গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ-ইসির কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা বাড়ূক
গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ বা আরপিও সংশোধনের প্রস্তাব নির্বাচন কমিশনের (ইসি) বিবেচনাধীন। ১৯৭২ সালে প্রণীত এ আদেশ ইতিপূর্বে কয়েক দফায় সংশোধন হয়েছে। সব সংশোধনী যথার্থ ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া এগিয়ে নেওয়ার সহায়ক হয়েছে কি-না, তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। তবে একটি বিষয়ে দ্বিমত নেই_ নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা আরও বাড়ানো উচিত।
নির্বাচনকালীন সরকার পদ্ধতি যা-ই থাকুক, কমিশন শক্তিশালী এবং তাদের প্রতি ভোটারদের পূর্ণ আস্থা না থাকলে সব আয়োজনই ব্যর্থ হতে বাধ্য। কমিশনের স্বাধীনতা এর প্রধান শর্ত। স্বাধীনতা কেবল কাগজ-কলমে থাকলে হয় না, বাস্তবে প্রয়োগও হওয়া চাই। নির্বাচন কমিশনের প্রধান এবং অন্য কমিশনার পদে কারা দায়িত্ব পালন করছেন, সেটাও গুরুত্বপূর্ণ। ভারতে টিএন সেশান প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময় কেন্দ্রীয় ও রাজ্য পর্যায়ের প্রতিটি নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে সম্পন্ন করে অশেষ কৃতিত্ব দেখান। এমনকি যুগ যুগ ধরে যেসব এলাকা চরম ঝুঁকিপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়েছে, তার আমলে সেখানেও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব হয়েছে। বাংলাদেশে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের সাধারণ নির্বাচনের সময়ে এটিএম শামসুল হুদার নেতৃত্বে যে কমিশন দায়িত্বে ছিল, তাদের প্রতিও জনসাধারণের যথেষ্ট আস্থা ছিল। তবু উল্লেখ করা দরকার যে, নির্বাচনের পর বিএনপি এবং তার মিত্ররা এই কমিশনের বিরুদ্ধে পক্ষপাতপূর্ণ আচরণের অভিযোগ তোলে। নির্বাচনের স্বচ্ছতা-নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠলেই তার গ্রহণযোগ্যতা কমে যায় না। তবে বাংলাদেশে নব্বইয়ের দশক থেকে যেসব নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে প্রতিটি ক্ষেত্রেই পরাজিত পক্ষ কারচুপির অভিযোগ এনেছে এবং সে কারণে বিষয়টি অনেকটা 'রেওয়াজ' বলেও ধরে নেওয়া চলে। কিন্তু এটাও গুরুত্বপূর্ণ যে, কমিশনকে কোনোভাবেই নির্বাচনের আগে বিতর্কিত হওয়া উচিত নয়। বর্তমান কমিশন নিয়োগ পেয়েছে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে এবং রাষ্ট্রপতি সব দলের সঙ্গে আলোচনা করেই সাংবিধানিক ক্ষমতাবলে কমিশন চেয়ারম্যান ও সদস্যদের নিয়োগ দিয়েছেন। এখন কমিশনকেই তার দক্ষতা, যোগ্যতা এবং সর্বোপরি গ্রহণযোগ্যতার প্রমাণ রাখতে হবে। এ ক্ষেত্রে প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদিচ্ছা ও আন্তরিকতাও গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে তাদের সম্পর্কে প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে দলীয়করণের অভিযোগ ওঠে। অভিযোগ যে অমূলক নয়, সাদা চোখেও অনেক সময় তা ধরা পড়ে। এ অবস্থায় নির্বাচনকালীন নির্বাচন কমিশনের হাতে সব মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব অর্পিত হলেও প্রশ্ন ওঠার অবকাশ থেকেই যায়। ড. ইয়াজউদ্দিন আহম্মদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে 'বিএনপির শাসনামলে সাজিয়ে যাওয়া' প্রশাসন বহাল রাখার অভিযোগ উঠেছিল। এখন আওয়ামী লীগ সম্পর্কেও একই অভিযোগ করছে বিএনপি। নির্বাচন কমিশনকে এ বাস্তবতা বিবেচনায় রেখেই অগ্রসর হতে হবে। তাদের হাতে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কর্তৃত্ব এলো, কিন্তু সবাই কথা শুনল না_ এ পরিস্থিতি হলে নির্বাচনের আগেই নির্বাচন প্রক্রিয়া বিতর্কিত হয়ে পড়বে। আরপিও সংশোধনের যেসব প্রস্তাব কমিশন করেছে, তার অনেকগুলো ড. শামসুল হুদার নেতৃত্বাধীন কমিশনের প্রস্তাবেও ছিল। সব দল ও নাগরিক সমাজের ঐকমত্যের ভিত্তিতে তা চূড়ান্ত করা যেতে পারে এবং এ কাজটি দ্রুত করাই শ্রেয়। তবে নির্বাচনকালে সব মন্ত্রণালয়ের কর্তৃত্ব নয়, বরং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোই কেবল কমিশনের কর্তৃত্বে আসা উচিত। এটা মনে রাখতে হবে যে, দেশের সার্বিক ক্ষমতা নয়, বরং অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্বই এ সময়ে তাদের ওপরে বর্তায়।
No comments