ডেসটিনির মূল তিন কম্পানির নিবন্ধন বাতিলের সুপারিশ
ডেসটিনি গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের তহবিল থেকে ৩,৭৯৮ কোটি টাকা পাচারের প্রমাণ পেয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় গঠিত তদন্ত কমিটি। কম্পানি ও সমবায় আইন ভাঙার দায়ে ডেসটিনি ২০০০ লিমিটেড, ডেসটিনি মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড ও ডেসটিনি ট্রি প্লান্টেশন লিমিটেডের নিবন্ধন (রেজিস্ট্রেশন) বাতিলের সুপারিশ করা হয়েছে।
সেই সঙ্গে গ্রাহকদের স্বার্থের কথা ভেবে গ্রুপটির সব প্রতিষ্ঠানের সব সম্পত্তি সরকারি হেফাজতে আনার পরামর্শও রয়েছে কমিটির প্রতিবেদনে। গত সোমবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদনটি জমা দিয়েছেন তদন্ত কমিটির প্রধান এবং যৌথ মূলধনী কম্পানি ও ফার্মসমূহের পরিদপ্তরের (আরজেএসসি) রেজিস্ট্রার বিজন কুমার বৈশ্য।
ডেসটিনি-সংক্রান্ত বাণিজ্য মন্ত্রণালয় গঠিত তদন্ত কমিটির একজন সদস্য কালের কণ্ঠকে বলেন, 'এই তিনটি কম্পানিই ডেসটিনি গ্রুপের মূল প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠান থেকে টাকা সরিয়ে আত্মসাতের পাশাপাশি অন্য কিছু প্রতিষ্ঠান নামমাত্র দাঁড় করানো হয়েছে। এ তিনটি কম্পানির ওপর গ্রুপটির অন্য সব কম্পানি নির্ভরশীল। ডেসনিটি ২০০০, ডেসটিনি মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি ও ডেসটিনি ট্রি প্লান্টেশন পরিচালনার ক্ষেত্রে কম্পানি আইন ও সমবায় আইন মানা হয়নি। তাই এই কম্পানি তিনটির লাইসেন্স বাতিল করে দেওয়ার সুপারিশ করেছি আমরা। একই সঙ্গে গ্রুপটির ২২ পরিচালকের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা দায়েরের সুপারিশও করেছি। মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ব্যাংক কম্পানি আইন ও সমবায় আইন ভাঙার দায়ে দোষীদের বিরুদ্ধে দ্রুত আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করেছি।'
ওই সদস্য বলেন, 'ডেসটিনির গ্রাহকদের স্বার্থ বিবেচনায় নিয়ে গ্রুপভুক্ত সব প্রতিষ্ঠানের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি রাষ্ট্রের হেফাজতে নেওয়ার সুপারিশও করেছি। তদন্তকালে কম্পানিগুলোর তহবিল থেকে ৩,৭৯৮ কোটি টাকা পাচারের প্রমাণ পেয়েছে তদন্ত কমিটি। সরিয়ে নেওয়া এই বিপুল পরিমাণ অর্থে ডেসটিনি গ্রুপের পরিচালকরা যেসব ব্যক্তিগত সম্পত্তি অর্জন করেছেন, সেগুলো চিহ্নিত করার সুপারিশও করেছি আমরা। গ্রাহকদের স্বার্থ বিবেচনা করে এসব সম্পত্তিও সরকার রাষ্ট্রের হেফাজতে নিতে পারে।'
তদন্ত প্রতিবেদনে ডেসটিনি গ্রুপের পরিচালকদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা দায়েরের সুপারিশও করা হয়েছে বলে জানান তদন্ত কমিটির আরেকজন সদস্য। