অর্থনীতি-ব্যাংকের অনিয়ম ধরবে কে? by আমিনুল ইসলাম

সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের তদারকি ব্যবস্থা শিথিল ছিল_ তাতে সন্দেহ নেই। বাংলাদেশ ব্যাংক হলমার্কের ঋণ জালিয়াতির ঘটনা উদ্ঘাটন করে এবং তাৎক্ষণিকভাবে প্রয়োজনীয় প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণসহ দায়ী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনে ফৌজদারি মামলার নির্দেশ দেয়।


অসাধু ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান-ব্যক্তির ব্যাংক থেকে নানাবিধ কৌশলে অর্থ হাতিয়ে নেওয়া ঠেকাতে এটা অপরিহার্য
সোনালী ব্যাংক থেকে হলমার্ক গ্রুপের নিয়মবহির্ভূতভাবে বিপুল অঙ্কের ঋণ গ্রহণকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত বিশেষ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক, সরকার পরিচালিত ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পরিষদ ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংকিং বিভাগের কর্মকাণ্ড আলোচনায় এসেছে। এ কেলেঙ্কারিতে কার দায় কতটা, সময়মতো কি বিষয়টি নজরে এসেছিল এবং এসে থাকলে অনিয়ম চাপা দেওয়ার চেষ্টা ছিল কি-না, নাকি দোষীদের চিহ্নিত করার কোনো প্রয়াস ছিল_ এসব প্রশ্ন উঠছে। বিশেষভাবে কাঠগড়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক অর্থাৎ বাংলাদেশ ব্যাংক। এত বড় অনিয়ম তাদের দৃষ্টি এড়াতে পারল কীভাবে?
বাংলাদেশ ব্যাংক মূলত দু'ধরনের তদারকি কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে_ অন-সাইট সুপারভিশন বা সরেজমিন তত্ত্বাবধান এবং অফ-সাইট বা বিবরণীভিত্তিক তত্ত্বাবধান। আবার অন-সাইট সুপারভিশন দু'ধরনের_ বিশদ ও বিশেষ পরিদর্শন। বার্ষিক পরিদর্শন কর্মসূচির আওতায় ব্যাংকের সামগ্রিক অবস্থা মূল্যায়নের জন্য প্রতিটি ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়সহ কিছু বড় শাখা (যে শাখাগুলো থেকে ব্যাংকের মোট ঋণের ৭০-৮০ শতাংশ প্রদান করা হয়) প্রতি বছর পরিদর্শন করা হয়। অবশিষ্ট শাখাগুলো চার বছরে একবার পরিদর্শন করা হয়। বিশদ পরিদর্শন কর্মসূচির অতিরিক্ত হিসেবে ব্যাংকগুলোর জালিয়াতি, গুরুতর কোনো অনিয়ম অথবা আমানতকারী, জনসাধারণ বা বিশেষ কোনো প্রতিষ্ঠানের অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত করার জন্য বিশেষ পরিদর্শন পরিচালনা করা হয়ে থাকে। অফ-সাইট সুপারভিশন মূলত ব্যাংকের রিপোর্ট বা আর্থিক বিবরণীভিত্তিক সুপারভিশন। অর্থাৎ ব্যাংক কর্তৃক প্রেরিত বিবরণীর ওপর ভিত্তি করে ক্যামেলস্ রেটিংয়ের মাধ্যমে ব্যাংকগুলোর আর্থিক সুস্থতা নির্ণয়ের পাশাপাশি সমস্যাক্রান্ত এবং নিবিড় তদারকির প্রয়োজন, এরূপ ব্যাংক চিহ্নিতকরণের ক্ষেত্রে অফ-সাইট সুপারভিশন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। ব্যাংকিং খাতের বিভিন্ন সূচকের অবনমন ও