্ধারা দুঃসাহসিকতার সঙ্গে মাইন লাগিয়ে পাকিস্তানি নৌবাহিনীর একটি গানবোট ডুবিয়ে দেন।
দুর্ধর্ষ নৌ-মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণ পাকিস্তানিরা কঠোর নিরাপত্তাবলয় তৈরি করেও প্রতিরোধ করতে পারেনি। অন্যদিকে লন্ডন ঘাটে ডুবে যাওয়া ‘এমভি লোরেম’ স্বাধীনতার পর তিন দশক ওই অভিযানের স্মৃতি বহন করে। তখন পর্যন্ত সেটি উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।
মুক্তিযুদ্ধকালের এসব অভিযানের ধরন ও বিবরণ এখন মনে হয় একই রকম। কিন্তু বাস্তবে কোনো ঘটনাই এক রকম ছিল না। স্থান ও অবস্থানভেদে প্রতিটি অভিযান ছিল ভিন্ন রকমের। সুচিন্তিত পরিকল্পনা করে মুক্তিযোদ্ধাদের এক একটি অভিযান সফল করতে হয়েছে।
আমিন উল্লাহ শেখ পাকিস্তানি নৌবাহিনীতে ইলেকট্রিক আর্টিফিসার (ইএ) পদে চাকরি করতেন। ১৯৭১ সালে ফ্রান্সের তুলন নৌঘাঁটিতে সাবমেরিনার হিসেবে প্রশিক্ষণে ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ৩১ মার্চ আরও সাতজন বাঙালি সাবমেরিনারের সঙ্গে তুলন থেকে পালিয়ে অনেক বাধাবিপত্তি অতিক্রম করে ভারতে যান। পরে তিনি মুক্তিবাহিনীর নৌ-উইংয়ে অন্তর্ভুক্ত হন।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্ব প্রদর্শনের জন্য আমিন উল্লাহ শেখকে বীর বিক্রম খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ১২৭।
আমিন উল্লাহ শেখ স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ নৌবাহিনীতে কমিশন লাভ করেন। লেফটেন্যান্ট পদে কর্মরত থাকাবস্থায় আশির দশকে চাকরিচ্যুত হন। পরে তিনি বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনে কিছুদিন চাকরি করেন। ১৯৯৯ সালে মারা গেছেন। তাঁর পৈতৃক বাড়ি চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জ উপজেলার পাইকপাড়া গ্রামে। তাঁর বাবার নাম নোয়াব আলী শেখ, মা মাহমুদা খাতুন। স্ত্রী আয়েশা বেগম। তাঁর এক মেয়ে, ছয় ছেলে। উত্তরাধিকারীরা বর্তমানে চট্টগ্রাম মহানগরের পশ্চিম নাসিরাবাদে গ্রিনভিউ হাউজিংয়ে বসবাস করেন।
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধে নৌ-অভিযান, কমান্ডো মো. খলিলুর রহমান।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
rashedtr@prothom-alo.info
No comments