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, তদন্ত কমিটি ডেসটিনির ব্যাপারে কমিশন গঠনের কোনো সুপারিশ করেনি। যুবকের ক্ষেত্রে কমিশন করেও কোনো লাভ হয়নি। যুবক কমিশন প্রতিষ্ঠানটির সম্পত্তি দখলে নিতে, বিক্রি বা গ্রাহকের অর্থ ফেরত দিতে পারছে না। মূলত আইনি দুর্বলতার কারণেই কমিশন ব্যর্থ হচ্ছে। কারণ, কমিশন অ্যাক্ট অনুযায়ী, কেবল সরকারই কোনো প্রতিষ্ঠানের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত বা নিজের হেফাজতে নিতে পারে। সে জন্যই ডেসটিনির ক্ষেত্রে কমিশন গঠনের পরিবর্তে গ্রুপটির ৩৫টি প্রতিষ্ঠানের সব স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি সরকারের হেফাজতে নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। গ্রাহকদের স্বার্থের কথা বিবেচনা করেই এ সুপারিশ করা হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, যুবকের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যাচ্ছে, গ্রাহকরা কোনো অর্থ ফেরত পাচ্ছে না। যুবকের সম্পত্তিও জব্দ করা যাচ্ছে না। অন্যদিকে, যুবকের কর্মকর্তারা এখনো তাঁদের সম্পত্তি বিক্রি ও হস্তান্তর করে চলেছেন। তাই ডেসনিটির কর্মকর্তারা যাতে যুবকের মতো সম্পত্তি বিক্রি করতে না পারেন, সেজন্যই গ্রুপটির সব প্রতিষ্ঠানের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি সরকারের হেফাজতে নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।
সোমবার বাণিজ্যসচিব মো. গোলাম হোসেনের কাছে প্রতিবেদনটি জমা দিলেও গতকাল বিকেল ৫টা পর্যন্ত তা অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়নি। প্রতিবেদনটি নিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব এম মুর্তজা রেজা বাণিজ্যমন্ত্রী জি এম কাদেরের জন্য একটি সংক্ষিপ্তসার (সংক্ষিপ্ত আকারে প্রতিবেদন) তৈরি করছেন বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তৈরি করা সংক্ষিপ্ত ওই প্রতিবেদনটি জি এম কাদেরের অনুমোদনসাপেক্ষে অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে।
তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ডেসটিনি মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটিসহ গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান পণ্য ও গাছ বিক্রিসহ নানা কথা বলে হাজার হাজার কোটি টাকা সংগ্রহ করেছে। এর মধ্যে ৩,৭৯৮ কোটি টাকার কোনো হিসাব দিতে পারছে না গ্রুপটির পরিচালকসহ কর্তাব্যক্তিরা। এ টাকা বিদেশে পাচার করা হয়েছে এমনই ধারণা করা হচ্ছে। তদন্তকারী দলকে বিভিন্নভাবে হেনস্তাসহ তাদের কাজে অসহযোগিতা করা হয়েছে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে আরো বলা হয়েছে, তদন্তকারী দল সরেজমিনে ডেসটিনি মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটিসহ একাধিক কম্পানির কার্যক্রম সরেজমিনে খতিয়ে দেখতে চাইলেও গ্রুপটি বাধা দিয়েছে। বিভিন্ন তথ্য দেওয়ার ক্ষেত্রেও তারা অসহযোগিতা করে। ব্যাংক হিসাব জব্দ করা নিয়ে তদন্তকারী দলের সঙ্গে রূঢ় আচরণ করেছেন ডেসটিনিসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। এসব কর্মকর্তার নাম উল্লেখ করে তাঁদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিতে প্রতিবেদনে সুপারিশ করা হয়েছে।
তদন্ত কমিটির প্রধান ও যৌথ মূলধনী কম্পানি ও ফার্মসমূহের পরিদপ্তরের রেজিস্ট্রার বিজন কুমার বৈশ্য কালের কণ্ঠকে বলেন, 'সোমবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে প্রতিবেদন জমা দিয়েছি। প্রতিবেদনে কী পাওয়া গেছে, সে বিষয়ে এখনো আমার বলার সময় হয়নি। সময় হলেই আমি মুখ খুলব।'
