সংবাদ সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্র মিশন-রোহিঙ্গাদের জন্য মিয়ানমারে অনুকূল পরিবেশ জরুরি

রোহিঙ্গাদের জন্য মিয়ানমারে অনুকূল পরিবেশ ও মানবিক সহায়তার ওপর গুরুত্বারোপ করেছে সফররত যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিদল। গত শনিবার থেকে মিয়ানমার ও বাংলাদেশের রোহিঙ্গা-সংশ্লিষ্ট এলাকাগুলো পরিদর্শন এবং উভয় দেশের সরকারের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক শেষে গতকাল বৃহস্পতিবার ঢাকায় আমেরিকান সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন ওই প্রতিনিধিদলের সদস্যরা।


যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদলের সদস্যরা জানান, মিয়ানমারের সিতুয়ে ও মংডু এলাকায় নজিরবিহীন সফরে তাঁরা রোহিঙ্গা ও রাখাইন উভয় সম্প্রদায়েরই শিবির পরিদর্শন করেছেন। গত জুন মাসে সেখানে বড় ধরনের সংঘাতের তিন মাস পরও তাঁরা এখনো উত্তেজনা, ঝুঁকি ও বাস্তুচ্যুতি দেখতে পেয়েছেন। তাঁরা মনে করেন, সেখানে সাম্প্রদায়িক ঐক্য গড়ে তোলার পাশাপাশি ব্যাপক পরিসরে মানবিক ত্রাণ সহায়তা শুরু করা উচিত। এদিকে বাংলাদেশ যাতে তার ঐতিহ্য অনুযায়ী মিয়ানমারের আশ্রয়প্রার্থীদের আশ্রয় দেয় সে ব্যাপারেও প্রত্যাশা জানিয়েছেন তাঁরা। পাশাপাশি এ দেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তা কার্যক্রমের ওপর তাঁরা জোর দিয়েছেন।
গতকাল ও আগের দিন কক্সবাজার এলাকার রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শন শেষে সংবাদ সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের জনসংখ্যা, শরণার্থী ও অভিবাসন ব্যুরোর উপসহকারী মন্ত্রী কেলি ক্লিমেন্টস, গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও শ্রম ব্যুরোর উপসহকারী মন্ত্রী ডেনিয়েল বেয়ার এবং রাষ্ট্রদূত ড্যান ডাব্লিউ মজিনা নিজেদের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন। ওই দুই উপসহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রীসহ পূর্ব এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় ব্যুরোর মুখ্য উপসহকারী মন্ত্রী জোসেফ উন এবং দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া ব্যুরোর উপসহকারী মন্ত্রী আলিসা আয়ার্স গত শনিবার থেকে মিয়ানমার সফর করেছেন। মঙ্গলবার ঢাকায় এসেই রাষ্ট্রদূত ড্যান ডাব্লিউ মজিনাকে নিয়ে তাঁরা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন।
রাষ্ট্রদূত মজিনা গতকাল ঢাকায় সংবাদ সম্মেলনের শুরুতেই বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন গত মে মাসে ঢাকা সফরকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি ও বিরোধীদলীয় নেত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎকালে রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেছেন। এবার তিনি চারজন উপসহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সমন্বয়ে গঠিত অত্যন্ত উঁচু পর্যায়ের একটি প্রতিনিধিদলকে পরিস্থিতি সরেজমিনে দেখার জন্য পাঠিয়েছেন।
জনসংখ্যা, শরণার্থী ও অভিবাসন ব্যুরোর উপসহকারী মন্ত্রী কেলি ক্লিমেন্টস বলেন, তাঁরা পাঁচ দিন ধরে রোহিঙ্গা-সংশ্লিষ্ট এলাকাগুলো সফর করছেন। মিয়ানমারের সিতুয়েতে তাঁরা এখনো উত্তেজনাকর পরিস্থিতি উপলব্ধি করেন। তিনি আরো বলেন, রাখাইন রাজ্যে ওই উত্তেজনা অত্যন্ত স্পষ্ট। সেখানে বাস্তুচ্যুতি অব্যাহত রয়েছে।
