ভেনেজুয়েলা- হুগো চাভেজ: ‘জোরদার কংক্রিট’ by ফারুক ওয়াসিফ

ষাঁড়ের দুর্নাম এ জন্য যে তাকে বশ্যতা মানানো কঠিন। আর লালের প্রতি তার দুর্বার আকর্ষণ। শত্রুদের কাছে তিনি ষাঁড়ের মতোই বেপরোয়া আর বন্ধুদের কাছে কঠিন ভরসা। সেই লাতিন আমেরিকান ষাঁড় হুগো চাভেজ আবার ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন।


প্রেসিডেন্ট হিসেবে তৃতীয়বার আর নির্বাচনের হিসাবে ১৩ বছরে এটা তাঁর ১৪তম বিজয়। একাই জেতেননি তিনি, তাঁর সঙ্গে জিতেছে লাতিন মহাদেশ। প্রতিপক্ষ হেনরিক কাপ্রিলেসও একাই হারেননি, হেরেছে তাঁর সমর্থক পুঁজিবাদের দুর্গযুক্তরাষ্ট্রও। এই জয়েখুশি ভেনেজুয়েলার বন্ধু চীন-রাশিয়া-ইরান-সিরিয়াও।
লাতিন আমেরিকান এই ষাঁড় ভেতর-বাহিরে যে লড়াই চালাচ্ছিলেন, গত রোববারের নির্বাচনে দুটোরই জয় হয়েছে। একদিকে তিনি স্বদেশেরই মার্কিন-পসন্দ শাসকগোষ্ঠীকে দেশের তেল-গ্যাস সম্পদের নিয়ন্ত্রণ নেওয়া ঠেকালেন। অন্যদিকে কিউবা, বলিভিয়া, নিকারাগুয়াসহ লাতিনের বামপন্থী দেশগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের দাপটও সামলালেন। স্বাধীনচেতা গণমুখী এই চরিত্রের কারণেই পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলো তাঁকে ‘স্বৈরশাসক’ ডাকে। তিনি এমনই এক ‘স্বৈরশাসক’, যিনি ১৩টি নিরপেক্ষ নির্বাচন জিতেছেন। তিনি এমনই এক সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের নেতা, যে আন্দোলন গণতন্ত্রকে জনমানুষের হাতিয়ারে পরিণত করেছে। তিনি এমনই এক পার্টির নেতা, যে পার্টির কর্মসূচি ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভার তৃণমূলের জনপ্রতিনিধিদের হাতে।
চাভেজের শাসনামলের ১৩টি বছরে ভেনেজুয়েলা থেকে নিরক্ষরতা বিদায় নিয়েছে। বাজেটের ৪৩ শতাংশেরও বেশি ব্যয় হয়ে আসছে সামাজিক কর্মসূচি বাস্তবায়নে। বেকারত্ব ২০ থেকে ৭ শতাংশে নেমেছে। গত ১০ বছরে নির্মিত হয়েছে ২২টিরও বেশি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। শিক্ষকের সংখ্যা ৬৫ হাজার থেকে হয়েছে সাড়ে তিন লাখ। চলছে শতবর্ষ ধরে আটকে রাখা কৃষি সংস্কার কার্যক্রম। হাতে নিয়েছেন ২০ লাখ পরিবারের জন্যআবাসন কর্মসূচি।