ডেসটিনি গ্রুপের তদন্ত প্রতিবেদন নিয়ে কথা বলতে বাণিজ্যসচিব মো. গোলাম হোসেনের সঙ্গে কথা বলার জন্য তাঁর দপ্তরে একাধিকবার চেষ্টা করা হলেও দেখা করা সম্ভব হয়নি। পরে তাঁর মোবাইল ফোনে কথা বলার চেষ্টা করেও তা সম্ভব হয়নি।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা জানান, কমিটির জমা দেওয়া মূল তদন্ত প্রতিবেদন ১৪৩ পৃষ্ঠার। আর আনুষঙ্গিক নথিপত্র মিলিয়ে পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদনটি ৪১০ পৃষ্ঠার।
ডেসটিনি গ্রুপের আর্থিক অনিয়ম খতিয়ে দেখতে আরজেএসসির রেজিস্ট্রারকে প্রধান করে বাংলাদেশ ব্যাংক, সমবায় অধিদপ্তর, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, অর্থ মন্ত্রণালয়, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ও সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গত ফেব্রুয়ারি মাসে এই কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি এর আগে তিনবার নামমাত্র প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। সেগুলোর প্রত্যেকটিতেই কমিশন গঠন করে ডেসনিটির বিরুদ্ধে বিশদ তদন্তের সুপারিশ করা হয়েছিল। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতও তখন কমিশন গঠনের কথা বলেছিলেন। তবে এ বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে আইন মন্ত্রণালয় ও সমবায় বিভাগের মতামত চাওয়া হলে আইন মন্ত্রণালয় কমিশন গঠন না করার পক্ষে মত দেয়। আইন মন্ত্রণালয় মত দিয়েছে, যুবকের ক্ষেত্রে কমিশন করে কোনো সুফল পাওয়া যায়নি। তাই এ ক্ষেত্রেও কমিশন করে কোনো লাভ হবে না। এর বদলে সরকার তার প্রশাসনিক ক্ষমতা ব্যবহার করে সম্পত্তি হেফাজতে নেওয়ার পর তা বিক্রি করে গ্রাহকদের অর্থ পরিশোধের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে।
গত বছরের শেষ দিকে চট্টগ্রামের এক ব্যক্তির অভিযোগের সূত্র ধরে বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মধ্যে চিঠি চালাচালি থেকে বিষয়টি বড় আকার ধারণ করে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ব্যাংক, দুর্নীতি দমন কমিশন, সমবায় অধিদপ্তর ও আরজেএসসি আলাদাভাবে তদন্ত করে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনকে আমলে নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন ডেসটিনির বিরুদ্ধে মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে দুটো পৃথক মামলা দায়ের করে। গত ৩১ জুলাই রাজধানীর কলাবাগান থানায় ডেসটিনি গ্রুপের ২২ পরিচালকের বিরুদ্ধে মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে দুটি মামলা করে দুদক। এরপর গত ৬ আগস্ট রফিকুল আমীনসহ পাঁচ পরিচালককে জামিন দেন সিএমএম আদালত। পরে অন্য ১৭ জনেরও জামিন হয়। কিন্তু সরকারপক্ষ এর বিরুদ্ধে আপিল করলে ২২ আগস্ট জামিন আদেশ স্থগিত হয়ে যায়। গত ২৭ সেপ্টেম্বর চূড়ান্ত শুনানি শেষে তাঁদের জামিন বাতিল হয়ে যায়। মামলার আসামিরা হলেন- ডেসটিনি গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রফিকুল আমীন, চেয়ারম্যান লে. জে. (অব.) হারুন অর রশিদ, রফিকুল আমীনের স্ত্রী ফারাহ দীবা, ডেসটিনি ২০০০ লিমিটেডের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ হোসাইন, ডায়মন্ড বিল্ডার্স লিমিটেডের পরিচালক দিদারুল আলম, উপব্যবস্থাপনা পরিচালক গোফরানুল হক, পরিচালক সাঈদ-উর-রহমান, মেজবাহ উদ্দিন স্বপন, সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেন, ইরফান আহমেদ সানি, জামসেদ আরা চৌধুরী, শেখ তৈয়েবুর রহমান, নেপাল চন্দ্র বিশ্বাস, জাকির হোসেন, আজাদ রহমান, সাইদুল ইসলাম খান, আবুল কালাম আজাদ, আকরাম হোসেন সুমন, শিরিন আক্তার, রফিকুল ইসলাম সরকার, মজিবুর রহমান ও সুমন আলী খান।