উন্নতি এ ধরনের সুপারভিশনের মাধ্যমে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা হয়। অফ-সাইট সুপারভিশনে প্রাপ্ত অনিয়ম বিষয়ে সময়ে সময়ে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সভা করে পরামর্শ দেওয়া হয়। তাছাড়া ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ, নির্বাহী কমিটি ও অডিট কমিটির সভার কার্যবিবরণী পর্যালোচনা করে কোনো অনিয়ম পাওয়া গেলে তা নিয়মিতকরণের জন্য ব্যাংককে পত্র দেওয়া হয়। অন্যদিকে, অনসাইট সুপারভিশনের মাধ্যমে সরেজমিন ব্যাংকগুলোর কার্যক্রম পর্যালোচনা করা হয়ে থাকে। ব্যাংকের সংখ্যার পাশাপাশি শাখা সংখ্যাও বেড়েছে। বর্তমানে ৪৭টি ব্যাংকের শাখা রয়েছে ৮ হাজার ৫৯টি। সোনালী ব্যাংকে গত ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০০৯ তারিখের স্থিতিভিত্তিক পরিদর্শন ২০১০ সালে পরিচালনা করা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের বার্ষিক পরিদর্শন কর্মসূচি তৈরির বিদ্যমান নীতিমালা অনুযায়ী, উক্ত পরিদর্শন কর্মসূচি তৈরির সময় সোনালী ব্যাংক, হোটেল শেরাটন শাখার (বর্তমানে রূপসী বাংলা) ঋণের পরিমাণ ছিল ৫৭ কোটি টাকা। নিতান্তই ছোট শাখা। ওই পরিদর্শনে মেসার্স হলমার্ক ফ্যাশন লি. ও অন্যান্যের অনুকূলে ৪৮ দশমিক ৯৩ লাখ মার্কিন ডলার মূল্যমানের ঋণপত্রের বিপরীতে সীমাতিরিক্ত প্রি-শিপমেন্ট ক্রেডিট প্রদানের তথ্য উদ্ঘাটিত হয়। সেই সময় হলমার্ক ফ্যাশনের কিছু অনিয়ম উদ্ঘাটিত হয়। এ পরিপ্রেক্ষিতে সোনালী ব্যাংক গত ১৩ অক্টোবর ২০১০ সালে বাংলাদেশ ব্যাংককে জানায়, 'পিএসসি ঋণসমূহ আদায় করে ঋণসীমার মধ্যে আনা হয়েছে এবং ভবিষ্যতে সীমাতিরিক্ত পিএসসি সুবিধা যেন আর না দেওয়া হয় সে বিষয়ে সতর্ক থাকা হবে।' ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০১০ স্থিতিভিত্তিক পরিদর্শন কর্মসূচির সময় (২০১১ সালে পরিচালিত) উক্ত শাখার ঋণের পরিমাণ ছিল ৬৯ কোটি টাকা। তখনও ছোট শাখা, তাই বিশদ পরিদর্শনের আওতায় আসেনি। কিন্তু দ্রুতই পরিস্থিতি বদলে যায়। রাতারাতি এ শাখা হয়ে ওঠে বড় ঋণ প্রদানের অন্যতম উৎস। এ পরিবর্তন কীভাবে হতে পারল_ সেটা নিয়ে তদন্ত হওয়া উচিত।
৩০ সেপ্টেম্বর, ২০১১ স্থিতিভিত্তিক পরিদর্শন কর্মসূচি তৈরির সময় (২০১২ সালে পরিচালিত) শাখাটির ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ৫৫৫ কোটি টাকা। এবার শাখাটি বড় শাখা হিসেবেই বার্ষিক বিশদ পরিদর্শন কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত হয়।
স্বাভাবিক নিয়মেই যে কোনো ব্যাংকের জালিয়াতি রোধে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের প্রাথমিক দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার ওপর বর্তায়। প্রতিটি ব্যাংকেরই শাখা পর্যায়, আঞ্চলিক কার্যালয় এবং প্রধান কার্যালয় কর্তৃক নিজস্ব নিয়মে যথাযথ অডিট কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের দায়দায়িত্ব সুনির্দিষ্ট। প্রতিটি ব্যাংকেরই রয়েছে নিজস্ব পরিচালক পর্ষদ, পর্ষদের নির্বাহী কমিটি ও অডিট কমিটি। এদের কাজে গাফিলতি বা বড় ধরনের ব্যর্থতার পেছনে রাজনৈতিক চাপ থাকতে পারে। কিংবা প্রভাব ফেলতে পারে দুর্নীতি।