চাভেজ এসব পারছেন, কারণ তাঁর হাতে রয়েছে বিশ্বের বৃহত্তম প্রমাণিত তেলের মজুদ। সম্পদ প্রায়ই বিপদের কারণ হয়, যদি তা সুবিধাবাদী নেতৃত্বের হাতে পড়ে। তৃতীয় দুনিয়ার দেশগুলোতে যা হয়, চাভেজের আগে ভেনেজুয়েলার তেল-রাজস্বের ৮০ শতাংশই বিদেশে চলে যেত। সম্পদ স্থানান্তরের এই গতিকে চাভেজ ঘুরিয়ে জনমুখী করেছেন। সবচেয়ে যা বড়, চাভেজের ‘একুশ শতকের সমাজতন্ত্র’ বৈষম্যের সমাজকে সাম্যের দিকে নিয়ে যেতে পারছে। হতদরিদ্র, ভূমিহীন, বাস্তুহীনেরা সেখানে এখন নিম্নমধ্যবিত্তের জীবন পেতে পারছে। লাতিন আমেরিকার মধ্যে ভেনেজুয়েলার গিনি কো-অ্যাফিশিয়েন্ট সর্বনিম্নে, এর অর্থ সেখানে বৈষম্য সবচেয়ে কম। এসবই চাভেজের নির্বাচন জয়ের জাদু।
এবারের নির্বাচনে চাভেজের মেনিফেস্টো ছিল পাঁচ দফায় সজ্জিত: ‘১. জাতীয় স্বাধীনতা রক্ষা, বিস্তার ও সংহত করা, ২. ধ্বংসাত্মক ও বর্বর পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে ভেনেজুয়েলায় একুশ শতকের বলিভীয় সমাজতন্ত্র নির্মাণ চালু রাখা, ৩. লাতিন আমেরিকা ও ক্যারিবীয় অঞ্চলের ক্রমবর্ধমান শক্তিমত্তার সঙ্গে সঙ্গে ভেনেজুয়েলাকে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত করা, ৪. বিশ্বের শান্তি ও ভারসাম্য রক্ষায় আন্তর্জাতিক ভূরাজনীতির মাধ্যমে পৃথিবীকে বহুকেন্দ্রিক বহুত্ববাদী করে তোলা এবং ৫. ধরিত্রীর সব প্রাণ ও মানুষ প্রজাতিকে রক্ষা করা।’
জাদুর পাল্টা কালো-জাদুও আছে। প্রতিপক্ষ কাপ্রিলেস প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, জিতলে তিনি চীন-রাশিয়া ও ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক বদলাবেন। তেলক্ষেত্রগুলোর মালিকানা ও ইজারায় আমূল পরিবর্তন আনবেন। এই কাপ্রিলেসকেই ২০০২ সালে দেখা গেছে যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত ব্যর্থ ক্যুয়ের নেতা হতে। দেশের ধনীদের প্রতিনিধি এই ব্যক্তির বিদ্রোহকে ধনীদের পরিচালিত টেলিভিশন মিডিয়া ‘গণতন্ত্রের প্রত্যাবর্তন’ বলে প্রচার করেছিল। যুক্তরাষ্ট্রও তড়িঘড়ি করে লজ্জার মাথা খেয়ে অভ্যুত্থানকারীদের সমর্থন দেয়। কিন্তু লাতিন আমেরিকায় বিধি বামের দিকেই হেলে আছে। সারা দেশ থেকে আসা কৃষক-শ্রমিক ও ছাত্ররা রাজধানী কারাকাস ঘিরে ফেলে দুই দিনের মধ্যেই চাভেজকে আবার প্রেসিডেন্ট প্রাসাদে প্রতিষ্ঠিত করে। যে নেতা জনগণের ভরসা হন, সেই নেতাকে জনগণই রক্ষা করে।
চাভেজের পক্ষে জনগণ যখন সত্যিই গণতন্ত্রকে ফিরিয়ে আনে, সেই চ্যানেলগুলো এ খবর গোপন রেখে দুই দিন দিবারাত্র কার্টুন ছবি প্রচার করে। দিনের শেষে এখন তারাই কার্টুন চরিত্র আর চাভেজ হয়ে উঠেছেন জনগণনায়ক। চাভেজ যদি তখন প্রতিপক্ষকে রাষ্ট্রদ্রোহের শাস্তি দিতেন, তা হলে আজ ধনকুবের কাপ্রিলেসকে ভোটে না দাঁড়িয়ে ফাঁসির কাষ্ঠে দাঁড়াতে দেখা যেত।