ডেসটিনি-সংক্রান্ত বাণিজ্য মন্ত্রণালয় গঠিত তদন্ত কমিটির একজন সদস্য কালের কণ্ঠকে বলেন, 'এই তিনটি কম্পানিই ডেসটিনি গ্রুপের মূল প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠান থেকে টাকা সরিয়ে আত্মসাতের পাশাপাশি অন্য কিছু প্রতিষ্ঠান নামমাত্র দাঁড় করানো হয়েছে। এ তিনটি কম্পানির ওপর গ্রুপটির অন্য সব কম্পানি নির্ভরশীল। ডেসনিটি ২০০০, ডেসটিনি মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি ও ডেসটিনি ট্রি প্লান্টেশন পরিচালনার ক্ষেত্রে কম্পানি আইন ও সমবায় আইন মানা হয়নি। তাই এই কম্পানি তিনটির লাইসেন্স বাতিল করে দেওয়ার সুপারিশ করেছি আমরা। একই সঙ্গে গ্রুপটির ২২ পরিচালকের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা দায়েরের সুপারিশও করেছি। মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ব্যাংক কম্পানি আইন ও সমবায় আইন ভাঙার দায়ে দোষীদের বিরুদ্ধে দ্রুত আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করেছি।'
ওই সদস্য বলেন, 'ডেসটিনির গ্রাহকদের স্বার্থ বিবেচনায় নিয়ে গ্রুপভুক্ত সব প্রতিষ্ঠানের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি রাষ্ট্রের হেফাজতে নেওয়ার সুপারিশও করেছি। তদন্তকালে কম্পানিগুলোর তহবিল থেকে ৩,৭৯৮ কোটি টাকা পাচারের প্রমাণ পেয়েছে তদন্ত কমিটি। সরিয়ে নেওয়া এই বিপুল পরিমাণ অর্থে ডেসটিনি গ্রুপের পরিচালকরা যেসব ব্যক্তিগত সম্পত্তি অর্জন করেছেন, সেগুলো চিহ্নিত করার সুপারিশও করেছি আমরা। গ্রাহকদের স্বার্থ বিবেচনা করে এসব সম্পত্তিও সরকার রাষ্ট্রের হেফাজতে নিতে পারে।'
তদন্ত প্রতিবেদনে ডেসটিনি গ্রুপের পরিচালকদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা দায়েরের সুপারিশও করা হয়েছে বলে জানান তদন্ত কমিটির আরেকজন সদস্য। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, তদন্ত কমিটি ডেসটিনির ব্যাপারে কমিশন গঠনের কোনো সুপারিশ করেনি। যুবকের ক্ষেত্রে কমিশন করেও কোনো লাভ হয়নি। যুবক কমিশন প্রতিষ্ঠানটির সম্পত্তি দখলে নিতে, বিক্রি বা গ্রাহকের অর্থ ফেরত দিতে পারছে না। মূলত আইনি দুর্বলতার কারণেই কমিশন ব্যর্থ হচ্ছে। কারণ, কমিশন অ্যাক্ট অনুযায়ী, কেবল সরকারই কোনো প্রতিষ্ঠানের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত বা নিজের হেফাজতে নিতে পারে। সে জন্যই ডেসটিনির ক্ষেত্রে কমিশন গঠনের পরিবর্তে গ্রুপটির ৩৫টি প্রতিষ্ঠানের সব স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি সরকারের হেফাজতে নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। গ্রাহকদের স্বার্থের কথা বিবেচনা করেই এ সুপারিশ করা হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, যুবকের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যাচ্ছে, গ্রাহকরা