বিশেষ সাক্ষাৎকার : ড. এম. আবদুস সোবহান-শিক্ষাঙ্গনের অস্থিরতায় রাজনৈতিক ইন্ধন থাকতে পারে

সামান্য কারণেই উত্তপ্ত হয়ে উঠছে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। ছাত্রসংগঠনগুলোর মধ্যে সৃষ্ট সংঘর্ষে প্রাণহানির ঘটনাও ঘটছে। সম্প্রতি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ ও ছাত্রশিবিরের মধ্যে সশস্ত্র সংঘাতের ছবি সংবাদপত্রে প্রকাশিত হলে রাজনীতি সম্পর্কে জনমনে নেতিবাচক মনোভাবের সৃষ্টি হয়।


পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বর্তমান অবস্থা, ছাত্ররাজনীতি, ছাত্র সংসদের নির্বাচনসহ বিভিন্ন বিষয়ে কালের কণ্ঠকে বলেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. এম. আবদুস সোবহান। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আলী হাবিব
কালের কণ্ঠ : সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে, দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো একটুতেই উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। সৃষ্টি হচ্ছে সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি। দেশের উচ্চশিক্ষার বিদ্যাপীঠগুলোতে এমন হচ্ছে কেন?
এম. আবদুস সোবহান : ১৯৭৫-পরবর্তী অগণতান্ত্রিক স্বৈরশাসকরা ছাত্ররাজনীতিতে পচন ধরিয়েছে; যার ধারাবাহিকতা এখনো চলছে। ছাত্ররাজনীতির গুণগত পরিবর্তন না হওয়ার জের ও বর্তমানে মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারপ্রক্রিয়া ভণ্ডুল করার জন্য স্বাধীনতাবিরোধী প্রতিক্রিয়াশীল ধর্মান্ধ গোষ্ঠী দেশজুড়ে তথা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহে, বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি সৃষ্টি করে চলেছে।
কালের কণ্ঠ : বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এ অস্থিরতার নেপথ্যে রাজনৈতিক ইন্ধন আছে বলে মনে করেন কি?
এম. আবদুস সোবহান : অস্থিরতার নেপথ্যে রাজনৈতিক ইন্ধন থাকতে পারে, এমন ভাবনা অমূলক নয়।
কালের কণ্ঠ : বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে, ধারণা করা যেতে পারে, একসঙ্গে খুব বেশি হলে ১ শতাংশ শিক্ষার্থী জড়িত। কিন্তু এদের কারণে বাকি ৯৯ শতাংশ শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবনে অনিশ্চয়তা দেখা দিচ্ছে। এ অবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের করণীয় কী?
এম. আবদুস সোবহান : শতাংশের হিসাবে না গিয়েও বলা যায়, কিছুসংখ্যক ছাত্র নামধারীর অছাত্রসুলভ কার্যক্রমের জন্য প্রায় সব শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবনে চরম ভোগান্তির সৃষ্টি হয়। ১৯৭৩-এর অধ্যাদেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাস্বরূপ জরিমানা, বহিষ্কার ও ছাত্রত্ব বাতিল করা যায়। তবে এ ব্যবস্থা এ অবস্থার স্থায়ী সমাধান আনতে পারে না।
কালের কণ্ঠ : আপনার বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্প্রতি দুটি ছাত্রসংগঠনের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে। ব্যবহৃত হয়েছে আগ্নেয়াস্ত্র। শিক্ষা উপকরণের বদলে অস্ত্র- এই দৃশ্য আর কতকাল দেখতে হবে আমাদের? এ থেকে প্রতিকারের উপায় কী?
এম. আবদুস সোবহান : ষাট ও সত্তরের দশকে ছাত্ররাজনীতিতে ছোটখাটো সংঘর্ষ যে হতো না তা নয়; তবে সেটি হকিস্টিক, বড়জোর চাকুর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। আগেই বলেছি, স্বৈরশাসকরা তাদের ক্ষমতা চিরস্থায়ী করতে ছাত্রদের হাতে অর্থ ও অস্ত্র তুলে দিয়েছে। এর ফলে অনেক মেধাবী ছাত্রের জীবন নষ্ট হয়েছে। যত দিন ছাত্ররাজনীতির গুণগত পরিবর্তন না হবে (আর এই পরিবর্তনের জন্য মেধাবীদের ছাত্ররাজনীতিতে আসতে হবে), তত দিন অসহায়ের মতো আমাদের এ দৃশ্য দেখতে হবে।
কালের কণ্ঠ : যে দলেরই সমর্থক হোক না কেন, শিক্ষার্থী যখন সন্ত্রাসীর ভূমিকায় অবতীর্ণ, তখন তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বাধা কোথায়? ১ শতাংশের জন্য ৯৯ শতাংশের শিক্ষাজীবন কি নষ্ট হতে দেওয়া যায়?
এম. আবদুস সোবহান : দল-মত বিষয় নয়, ছাত্র যখন সন্ত্রাসী হয় তখন সে আর ছাত্র থাকে না এবং তার কোনো দলও থাকে না- তার একটাই পরিচয়, সে সন্ত্রাসী। কিছুসংখ্যকের সন্ত্রাসী কার্যকলাপের জন্য বৃহদাংশের শিক্ষাজীবন কোনোক্রমেই নষ্ট হতে দেওয়া যায় না।