চাভেজের প্রতিপক্ষও কম শক্তিশালী নয়। গণমাধ্যম ও ব্যবসা-বাণিজ্যের মালিকানার জোরে তারা দিব্যি চাভেজবিরোধী ধনী ও মধ্যবিত্তের নেতা হয়ে বসেছেন। এই নির্বাচনে চাভেজ পেয়েছেন ৫৫ শতাংশ ভোট আর কাপ্রিলেস পেয়েছেন ৪৫ শতাংশ ভোট। ভোট দানের হার ৮০ দশমিক ৪ শতাংশ। শরীরে ক্যানসার আর গুপ্তহত্যার আশঙ্কায় নির্বাচনী প্রচারাভিযান সশরীরে না চালানো এবং প্রতিপক্ষের গুজব ও রটনাই ভোট কমার জন্য দায়ী। মাঠপর্যায়েদুর্নীতিও একটা কারণ। নির্বাচন বানচালের চেষ্টাও সমাজতন্ত্রবিরোধীরা নিয়েছিল। চাভেজপন্থী নেতা-কর্মী ও মিলিশিয়ারা তৈরি থাকায় চিলির বামপন্থী প্রেসিডেন্ট সালভাদর আলেন্দের মতো ট্র্যাজিক পরিণতি এড়ানো গেছে। সেই আনন্দটা কেমন তা বোঝা যায়, এক জেলের কথায়, ‘আমি আনন্দে কাঁদছি। সামনের ছয় বছরে আমরা বিপ্লবকে আরও গভীরে নিয়ে যাব।’ চাভেজও বলেছিলেন, পুনর্নির্বাচিত হলে অতীতের ভুলগুলো শুধরে নেবেন। পুঁজিবাদী মডেলের বিকল্প সমাজতান্ত্রিক মডেল এগিয়ে নেবেন এবং তেলের রাজস্ব সেবাসুবিধা আকারে জনগণের মধ্যে বণ্টন করবেন এবং কিউবা ও নিকারাগুয়াসহ যাবতীয় সাম্রাজ্যবাদবিরোধী দেশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়াবেন। এসব হয়তো সম্ভব, যদি ২০১৯-এ পরের নির্বাচনের আগেই কোনো ষড়যন্ত্রে অথবা আততায়ীর হাতে লাতিন আমেরিকার ষাঁড় ধরাশায়ী না হন।
কলাম্বিয়ার নোবেলজয়ী সাহিত্যিক ফিদেল কাস্ত্রোর বন্ধু গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজই সম্ভবত চাভেজের প্রাণশক্তির নিরিখ পেয়েছিলেন। তাঁর কথায়, চাভেজ হচ্ছেন ‘জোরদার কংক্রিট’ (Reinforced concrete)। অফুরান তাঁর প্রাণশক্তি। চাভেজের গল্প এক দরিদ্র বালকের গল্প। তিনি গান গাইতে আর গল্প বলতে ভালোবাসতেন। তিনি যোগ দিলেন সেনাবাহিনীতে। ১৯৯২ সালে তিনি অজনপ্রিয় সরকারকে উচ্ছেদে ব্যর্থ সেনা-অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেন। জেল খাটেন তিন বছর। তারও তিন বছর পর উঠে এলেন প্রেসিডেন্ট প্রাসাদে।
তাঁর বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযাগ, তিনি ব্যক্তিতন্ত্র তৈরি করেছেন, প্রেসিডেন্টের নির্বাচিত হওয়ার মেয়াদের সীমা উঠিয়ে দিয়েছেন এবং শাসনক্ষমতা নিজের হাতে কুক্ষিগত করেছেন। সুসংগঠিত দলের অভাব এবং অব্যাহত ষড়যন্ত্রের মুখে হয়তো এ ছাড়া উপায়ও ছিল না। অন্যদিকে, ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রীও পর পর তিনবারের বেশি নির্বাচিত হতে পারেন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তো পারেন শতবার। চাভেজ যেহেতু গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট, সেহেতু অতীতের সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর ভুল থেকে তাঁকে শিখতেই হবে। পাশাপাশি, বিপ্লবের ভিতটা তিনি এবং তাঁর দল যে সমাজের মধ্যে রেখেছে, রাষ্ট্রবাদী-দলবাদী হয়ে ওঠেনি, সেটাও এক বড় অর্জন।