কোনো অর্থ ফেরত পাচ্ছে না। যুবকের সম্পত্তিও জব্দ করা যাচ্ছে না। অন্যদিকে, যুবকের কর্মকর্তারা এখনো তাঁদের সম্পত্তি বিক্রি ও হস্তান্তর করে চলেছেন। তাই ডেসনিটির কর্মকর্তারা যাতে যুবকের মতো সম্পত্তি বিক্রি করতে না পারেন, সেজন্যই গ্রুপটির সব প্রতিষ্ঠানের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি সরকারের হেফাজতে নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।
সোমবার বাণিজ্যসচিব মো. গোলাম হোসেনের কাছে প্রতিবেদনটি জমা দিলেও গতকাল বিকেল ৫টা পর্যন্ত তা অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়নি। প্রতিবেদনটি নিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব এম মুর্তজা রেজা বাণিজ্যমন্ত্রী জি এম কাদেরের জন্য একটি সংক্ষিপ্তসার (সংক্ষিপ্ত আকারে প্রতিবেদন) তৈরি করছেন বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তৈরি করা সংক্ষিপ্ত ওই প্রতিবেদনটি জি এম কাদেরের অনুমোদনসাপেক্ষে অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে।
তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ডেসটিনি মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটিসহ গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান পণ্য ও গাছ বিক্রিসহ নানা কথা বলে হাজার হাজার কোটি টাকা সংগ্রহ করেছে। এর মধ্যে ৩,৭৯৮ কোটি টাকার কোনো হিসাব দিতে পারছে না গ্রুপটির পরিচালকসহ কর্তাব্যক্তিরা। এ টাকা বিদেশে পাচার করা হয়েছে এমনই ধারণা করা হচ্ছে। তদন্তকারী দলকে বিভিন্নভাবে হেনস্তাসহ তাদের কাজে অসহযোগিতা করা হয়েছে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে আরো বলা হয়েছে, তদন্তকারী দল সরেজমিনে ডেসটিনি মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটিসহ একাধিক কম্পানির কার্যক্রম সরেজমিনে খতিয়ে দেখতে চাইলেও গ্রুপটি বাধা দিয়েছে। বিভিন্ন তথ্য দেওয়ার ক্ষেত্রেও তারা অসহযোগিতা করে। ব্যাংক হিসাব জব্দ করা নিয়ে তদন্তকারী দলের সঙ্গে রূঢ় আচরণ করেছেন ডেসটিনিসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। এসব কর্মকর্তার নাম উল্লেখ করে তাঁদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিতে প্রতিবেদনে সুপারিশ করা হয়েছে।
তদন্ত কমিটির প্রধান ও যৌথ মূলধনী কম্পানি ও ফার্মসমূহের পরিদপ্তরের রেজিস্ট্রার বিজন কুমার বৈশ্য কালের কণ্ঠকে বলেন, 'সোমবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে প্রতিবেদন জমা দিয়েছি। প্রতিবেদনে কী পাওয়া গেছে, সে বিষয়ে এখনো আমার বলার সময় হয়নি। সময় হলেই আমি মুখ খুলব।'
ডেসটিনি গ্রুপের তদন্ত প্রতিবেদন নিয়ে কথা বলতে বাণিজ্যসচিব মো. গোলাম হোসেনের সঙ্গে কথা বলার জন্য তাঁর দপ্তরে একাধিকবার চেষ্টা করা হলেও দেখা করা সম্ভব হয়নি। পরে তাঁর মোবাইল ফোনে কথা বলার চেষ্টা করেও তা সম্ভব হয়নি।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা জানান, কমিটির জমা দেওয়া মূল তদন্ত প্রতিবেদন ১৪৩ পৃষ্ঠার। আর আনুষঙ্গিক নথিপত্র মিলিয়ে পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদনটি ৪১০ পৃষ্ঠার।