সোনালী ব্যাংকের হোটেল শেরাটন (রূপসী বাংলা) শাখায় প্রাথমিকভাবে ২৬৩৮ কোটি টাকার (ফান্ডেড ও নন-ফান্ডেড দায়সহ) জালিয়াতির ঘটনা উদ্ঘাটিত হয়। এটা ছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদারকি। সোনালী ব্যাংকের সর্বশেষ নিরীক্ষায় উক্ত শাখায় মে, ২০১২ পর্যন্ত মোট ৩৫৪৭ কোটি টাকা জালিয়াতির ঘটনা উদ্ঘাটিত হয়। পরিদর্শন প্রতিবেদন অনুযায়ী হলমার্ক গ্রুপসহ ছয়টি গ্রুপের নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের মধ্যে স্থানীয় এলসি স্থাপন, অভ্যন্তরীণ বিল ক্রয়, ভুয়া রফতানি বিল ক্রয়, অ্যাকোমোডেশন বিল সৃষ্টি এবং প্যাকিং ক্রেডিট সুবিধার মাধ্যমে ব্যাংক কর্মকর্তাদের যোগসাজশে উলি্লখিত পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে। এ ক্ষেত্রে শাখায় যথাযথ রেকর্ড সংরক্ষণ করা হয়নি। শাখার ডিজিএম এবং এজিএম উলি্লখিত গ্রাহকদের এলসি-সংশ্লিষ্ট রেকর্ডপত্র_ অধিকাংশ ক্ষেত্রে পুরো নথি গ্রাহকদের দিয়ে দেন। এলসি খোলা এবং স্বীকৃতি প্রদানের তথ্যাদি অধিকাংশ ক্ষেত্রে কো-রেজিস্টারে সংরক্ষণ করা হয়নি। এমনকি কোনো ভাউচার ছাড়া হয়নি এবং সংশ্লিষ্ট ইনল্যান্ড এলসি থেকে সৃষ্ট দায় শাখার দৈনন্দিন বিবরণীতেও প্রদর্শন করা হয়নি। তাছাড়া একই শাখায় অর্থাৎ নিজের শাখার গ্রাহকদের মধ্যে খোলা এলসির বিপরীতে বিল ক্রয়ের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টস্ ছাড়াই ভাউচারের মাধ্যমে ঋণ সুবিধার নামে অর্থ প্রদান করা হয়েছে।
সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের তদারকি ব্যবস্থা শিথিল ছিল_ তাতে সন্দেহ নেই। বাংলাদেশ ব্যাংক হলমার্কের ঋণ জালিয়াতির ঘটনা উদ্ঘাটন করে এবং তাৎক্ষণিকভাবে প্রয়োজনীয় প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণসহ দায়ী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনে ফৌজদারি মামলার নির্দেশ দেয়। অসাধু ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান-ব্যক্তির ব্যাংক থেকে নানাবিধ কৌশলে অর্থ হাতিয়ে নেওয়া ঠেকাতে এটা অপরিহার্য। অন্যান্য ব্যাংকে যাতে এ ধরনের ঘটনা না ঘটে, সে জন্যও বাংলাদেশ ব্যাংকের তদারকি ব্যবস্থা আরও ঘন ঘন হতে হবে। কিন্তু রাজনৈতিক চাপ সামলাবে কে? শুধু সরকার পরিচালিত ব্যাংকগুলো নয়, কেন্দ্রীয় ব্যাংকেও কিন্তু এ চাপ দৃশ্যমান। অর্থমন্ত্রী বাংলাদেশ ব্যাংকের এখতিয়ার নিয়ে যে প্রশ্ন তোলেন, সেটা কিন্তু এ চাপেরই বহিঃপ্রকাশ।

আমিনুল ইসলাম :সাবেক ব্যাংকার

No comments

Powered by Blogger.