দিনে ৩০ মগ চিনি মেশানো কালো কফি খাওয়া তাঁর অভ্যাস। বক্তৃতায় একটানা চিল্লাতে পারেন অসুরের মতো। ভোর তিনটা থেকে মন্ত্রী ও উপদেষ্টাদের ফোন করা শুরু করেন। ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার আগে তাঁর জাতীয় স্লোগান ছিল, ‘পিতৃভূমি, সমাজতন্ত্র অথবা মৃত্যু’। মৃত্যুর হুমকির মুখে দাঁড়িয়ে এখন তাঁর স্লোগান, ‘আমরা জিতব, আমরা বাঁচব’। এই স্লোগান এখন লাতিন আমেরিকাজুড়ে জনপ্রিয়। কিউবা, ভেনেজুয়েলা, বলিভিয়া ও নিকারাগুয়ায় সমাজ পরিবর্তনকামী বামপন্থীরা ক্ষমতাসীন। হন্ডুরাস ও প্যারাগুয়েতে নির্বাচিত বাম সরকারকে ষড়যন্ত্র করে হটানো হলেও, তাদের ফিরে আসা সময়ের ব্যাপার হয়তো। এদের বলা হয় চাভিজমো। অন্যদিকে ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, উরুগুয়ে, পেরু ও চিলির মধ্য বাম সরকারগুলোকে ব্রাজিলের সাবেক জনপ্রিয় প্রেসিডেন্ট লুলার নামে লুলিজমো। এরা সবাই মিলে মার্কোসুর নামে আঞ্চলিক ঐক্য আর ইউনিসুর নামে অর্থনৈতিক জোট গঠন করে বিশ্বব্যাংক-আইএমএফের খপ্পর থেকে বেরিয়ে আসছে। অথচ এই অঞ্চল ছিল বিশ্বব্যাংক-আইএমএফের মুক্তবাজারের সর্বনাশা পরীক্ষাক্ষেত্র। অথচ সত্তর-আশির দশকজুড়ে এই লাতিন আমেরিকাই ছিল মার্কিন আধিপত্যের প্রধান শিকার। গণবিরোধী শাসকদের খাঁচা ভেঙে লাতিন জাগরণ আজ মুক্তির পথযাত্রী।
দিনের শেষে দেখা যাচ্ছে, একদিকে অপরিণত আরব জাগরণ অন্যদিকে শক্তশেকড়ের লাতিন জাগরণ। দুটোই ইউরো-মার্কিন ক্ষমতার জন্য বিরাট চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠছে। দিনের শেষে এও দেখা যাচ্ছে, সভ্যতার সংঘর্ষ আর সন্ত্রাসবাদবিরোধী যুদ্ধই শেষ কথা নয়। শেষ কথা হলো, করপোরেট বিশ্বায়নের দানবীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে মহাদেশে-মহাদেশে জনগণের উত্থান। পৃথিবীতে সত্যিকার মানবিক সমাজের জন্য যারা সংগ্রাম করে যাচ্ছে ও যাবে, ‘আমরা জিতব, আমরা বাঁচব’ স্লোগানে হয়তো তারা নতুন দিশা খুঁজে পাবে।
এশিয়া-আফ্রিকাসহ পাশ্চাত্যের তরুণদের জন্যও আশা যে, পথ আছে। একটা জীবন হতাশায় কেটে যাবে না।
ফারুক ওয়াসিফ: লেখক ও সাংবাদিক।
farukwasif@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.