ডেসটিনি গ্রুপের আর্থিক অনিয়ম খতিয়ে দেখতে আরজেএসসির রেজিস্ট্রারকে প্রধান করে বাংলাদেশ ব্যাংক, সমবায় অধিদপ্তর, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, অর্থ মন্ত্রণালয়, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ও সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গত ফেব্রুয়ারি মাসে এই কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি এর আগে তিনবার নামমাত্র প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। সেগুলোর প্রত্যেকটিতেই কমিশন গঠন করে ডেসনিটির বিরুদ্ধে বিশদ তদন্তের সুপারিশ করা হয়েছিল। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতও তখন কমিশন গঠনের কথা বলেছিলেন। তবে এ বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে আইন মন্ত্রণালয় ও সমবায় বিভাগের মতামত চাওয়া হলে আইন মন্ত্রণালয় কমিশন গঠন না করার পক্ষে মত দেয়। আইন মন্ত্রণালয় মত দিয়েছে, যুবকের ক্ষেত্রে কমিশন করে কোনো সুফল পাওয়া যায়নি। তাই এ ক্ষেত্রেও কমিশন করে কোনো লাভ হবে না। এর বদলে সরকার তার প্রশাসনিক ক্ষমতা ব্যবহার করে সম্পত্তি হেফাজতে নেওয়ার পর তা বিক্রি করে গ্রাহকদের অর্থ পরিশোধের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে।
গত বছরের শেষ দিকে চট্টগ্রামের এক ব্যক্তির অভিযোগের সূত্র ধরে বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মধ্যে চিঠি চালাচালি থেকে বিষয়টি বড় আকার ধারণ করে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ব্যাংক, দুর্নীতি দমন কমিশন, সমবায় অধিদপ্তর ও আরজেএসসি আলাদাভাবে তদন্ত করে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনকে আমলে নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন ডেসটিনির বিরুদ্ধে মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে দুটো পৃথক মামলা দায়ের করে। গত ৩১ জুলাই রাজধানীর কলাবাগান থানায় ডেসটিনি গ্রুপের ২২ পরিচালকের বিরুদ্ধে মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে দুটি মামলা করে দুদক। এরপর গত ৬ আগস্ট রফিকুল আমীনসহ পাঁচ পরিচালককে জামিন দেন সিএমএম আদালত। পরে অন্য ১৭ জনেরও জামিন হয়। কিন্তু সরকারপক্ষ এর বিরুদ্ধে আপিল করলে ২২ আগস্ট জামিন আদেশ স্থগিত হয়ে যায়। গত ২৭ সেপ্টেম্বর চূড়ান্ত শুনানি শেষে তাঁদের জামিন বাতিল হয়ে যায়। মামলার আসামিরা হলেন- ডেসটিনি গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রফিকুল আমীন, চেয়ারম্যান লে. জে. (অব.) হারুন অর রশিদ, রফিকুল আমীনের স্ত্রী ফারাহ দীবা, ডেসটিনি ২০০০ লিমিটেডের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ হোসাইন, ডায়মন্ড বিল্ডার্স লিমিটেডের পরিচালক দিদারুল আলম, উপব্যবস্থাপনা পরিচালক গোফরানুল হক, পরিচালক সাঈদ-উর-রহমান, মেজবাহ উদ্দিন স্বপন, সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেন, ইরফান আহমেদ সানি, জামসেদ আরা চৌধুরী, শেখ তৈয়েবুর রহমান, নেপাল চন্দ্র বিশ্বাস, জাকির হোসেন, আজাদ রহমান, সাইদুল ইসলাম খান, আবুল কালাম আজাদ, আকরাম হোসেন সুমন, শিরিন আক্তার, রফিকুল ইসলাম সরকার, মজিবুর রহমান ও সুমন আলী খান।
No comments