কেলি ক্লিমেন্টস বলেন, মিয়ানমারের মংডুতে বাস্তুচ্যুতির হার সিতুয়ের মতো প্রবল না হলেও সেখানে উত্তেজনা ও ঝুঁকি অনেক। তিনি বলেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রীর (হিলারি ক্লিনটন) কাছে তাঁরা কিছু সুপারিশ করবেন। তবে ওখানে তাৎক্ষণিক, স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি অনেক ইস্যু রয়েছে। এগুলোর মধ্যে সরকারি কাজে সহায়তার জন্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর মাধ্যমে ব্যাপক পরিসরে মানবিক সাহায্য অন্যতম। বিশেষ করে জরুরি ভিত্তিতে ত্রাণ সহায়তা পৌঁছানোটা হবে তাৎক্ষণিক অগ্রাধিকার। মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি অগ্রাধিকার হিসেবে গোষ্ঠীগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করা এবং প্রত্যাবাসন ও বসবাসের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির কথা বলেন কেলি ক্লিমেন্টস।
নতুন করে শরণার্থী নিতে বাংলাদেশের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের আহ্বান আছে কি না জানতে চাইলে রাষ্ট্রদূত মজিনা বলেন, বাংলাদেশের আশ্রয় দেওয়ার ও আতিথেয়তার ঐতিহ্য রয়েছে। প্রাণ বাঁচাতে মিয়ানমার থেকে অনেকে আশ্রয় নিতে চাইছে। বাংলাদেশ তার ঐতিহ্য ধরে রাখবে- যুক্তরাষ্ট্র এমনটাই প্রত্যাশা করে।
রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের আলোচনাকে যুক্তরাষ্ট্র স্বাগত জানায় বলে সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়। এ ছাড়া বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের বাইরে তৃতীয় কোনো দেশে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে আলোচনা চলতে পারে বলে কেলি ক্লিমেন্টস জানান।
মিয়ানমারের ওপর থেকে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার ক্ষেত্রে রোহিঙ্গা নিপীড়ন বন্ধের শর্ত আরোপ করা হবে কি না জানতে চাইলে গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও শ্রম ব্যুরোর উপসহকারী মন্ত্রী ডেনিয়েল বেয়ার বলেন, তাঁরা আশা করেন যে মিয়ানমারে পুরোপুরি গণতন্ত্র আসবে। দেশটির সঙ্গে সহযোগিতা আরো বিস্তৃত হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র রোহিঙ্গাদের বিষয়টি তুলে ধরছে।
অন্য এক প্রশ্নের জবাবে যুক্তরাষ্ট্র মিশনের পক্ষ থেকে জানানো হয়, রাখাইন প্রদেশে জীবনমান উন্নয়নে সেখানে উন্নয়ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
এদিকে গতকাল সকালে কক্সবাজারে টেকনাফ উপজেলার লেদায় অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা বস্তি পরিদর্শন শেষে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র্র দপ্তরের শরণার্থী ও অভিবাসন ব্যুরোর উপসহকারী মন্ত্রী কেলি ক্লিমেন্টস সাংবাদিকদের বলেন, মিয়ানমারে এখনো উত্তেজনাকর পরিস্থিতি রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম সফরকারী দল হিসেবে তাঁরা মিয়ানমারের মংডু ও সিতুয়েতে যেতে পেরেছেন । তবে সফরকালে পরিস্থিতি দেখে তাঁরা শঙ্কিত। তিনি বলেন, মংডুতেও লোকজন সহিংসতার শিকার হয়েছে। এ নিয়ে প্রতিনিধিদল উদ্বিগ্ন।
টেকনাফ সফরকালে প্রতিনিধিদলের সদস্যরা বলেন, বাংলাদেশ ঘনবসতিপূর্ণ, অর্থনৈতিকভাবেও সবল নয়। এর পরও শরণার্থীদের নিরাপত্তা ও আশ্রয় দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। স্বল্প মেয়াদে মানবিক সহায়তা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। একে সামনে রেখে বিভিন্ন সংস্থাকে কাজের সুযোগ দিয়ে সরকারের অংশীদার হিসেবে সমাধানে এগিয়ে আসতে পারে বাংলাদেশ।
যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ড্যান ডাব্লিউ মজিনা সাংবাদিকদের বলেন, রোহিঙ্গারা যাতে স্বাধীনভাবে ও নিরাপত্তা নিয়ে নিজেদের দেশে ফিরতে পারে সে প্রার্থনাই তাঁরা করছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদল গত বুধবার কুতুপালং শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করে। ওই সময় দূতাবাসের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, স্থানীয় প্রশাসনিক ও পুলিশ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

No comments

Powered by Blogger.