কালের কণ্ঠ : ছাত্রলীগ ও ছাত্রশিবিরের কর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষের পর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে কী ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে?
এম. আবদুস সোবহান : বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে একটি মামলা করা হয়েছে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা তদন্ত করে সংশ্লিষ্ট সন্ত্রাসীদের আইনের আওতায় আনবে।
কালের কণ্ঠ : অনেকে বলে থাকেন, ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করে দিলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিত হবে। আপনিও কি তাই মনে করেন?
এম. আবদুস সোবহান : মাথাব্যথা সারাতে মাথা কেটে ফেলা কোনো প্রেসক্রিপশন হতে পারে না।
কালের কণ্ঠ : ছাত্ররাজনীতির পাশাপাশি শিক্ষকরাজনীতিও এখন আলোচনায়। শিক্ষকদের এভাবে দলীয় ফোরামে বা পরিচয়ে পরিচিত হওয়া উচিত হচ্ছে কি?
এম. আবদুস সোবহান : শিক্ষিত মানুষ রাজনীতি সচেতন হবেন, শিক্ষকদেরও রাজনৈতিক দর্শন থাকবে- সত্য, সুন্দর, ন্যায় ও কল্যাণকামী দর্শন। এই দর্শন কোনো রাজনৈতিক দলের আদর্শের সঙ্গে মিলেও যেতে পারে। অন্য কথায় একজন শিক্ষক কোনো দলীয় রাজনীতির আদর্শে বিশ্বাসী হলে দোষের কিছু নেই। তবে এ কথা প্রণিধানযোগ্য, একজন শিক্ষক প্রথমতও শিক্ষক এবং শেষ পর্যন্তও শিক্ষক- তাঁর রাজনীতি একজন রাজনীতিকের রাজনীতির মতো হওয়া উচিত নয়।
কালের কণ্ঠ : বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয় না দীর্ঘদিন। আপনার বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচন নিয়ে কী ভাবছেন? আপনি কি নির্বাচন দিতে চান?
এম. আবদুস সোবহান : উপাচার্যের দায়িত্ব গ্রহণের পর আমার ভাবনা বা পরিকল্পনাগুলোর মধ্যে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের (রাকসু) বিষয়টি ছিল এবং এখনো আছে; যা বহু অনুষ্ঠানে-সাক্ষাৎকারে আমি বলেছি। কিন্তু কোনো ছাত্রসংগঠনের পক্ষ থেকেই এ বিষয়ে সাড়া পাওয়া যায়নি।
কালের কণ্ঠ : ছাত্র সংসদের স্বাভাবিক কার্যক্রম বন্ধ। এই কার্যক্রম চালু হলে কি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সাংঘর্ষিক পরিস্থিতির উন্নতি হবে?
এম. আবদুস সোবহান : নির্বাচিত ছাত্র সংসদের দ্বারা ছাত্ররাজনীতি পরিচালিত হলে পরিস্থিতির উল্লেখযোগ্য উন্নতি হবে বলে আমার বিশ্বাস।
কালের কণ্ঠ : জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতিকে আপনি কিভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
এম. আবদুস সোবহান : এ বিষয়ে ওসব বিশ্ববিদ্যালয়-সংশ্লিষ্টরা ভালো জানেন।
কালের কণ্ঠ : আপনার বিশ্ববিদ্যালয়ে কি সেশনজট আছে? সেশনজট কাটাতে আপনি কী ব্যবস্থা নিয়েছেন?
এম. আবদুস সোবহান : দায়িত্ব গ্রহণের পর সংশ্লিষ্ট সবার সহযোগিতায় ২০০৯ সালের ১ জুন থেকে এ পর্যন্ত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এক দিনের জন্যও অনির্ধারিত বন্ধ থাকেনি। এতে ৪৭টি বিভাগের মধ্যে তিন-চারটি ছাড়া সেশনজট দূর করা হয়েছে। উলি্লখিত তিন-চারটি বিভাগে ছয় মাস থেকে এক বছরের সেশনজট রয়েছে।
কালের কণ্ঠ : অতীত অভিজ্ঞতা প্রমাণ করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সৃষ্ট অসন্তোষের ফল ভালো হয় না। আপনি কি কোনো অশনি সংকেত পাচ্ছেন?
এম. আবদুস সোবহান : ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারছি না।
কালের কণ্ঠ : বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার পরিবেশ শতভাগ নিশ্চিত করতে আপনার সুপারিশ কী?
এম. আবদুস সোবহান : বিশ্ববিদ্যালয়-সংশ্লিষ্ট সবার, বিশেষ করে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের অধিকতর দায়িত্বশীল হওয়া, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মূল্যবোধে সমৃদ্ধ দেশপ্রেমে উদ্ধুদ্ধ হওয়া, ছাত্ররাজনীতিতে (মেধাবী ছাত্র নেতৃত্ব) গুণগত পরিবর্তন আনা, প্রভাবমুক্ত ছাত্ররাজনীতি অর্থাৎ ছাত্রসংগঠনের কোনো রাজনৈতিক দলের অঙ্গসংগঠন না হওয়া এবং কোনো রাজনৈতিক দল কোনো ছাত্রসংগঠনকে পৃষ্ঠপোষকতা দেবে না বলে ঘোষণা করা।
কালের কণ্ঠ : আপনাকে ধন্যবাদ।
এম. আবদুস সোবহান : ধন্যবাদ।

No comments

Powered by Blogger.